ভারত ছাড় আন্দোলন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে স্বাধীনতার দাবিতে সৃষ্ট বামপন্থীদের আন্দোলন

ভারত ছাড় আন্দোলন (ইংরেজি: Quit India Movement) হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক ইংরেজ সরকারের আশু ভারত পরিত্যাগ ও দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে সৃষ্ট আন্দোলন। বিষয়টি বােঝার সুবিধার্থে পূর্ববর্তী প্রাসঙ্গিক ঘটনাবলির সামান্য উল্লেখ প্রয়ােজন। মাদ্রাজ অধিবেশনের (১৯২৭) সময় থেকেই কংগ্রেস দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের আশঙ্কায় সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে যুদ্ধে ভারতের জড়িয়ে পড়ার বিরােধী ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু (১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯) হয়ে যাবার পর জনমত এবং বিশেষ করে কেন্দ্রীয় আইনসভার অভিমত না নিয়েই বড়লাট যুদ্ধে ভারতের যােগদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। সরকারের যুদ্ধনীতির ব্যাখ্যা এবং ভারতকে স্বাধীনতাদানের আশু সম্ভাবনার বিষয়ে ইংরেজ সরকারের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না পাওয়ায় এগারােটি প্রদেশে কংগ্রেসের মন্ত্রিসভাসমুহ পদত্যাগ করে। সরকারের সঙ্গে দীর্ঘ বাদানুবাদ ও আপসমূলক আলােচনা নিস্ফল হয়ে যাওয়ায় মোহনদাস গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ব্যাপক আইন অমান্যের পথে না গিয়ে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ শুরু করে (১৭ অক্টোবর ১৯৪০)। নেতৃবৃন্দসহ কয়েক সহস্র কংগ্রেস কর্মী পর্যায়ক্রমে কারাবরণ করেন। সত্যাগ্রহ ফলপ্রসূ না হওয়ায় বছরখানেক পরে প্রত্যাহর করে নেওয়া হয়।

ইত্যবসরে বিভিন্ন দল ও নেতার মধ্যে দেশের পরিবর্তন সম্পর্কে মতভেদ প্রবল হয়ে ওঠে। যুদ্ধের পরিস্থিতিও সংকটজনক হয়ে পড়ছিল। বেসামরিক প্রশাসনে অচলাবস্থার দূরীকরণের উদ্দেশ্যে ১৯৪২ খ্রি মার্চ মাসে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সদস্য সার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ভারতে পাঠানাে হয়। ক্রিপসের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের আলােচনা-বৈঠক পক্ষকাল পরে নিষ্ফল হয়ে ভেঙে যায়। যুদ্ধোত্তর শাসন সংস্কার সম্পর্কে ক্রিপস প্রস্তাব কোনও দলই মেনে নিতে পারেনি, অবশ্য নিজ নিজ কারণে। অবিলম্বে কংগ্রেসের হাতে বেসামরিক ক্ষমতার হস্তান্তরই ছিল কংগ্রেসের প্রধান দাবি; নইলে ব্যাপক আকারে আইন অমান্য আন্দোলন তথা প্রকাশ্য বিদ্রোহ শুরু করা হবে বলে জানানাে হয়।

আরো পড়ুন:  মোগল সাম্রাজ্য দক্ষিণ এশিয়ার সামন্তবাদী জনবিরোধী প্রাচীন সাম্রাজ্য

১৪ জুলাই ওয়ার্ধায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় মোহনদাস গান্ধীর প্রস্তাবক্রমে ভারত ছাড় আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু আন্দোলনের রূপ ও কৌশল সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট কোনও ভাবনাচিন্তা ছিল না। কমিটির অন্যান্য সদস্যেরা ছিলেন গান্ধীজির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। বড়লাট এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস প্রতিনিধিদের সঙ্গে আপস আলােচনার অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর ৭ ও ৮ অগস্ট বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত এ আই সি সি অধিবেশনে ওয়ার্কিং কমিটির খসড়া প্রস্তাব অনুমােদিত হয়। স্বাধীন ভারতের শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে আলােচনার সঙ্গে অহিংস পথে ভারত ছাড় আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এদিকে ৮ আগস্ট বড়লাটের কার্যনির্বাহী সংসদে গৃহীত এক প্রস্তাবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় বিপজ্জনক ব্যাঘাত সৃষ্টি ও দেশবাসীর মনােবল বিনষ্ট করে দেবার অভিযােগ করা হয়। ৯ আগস্ট কংগ্রেস দল বে-আইনি ঘােষিত হয়। নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হন। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রবল বিক্ষোভ ও হিংসাত্মক আন্দোলন দেখা দেয়। দেশের পূর্ব সীমান্তে ভূখণ্ড জাপানি ফৌজ হানা দিয়েছে।

আন্দোলনের নামে যা শুরু হয় সেটা ছিল মূলত জনরােষ। অসংগঠিত, পরিকল্পনাবিহীন ও নেতৃত্ব ছাড়াই আন্দোলন নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ে। উগ্রপন্থী ও বিপ্লবী বিভিন্ন গােষ্ঠী এবং কংগ্রেস সােসালিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন বামপন্থী দল অহিংস নীতি পরিহার করে। একদিকে সরকারি দমননীতি ও ব্যাপক ধরপাকড়, অন্যদিকে প্রবল জনবিক্ষোভ । দেশের প্রায় সর্বত্র প্রকাশ্য বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। মহারাষ্ট্রের কয়েকটি অঞ্চল, উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশ, উত্তর বিহার, বঙ্গদেশের তমলুক মহকুমায় জাতীয় সরকার গঠিত হয়। মাদ্রাজ, বােম্বাই ও মধ্যপ্রদেশে যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ও কলকারখানায় দীর্ঘদিন ধরে ধর্মঘট চলে। স্বাধীন সরকার ও তার বেতারকেন্দ্র কোনও কোনও স্থানে গড়ে ওঠে। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্যে সহস্রাধিক ব্যক্তি নিহত ও তিন সহস্রাধিক ব্যক্তি আহত হন।

সংগঠনের অভাবে ভারত ছাড় আন্দোলন মাস কয়েকের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে পড়ে। আন্দোলনের পিছনে কার্যত বামপন্থীরাই ছিলেন প্রথমাবধি সক্রিয়। কংগ্রেস সােসালিস্ট পার্টির নেতা আচার্য নরেন্দ্র দেব পরে মন্তব্য করেন যে আন্দোলনের অভীষ্ট লক্ষ্যের সিদ্ধিলাভ হয়নি। তার কারণ হিসাবে আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ জেল থেকে মুক্তির পর বলেন যে কুশল সংগঠন ও জনসমক্ষে কর্মসুচি তুলে ধরার অভাবে আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। ডানপন্থীরা ভেবেছিলো যে গণশত্রু গান্ধী আন্দোলনের একটি কর্মসূচি তুলে ধরবে। কিন্তু অনতিকাল পরে মুক্তি পেয়ে গান্ধী বড়লাটের সঙ্গে যখন আলােচনায় বসে তখন সে সহিংস আগস্ট আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকার করে।

আরো পড়ুন:  আকবরের শাসনামলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ২১৮-২১৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!