আন্তর্জাতিকতাবাদ হচ্ছে বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রাখার নীতি

ইন্টারন্যাশনালিজম বা আন্তর্জাতিকতাবাদের (ইংরেজি: Internationalism) একটি সাধারণ অর্থ বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার নীতি। কিন্তু শব্দটির বিকাশ ঘটেছে আধুনিককালে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরোধী চিন্তা হিসাবে। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের প্রবণতা হচ্ছে নিজের জাতি ও রাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রধান বলে গণ্য করা এবং অপর জাতি এবং রাষ্ট্রের স্বার্থসমূহকে উপেক্ষা করা।

সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মারাত্মক প্রকাশ দেখা যায় এই শতকের বিশ এবং ত্রিশ শতকে ইতালী এবং জার্মানীতে। ইতালির ফ্যাসিস্ট দল এবং জার্মানীর নাৎসী দল তাদের দলীয় এবং রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে নিজেদের জাতি এবং রাষ্ট্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘোষণা করে এবং অপর জাতি এবং রাষ্ট্রকে অধম এবং পদানত হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচনা করে। এই নীতিতে তারা জঙ্গীভাবে সংঘটিত হয় এবং পার্শ্ববর্তী দুর্বল রাষ্ট্রসমূহকে নানা অজুহাতে গ্রাস করতে শুরু করে। এই নীতির পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং জার্মানী এবং ইতালি ও তাদের মিত্র জাপান যুদ্ধে পরাজিত হয়।

উগ্র জাতীয়তাবাদের এই অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়ায় জাতিতে জাতিতে সমতাবোধ এবং শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে। অনেক চিন্তাবিদ জাতীয়তাবাদ তথা জাতীয় রাষ্ট্রের অবাঞ্চনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং একটি বিশ্বরাষ্ট্রের কল্পনা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতা ওয়েনডেল উইলকী (১৮৯২-১৯৪৪) এর ‘ওয়ান ওয়ার্লড’ বা ‘এক পৃথিবী’ গ্রন্থখানির কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

আন্তর্জাতিকতাবাদ অধিকতর সুনির্দিষ্ট ও বিশেষ অর্থে আধুনিককালের সকল দেশের সাম্যবাদী আন্দোলনে ব্যবহৃত হয়। সাম্যবাদী বা কমউনিস্ট দলসমূহ আন্তর্জাতিকতাবাদকে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক আন্দোলন তথা শ্রেণীহীন সমাজ তৈরির সংগ্রামে আদর্শগত হাতিয়ার বলে গণ্য করে। সাম্যবাদী আন্দোলনের মূল শক্তি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী। শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় প্রত্যেক রাষ্ট্রে যেমন সবচেয়ে শোষিত শ্রেণী, তেমনি ধনিক শ্রেণীর পাল্টা শক্তি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী।

কোনো দেশের শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন কেবলমাত্র কোনো বিশেষ দেশের শ্রমিকদের উপর শোষণ বিলোপের আন্দোলন নয়। এককভাবে কোনো দেশের শ্রমিক চূড়ান্তভাবে শোষণহীন সমাজ ও রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে না। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কেবলমাত্র কোনো বিশেষ দেশের শোষণকারী শ্রেণী নয়। সকল দেশের ধনিকগণই তাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষায় পরস্পরযুক্ত। ধনিক শ্রেণী আন্তর্জাতিক শ্রেণী, তারা আন্তর্জাতিকভাবে সংঘবদ্ধ। শোষিত শ্রমিক শ্রেণীও আন্তর্জাতিক শ্রেণী। দেশ নির্বিশেষে তাদের মৌলিক স্বার্থ অভিন্ন। এ কারণে আন্তর্জাতিক ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীকেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এক দেশের শ্রমিক শ্রেণীকে অপর দেশের শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের পাশে দাঁড়াতে হবে। সাম্যবাদী আন্তর্জাতিকতার এই হচ্ছে মৌলভাব। এই আদর্শের ক্ষেত্রে তাই কোনো বিশেষ দেশ বা জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা আসতে পারে না।

আরো পড়ুন:  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতির প্রধান প্রধান শক্তি হচ্ছে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

ছোট বড় সকল জাতি ও রাষ্ট্রের শোষিত মানুষই হচ্ছে সমান এবং তাদের মূল লক্ষ্য এবং স্বার্থ এক। এই নীতির প্রকাশ করে কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের রচিত ‘কমউনিস্ট ম্যানিফেসটো’তো বিশ্বের সকল দেশের সর্বহারাদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছেন: ‘ওয়ার্কারস অব অল কান্ট্রিজ, ইউনাইট :‘সকল দেশের সর্বহারাগণ এক হও’।

শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবোধকে প্রকাশ করে সাম্যবাদী দলসমূহ একটি আন্তর্জাতিক সঙ্গীতও রচনা করেছে। ইউরোপে সংঘটিত শ্রমিক এবং সাম্যবাদী দলসমূহ নিজেদের সমন্বয়ে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা’ ও স্থাপন করেছিলেন। এই সংগঠন ওয়ার্কার্স ইন্টারন্যাশনাল বা শ্রমিক আন্তর্জাতিক নামে পরিচিত ছিল।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৩৫-২৩৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!