চীন বা চিন বা গণচীন বা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (ইংরেজি: People’s Republic of China) হচ্ছে এশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী সন্ত্রাসবাদী সামরিক রাষ্ট্র। ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন গঠিত হয় এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে মাও সেতুংয়ের মৃত্যুর পর চীন পুঁজিবাদী পথ গ্রহণ করে এবং শি জিনপিং ক্ষমতা গ্রহণের পর চীন একটি সন্ত্রাসবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
রাষ্ট্রীয় ভূভাগ এবং প্রশাসনিক বিভাগ
ভৌগোলিকভাবে গণ প্রজাতন্ত্রী চীন ইউরেশিয়া ভূভাগের দক্ষিণপূর্ব অংশে, প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত।
চীনদেশ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ; সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ক্যানাডার পরই চীনের স্থান। চীনের স্থলভাগের মোট আয়তন ৯৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার (৩৭ লক্ষ ৭ হাজার বর্গমাইল)। উত্তরে (৫৩ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশ) মোহো’র কাছাকাছি হেইলোংজিয়াং-এর প্রধান নৌপ্রণালীর মধ্যরেখা থেকে, দক্ষিণে (চার ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশ) নানশা দ্বীপপুঞ্জের জেংমু প্রবালপ্রাচীর পর্যন্ত, এবং পশ্চিমে (৭৩ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমা) পামির মালভূমি থেকে পূবে (১৩৫ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমা) হেইলোংজিয়াং নদী আর উসুলি নদীর মোহনা পর্যন্ত এই বিশাল দেশ বিস্তৃত।
চীনের স্থলসীমার দৈর্ঘ্য ২০,০০০ কিলোমিটারেরও (সাড়ে বারো হাজার মাইল) বেশি। স্থলসীমা বেষ্টন করে আছে: পূবদিকে, কোরিয়া গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্র, উত্তরদিকে, মঙ্গোলিয়া গণপ্রজাতন্ত্র ; উত্তরপূবে আর উত্তরপশ্চিমে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন; পশ্চিমে আর দক্ষিণপশ্চিমে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, সিকিম আর ভূটান ; এবং দক্ষিণে, বার্মা, লাওস ও ভিয়েতনাম। চীনের মূলভূমির উপকূলরেখা ১৮,০০০ কিলোমিটারেরও (১১,১৮৫ মাইল) বেশি দীর্ঘ। পূবদিকে পূর্ব চীন সাগর আর দক্ষিণপূর্ব দিকে দক্ষিণ চীন সাগরের পরপারে রয়েছে জাপান, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনেই।
চীনের মূলভূমিকে পূব আর দক্ষিণ দিক দিয়ে বেড় করে রেখেছে বোহাই সাগর, হুয়াংহাই সাগর (হলুদ সাগর) এবং পূর্ব চীন সাগর আর দক্ষিণ চীন সাগর। বোহাই একটি অভ্যন্তরমূখী সাগর, বাকি তিনটি প্রশান্ত মহাসাগরের প্রান্তিক সাগর।
চীনের বিশাল ভূভাগীয় সাগরগুলোর মধ্যে ছড়ানো রয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি দ্বীপ। এই দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় তাইওয়ান দ্বীপ, তারপরই হাইনান দ্বীপ। দক্ষিণ চীন সাগরের বুকে ইতস্তত যেসব অসংখ্য ছোটবড় দ্বীপ, প্রবালপ্রাচীর আর মগ্নচড়া বিরাজ করছে সেগুলোকে একত্রে দক্ষিণ চীন সাগর দ্বীপপুঞ্জ বলা হয়, কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে ডোংশা দ্বীপপুঞ্জ, সিশা দ্বীপপুঞ্জ, যোংশা দ্বীপপুঞ্জ এবং নানশা দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত।
চীন-কোরিয়া সীমান্তের ইয়ালু নদীর মোহনা থেকে চীন-ভিয়েতনাম সীমান্তের বেইলুন নদীর মোহনা পর্যন্ত প্রসারিত চীনের উপকূল বরাবর অনেকগুলো চমৎকার প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় দেখা যায়। এইসব পোতাশ্রয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ডালিয়ান, ছিনহুয়াংডাও, থিয়ানজিন, ছিংডাও, লিয়ানইয়ু নগাং, শাংহাই, হুয়াংপু, যানজিয়াং এবং তাইওয়ান দ্বীপের জিললাং ও গাওসিয়োং।
প্রশাসনের প্রয়োজনে চীন দেশকে ২২টি প্রদেশে আর পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এ ছাড়া আছে সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে তিনটি পৌর অঞ্চল।
প্রদেশের বা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অধীনস্থ নিম্নতর প্রশাসনিক মণ্ডলগুলোর মধ্যে আছে: শহর, স্বশাসিত বিভাগ, জেলা, এবং স্বশাসিত জেলা। জেলা বা স্বশাসিত জেলার অধীনে গণ-কমিউন আর আধা-শহর। চীনে মোট জেলা আছে ২,১৩৭ টির বেশি।
চীনে যে বাইশটি প্রদেশ আছে সেগুলোর নাম[১]: হোবেই (শিজিয়াযুয়াং), শানসি (থাইইউয়ান), লিয়াওনিং (শেনইয়াং), জিলিন (ছাংছুন), হেইলোং-জিয়াং (হারবিন), সেনসী (সিআন), গানসু (লানযৌ), ছিংহাই (সীনিং), শানডোং (জিনান), জিয়াংসু (নানজিং), যেজিয়াং (হাংযৌ), আনহুই (হোফেই), জিয়াংসী (নানছাং), ফুজিয়ান (ফুযৌ), তাইওয়ান, হোনান (যেংযৌ), এবং হুবেই (উহান), হুনান (ছাংশা), গুয়াংডোং (গুয়াংযৌ), সিছুয়ান (ছেংডু), গুইযৌ (গুইইয়াং) এবং ইয়ু ন্নান (খুনমিং)।
চীনে যে-পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আছে সেগুলোর নাম: অন্তর্মঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (হোহহট), নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (ইনছুয়ান), সিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (উরুমছি), গুয়াংসী যুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (নাননিং), এবং তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (লাশা)।
কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি কর্তৃত্বাধীন তিনটি শহরের নাম: বেইজিং, শাংহাই এবং থিয়ানজিন।[২]
বোহাই সাগর থেকে পশ্চিম দিকে এবং উত্তর চীন সমতলভূমির উত্তরপশ্চিম প্রান্তভাগে চীনের রাজধানী বেইজিং। খাস শহর ও উপকণ্ঠের এলাকাগুলো মিলিয়ে বেইজিং-এর মোট আয়তন ১৬,৮০০ বর্গ কিলোমিটার (৬৪৮৫ বর্গ মাইল), মোট লোকসংখ্যা ৮৭ লক্ষ। বেইজিং চীন দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং সেইসঙ্গেই দেশজোড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার সন্ধিমূল। আটশো বছরের প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন এই প্রাচীন রাজধানীতে আছে এমন অনেক জায়গা যা মনোরম দৃশ্যাবলীতে রূপময় অথবা ঐতিহাসিক গুরুত্বে গরীয়ান।[৩]
আধুনিক চীনের শিল্পায়নে দ্রুত উন্নয়নের চেষ্টা হচ্ছে মহা উল্লম্ফন বা গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড (ইংরেজি: Great Leap Forward)। উৎপাদনের পরিমাণে বিরাট পরিমাণ ধার্য করা এবং কৃষি ও শিল্প উভয়ক্ষেত্রে একই সাথে তা পূর্ণ করার চেষ্টা ঘোষণা করা হয়। কৃষিতে কমিউন ব্যাপক সংখ্যায় সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উচ্চমান অর্জন করতে না পারায় পরিকল্পনা বিফল হয়। জাতীয় নেতা মাও সেতুঙের উপর এই বিফলতার দায়িত্ব ন্যস্ত হয় এবং মাও সেতুঙ দ্রুত উন্নয়নের এই পরিকল্পনায় ব্যর্থ হওয়ার সমালোচনার পাত্র হতে শুরু করেন।[৪]
চীনের প্রাচীর (ইংরেজি: Great Wall of China) হচ্ছে উত্তর চীনে আত্মরক্ষামূলক এক বিরাট ঐতিহাসিক দেয়াল। দৈর্ঘে ছিল ৪২০০ মাইল। এই দেয়াল তৈরি করা শুরু হয় মিং রাজবংশের শাসনকালে ১৩৬৮ খৃষ্টাব্দে এবং সমাপ্ত হয় ১৫৪৪ খৃষ্টাব্দে। আত্মরক্ষামূলক হলেও চীনের এই বিরাট দীর্ঘ দেয়ালের উপর দিয়ে মানুষও চলাচল করতে পারত। অদ্যাবধি চীনের এই দেয়াল চীন ভ্রমণকারীদের একটি অন্যতম দ্রষ্টব্যের বিষয় হিসাবে বিরাজ করছে।
তথ্যসূত্র ও টিকা
১. প্রত্যেক প্রদেশের বা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের স্থানীয় গণ-সরকারের পীঠস্থান যে শহরে, সেই শহরের নাম প্রদেশের এবং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের নামের পর বন্ধনীতে দেওয়া হয়েছে।
২. নামগুলোর বানানে ব্যবহৃত ‘স’ গুলোকে ইংরেজি ‘S’-এর মতো করে উচ্চারণ করলে জায়গাগুলোর আসল নামের কাছাকাছি উচ্চারণ করা হবে।
৩. ছি ওয়েন সম্পাদিত ও তিয়ান থাই অনূদিত, চীনের রূপরেখা, বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, বেইজিং, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা ১-৩
৪. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৮৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।