ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল

লন্ডন, শুক্রবার, ২২ জুলাই, ১৮৫৩

এ চিঠিতে আমি ভারত সম্পর্কে আমার মন্তব্যের উপসংহার টানতে চাই। ইংরেজ প্রভুত্ব ভারতে প্রতিষ্ঠিত হল কি করে ? মহা মোগলদের একচ্ছত্র ক্ষমতা ভেঙে ফেলেছিল মোগল শাসনকর্তারা। শাসনকর্তাদের ক্ষমতা চূর্ণ করল মারাঠারা। মারাঠাদের ক্ষমতা ভাঙল আফগানরা; এবং সবাই যখন সবার সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত, তখন প্রবেশ করল ব্রিটেন এবং সকলকেই অধীন করতে সক্ষম হলো। দেশটা শুধু হিন্দু আর মুসলমানেই বিভক্ত নয়, বিভক্ত উপজাতিতে বর্ণাশ্রম-জাতিভেদে; এমন একটা স্থিতি সাম্যের ভিত্তিতে সমাজটার কাঠামো গড়ে উঠেছিল যা এসেছে সমাজের সভ্যদের মধ্যস্থ একটা পারস্পরিক বিরাগ ও প্রথাবদ্ধ পরস্পর বিচ্ছিন্নতা থেকে; এমন একটা দেশ ও এমন একটা সমাজ, সে কি বিজয়ের এক অবধারিত শিকার হয়েই ছিল না? হিন্দুস্তানের অতীত ইতিহাস না জানলেও অন্তত এই একটি মস্ত ও অবিসংবাদী সত্য তো রয়েছে যে এমন কি এই মুহূর্তেও ভারত ইংরেজ রাজ্যভুক্ত হয়ে আছে ভারতেরই এক ভারতীয় সৈন্য বাহিনী দ্বারাই। বিজিত হবার নিয়তি ভারত তাই এড়াতে পারত না; এবং তার অতীত ইতিহাস বলতে যদি কিছু থাকে তো তার সবখানি হলো পরপর বিজিত হবার ইতিহাস। ভারত সমাজের কোনো ইতিহাসই নেই — অন্তত জানা কোনো ইতিহাস। ভারতের ইতিহাস বলে যা বলি, সে শুধু একের পর এক বহিরাক্রমণকারীর ইতিহাস, যারা ঐ অপ্রতিরোধী ও অপরিবর্তমান সমাজের নিষ্ক্রিয় ভিত্তিতে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে গেছে। ভারত বিজয়ের অধিকার ইংরেজের ছিল কিনা, এটা তাই প্রশ্ন নয়; প্রশ্ন এই, আমরা কি চাই তুর্কী, পারসীক কি রুশদের দ্বারা ভারত বিজয়, নাকি ব্রিটিশদের দ্বারা ভারত বিজয়?

ভারতবর্ষে এক দ্বিবিধ কর্তব্য পালন করতে হবে ইংল্যান্ডকে; একটি ধ্বংসমূলক এবং অন্যটি উজ্জীবনমূলক—পুরাতন এশীয় সমাজের ধ্বংস এবং এশিয়ায় পাশ্চাত্য সমাজের বৈষয়িক ভিত্তির প্রতিষ্ঠা।

আরব তুর্কী, তাতার, মোগল যারা একের পর এক ভারত প্লাবিত করেছে তারা অচিরেই হিন্দু ভুত হয়ে গেছে; ইতিহাস এক চিরন্তন নিয়ম অনুসারে বর্বর বিজয়ীরা নিজেরাই বিজিত হয়েছে তাদের প্রজাদের উন্নততর সভ্যতায়। ব্রিটিশরাই হলো প্রথম বিজয়ী যারা হিন্দু সভ্যতার চেয়ে উন্নত এবং সেই হেতু অনধিগম্য। স্থানীয় গোষ্ঠীগুলিকে ভেঙে দিয়ে, স্থানীয় শিল্পকে উন্মুলিত করে এবং স্থানীয় সমাজে যা কিছু মহৎ ও উন্নত ছিল তাকে সমতল করে নিয়ে ব্রিটিশেরা সে সভ্যতাকে চূর্ণ করে। তাদের ভারত শাসনের ঐতিহাসিক পাতাগুলো থেকে এই ধ্বংসের অতিরিক্ত কিছু পাওয়া যায় না বললেই হয়। স্তূপাকৃতি ধ্বংসের মধ্য থেকে উজ্জীবনের ক্রিয়া লক্ষ্যেই প্রায় পড়ে না। তা সত্ত্বেও সে ক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে।

এ উজ্জীবনের প্রথম শর্ত হল ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য— মোগলই আজম আমলের চেয়েও তা বেশি সংহত ও দূর প্রসারিত। ব্রিটিশ তরবারি দ্বারা আরোপিত সেই ঐক্য এখন বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ দ্বারা দৃঢ়ীভূত ও স্থায়ী হবে। দেশীয় যে সৈন্যবাহিনী ব্রিটিশ ড্রিল-সার্জেন্টদের দ্বারা সংগঠিত ও সুশিক্ষিত হয়ে উঠেছে তা ভারতীয় আত্ম-মুক্তির এবং বহিরাগত যে কোন আক্রমণকারীর শিকার হওয়া থেকে অব্যাহতির Sine qua non। এশীয় সমাজে এই প্রথম প্রবর্তিত এবং হিন্দু ইউরোপীয় সাধারণ যুগ্ম সন্তানদের দ্বারা যা প্রধানত পরিচালিত সেই স্বাধীন সংবাদপত্র পুনর্নির্মাণের এক অভিনব ও শক্তিশালী কারিকা। যত ঘৃণ্যই হোক, জমিদারি ও রায়তোয়ারি হলো জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার দুটি বিশেষ রূপ— এশীয় সমাজের মহান লুপ্তসূত্র হলো এইটে। কলকাতায় ইংরেজদের তত্ত্বাবধানের অনিচ্ছা সহকারে ও স্বল্প পরিমাণে শিক্ষিত ভারতের দেশীয় অধিবাসীদের মধ্য থেকে নতুন একটি শ্রেণী গড়ে উঠেছে যারা সরকার পরিচালনার যোগ্যতাসম্পন্ন এবং ইউরোপীয় বিজ্ঞানে সুশিক্ষিত। ইউরোপের সঙ্গে ভারতের দ্রুত ও নিয়মিত যোগাযোগ এনে দিয়েছে বাষ্প, ভারতের প্রধান প্রধান বন্দরগুলিকে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব মহাসমুদ্রের বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে এবং ভারতের অচলায়তনের যা প্রাথমিক কারণ, সেই বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে তাকে পুনরুত্থিত করেছে। সেদিন দূরে নয়, যখন রেলওয়ে ও বাষ্পীয় পোতের সমন্বয়ে ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যেকার দূরত্ব সময়ের পরিমাপে কমে আসবে আট দিনে এবং এই একদা রূপকথার দেশটা এই ভাবে সত্য করেই পাশ্চাত্য জগতের অন্তর্ভুক্ত হবে।

আরো পড়ুন:  বৈরি সমাজ বিকাশের চালিকাশক্তি শ্রেণিসংগ্রামের স্বরূপ

ভারতের প্রগতিতে এতদিন পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেনের শাসক শ্রেণীগুলির যা স্বার্থ ছিল সেটা নিতান্ত আকস্মিক, অস্থায়ী ও ব্যতিরেকমূলক। অভিজাত শ্রেণি চেয়েছিলো জয় করতে, ধনপতিরা চেয়েছিল লুণ্ঠন, এবং মিলতন্ত্রীরা চেয়েছিল সস্তায় বেচে বাজার দখল। এখন দান উল্টে গেছে। মিলতন্ত্রীরা আবিষ্কার করেছে যে উৎপাদনশীল দেশরূপে ভারতের রূপান্তর তাদের কাছে একান্ত জরুরি এবং সেই জন্যে সর্বাগ্রে সেচ ও অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থা তাতে দিতে হবে। এখন তাদের অভিপ্রায় ভারতের ওপর রেলওয়ের এক জাল বিস্তার করা। এবং সে কাজ তারা করবেই। তার ফল অপরিমেয় হতে বাধ্য।

এ কথা অতি সুবিদিত যে, ভারতের উৎপাদনী শক্তি পঙ্গু হয়ে আছে তার বিভিন্ন উৎপাদন দ্রব্যের পরিবহন ও বিনিময় ব্যবস্থার একান্ত অভাবে। বিনিময় ব্যবস্থার অভাবের জন্যে প্রাকৃতিক প্রাচুর্যের মাঝখানের এমন সামাজিক নিঃস্বতা ভারত ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। ব্রিটিশ কমন্স সভার ১৮৪৮ সালে গঠিত একটি কমিটির কাছে প্রমাণিত হয়েছিলো যে, ‘খান্দেশে যখন এক কোয়ার্টার শস্য বিক্রি হচ্ছিল ৬ থেকে ৮ শিলিং মূল্যে তখন পুনায় তা বিক্রি হচ্ছিল ৬৪ থেকে ৭০ মিলিং দামে— সেখানে লোকে দুর্ভিক্ষে মরে পড়ে থাকছিল রাস্তায়, খান্দেশ থেকে সরবরাহ আসার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না, কেননা কাঁচা রাস্তায় গাড়ি অচল।’

যেখানে রেলপথ বাঁধার প্রয়োজনে মাটি দরকার সেখানে পুকুর খুঁড়ে এবং বিভিন্ন লাইন বরাবর জল সরবরাহ করে রেলওয়র প্রবর্তনকে সহজেই কৃষি উদ্দেশ্যের সহায়ক করে তোলা সম্ভব। এইভাবে প্রাচ্যের চাষ ব্যবস্থার যা অপরিহার্য শর্ত সেই সেচ ব্যবস্থা প্রভূত পরিমাণে বিস্তৃত করা যেতে পারে এবং জলাভাবে বারবার দেখা দেওয়া স্থানীয় দুর্ভিক্ষগুলিকে রোধ করা সম্ভব। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রেলওয়ের সাধারণ গুরুত্ব স্পষ্ট হবে যদি মনে রাখি এমন কি (পশ্চিম ঘাট পূর্ব- ঘাটের নিকটবর্তী জেলাগুলিতে) সেচহীন জমিগুলি তুলনায় সেচ দেওয়া জমিগুলির কর তিন গুণ, কর্মসংস্থান দশ বারো গুণ এবং মুনাফা বারো থেকে পনেরো গুণ বেশি।

রেলওয়ের ফলে সামরিক ব্যবস্থার আয়তন ও ব্যয় কমানোর উপায় হবে। ফোর্ট সেন্ট উইলিয়মের টাউন মেজর কর্নেল ওয়ানে কমন্স সভায় সিলেক্ট কমিটির নিকট বলেন;

“বর্তমানে যত দিন এমন কি যত সপ্তাহ দরকার হয়, মাত্র তত ঘন্টার মধ্যেই দেশের দূর অঞ্চল থেকে সংবাদ পেয়ে যাওয়া এবং আরও কম সময়ের মধ্যে সৈন্য ও রসদসহ নির্দেশ প্রেরণের সম্ভাব্যতা, এ বিবেচনা একটুও ছোটো করে দেখা চলে না। বর্তমান অপেক্ষা আরও দূরবর্তী ও স্বাস্থ্যকর অঞ্চলগুলিতে সৈন্যদের রাখা যাবে এবং এতে করে রোগজনিত জীবনহানি বহু পরিমাণে কমানো যাবে। বিভিন্ন ডিপোতে রসদের ততটা প্রয়োজন থাকতে পারে না, এবং জলবায়ুর কারণে রসদের ক্ষয়ক্ষতি ও নাশ পরিহার করা সম্ভব হবে। সৈন্যবাহিনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ অনুপাতে কমানো যাবে সৈন্যসংখ্যা।”

আমরা জানি, গ্রাম গোষ্ঠীগুলির পৌর সংগঠন ও আর্থনীতিক ভিত্তি ভেঙে গেছে, কিন্তু এগুলির যা সর্বমন্দ দিক— বাঁধাগৎ ও বিচ্ছিন্ন টুকরোয় সমাজের বিচূর্ণীভবন, সেটার প্রাণশক্তি এখনো বজায়। গ্রামগুলির বিচ্ছিন্নতা থেকে সৃষ্টি ভারতে পথঘাটের অভাব এবং পথঘাটের অভাবের ফলে গ্রামগুলির বিচ্ছিন্নতা হয়েছে চিরস্থায়ী। নিম্নতম মাত্রার সুযোগ সুবিধার ওপর, গ্রাম গ্রামান্তরের সঙ্গে প্রায় কোনো যোগাযোগ ছাড়াই এবং সামাজিক অগ্রগতির জন্যে যা অপরিহার্য তেমন আকাঙ্ক্ষা ও প্রচেষ্টা ব্যতিরেকেই এক একটি গোষ্ঠী বেঁচে এসেছে এই ছকের ওপর। গ্রামগুলির এই স্ব-পর্যাপ্ত জাড্য ভেঙে দিয়েছিলো ব্রিটিশরা, রেলপথ যোগাবে যোগাযোগ ও আদান প্রদানের নতুন অভাববোধ। তাছাড়া—

“রেলপথ ব্যবস্থার অন্যতম ফল হবে- রেলপথ প্রভাবিত প্রত্যেকটি গ্রামে অন্যান্য দেশের যন্ত্রপাতি ও কারিগরির জ্ঞান এবং সে জ্ঞান লাভের উপায় সুলভ হবে। তার ফলে ভারতের বংশানুক্রমিক ও বৃত্তিভোগী গ্রাম্য কারিগর প্রথমত তার পুরো যোগ্যতার প্রমাণ পাবে এবং অতঃপর তার ত্রুটি দূরীকরণের সাহায্য হবে” [চ্যাপমান- ভারতের তুলা ও বাণিজ্য]।

আরো পড়ুন:  আধুনিক আসামের ইতিহাসের আরম্ভ আসামে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিস্তার থেকে

আমরা জানি যে ইংরেজ মিলতন্ত্রীরা ভারতে রেলপথ বিভূষিত করতে ইচ্ছুক শুধু এই লক্ষ্য নিয়ে যাতে তাদের কলকারখানার জন্যে কম দামে তুলা ও অন্যান্য কাঁচামাল নিষ্কাশিত করা যায়। কিন্তু যে দেশটায় লোহা আর কয়লা বর্তমান সে দেশের যাত্রায় (Locomotion) যদি একবার যন্ত্রের প্রবর্তন করা যায় তাহলে সে যন্ত্র তৈরির ব্যবস্থা থেকে তাকে সরিয়ে আনা অসম্ভব। রেল চলাচলের আশু ও চলতি প্রয়োজন মেটাবার জন্য যা দরকার সে সব শিল্পকারখানার ব্যবস্থা না করে বিপুল এক দেশের ওপর রেলপথের জাল বিস্তার চালু রাখা যাবে না এবং তার মধ্যে থেকেই গড়ে উঠবে শিল্পের এমন সব শাখায় যন্ত্রশিল্পের প্রয়োগ, রেলপথের সঙ্গে যার আশু সম্পর্ক নেই। তাই এই রেলপথই হবে ভারতের সত্যিতার আধুনিক শিল্পের অগ্রদূত। এ যে নিশ্চয় তা আরও স্পষ্ট এই কারণে যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নিজেরাই স্বীকার করছে, একবারে নতুন ধরনের শ্রম ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং যন্ত্র সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করার মতো বিশেষ যোগ্যতা হিন্দুদের আছে। কলকাতা টাঁকশালে যে দেশীয় ইঞ্জিনিয়ররা অনেক বছর ধরে বাষ্পীয় যন্ত্রে কাজ তাঁদের সামর্থ ও নৈপুণ্য হরিদ্বার কয়লা অঞ্চলে কতকগুলি বাষ্পীয় যন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশীয়গণ এবং অন্যান্য দৃষ্টান্ত থেকে এ ঘটনার প্রভূত প্রমাণ পাওয়া যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুসংস্কারে ভয়ানক প্রভাবিত হওয়া সত্ত্বেও মিঃ ক্যামবেল স্বয়ং স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, “ভারতের বিপুল জনগণের মধ্যে প্রভূত শিল্প ক্ষমতা বর্তমান পুঁজি সঞ্চয়ের মতো যোগ্যতা তাঁদের বেশ আছে, গাণিতিকভাবে তাঁদের মাথা পরিচ্ছন্ন এবং গণনা ও গাণিতিক বিজ্ঞানাদিতে তাদের প্রতিভা অতি উল্লেখযোগ্য।” উনি বলেছেন, “এদের মেধা চমৎকার।”

রেল ব্যবস্থা থেকে উদ্ভুত আধুনিক শিল্পের ফলে শ্রমের বংশানুক্রমিক যে ভাগাভাগির ওপর ভারতের জাতিভেদ প্রথার ভিত্তি, ভারতীয় প্রগতি ও ভারতীয় ক্ষমতার সেই চূড়ান্ত প্রতিবন্ধক ভেঙে পড়বে।

ইংরেজ বুর্জোয়ারা হয়ত বা বাধ্য হয়ে যা কিছুই করুক তাতে ব্যাপক জনগণের মুক্তি অথবা সামাজিক অবস্থার বাস্তব সংশোধন ঘটবে না— এগুলি শুধু উৎপাদনী শক্তির বিকাশের ওপরেই নয়, জনগণ কর্তৃক তাদের স্বত্ব গ্রহণের ওপরেও নির্ভরশীল। কিন্তু এ দুটি জিনিসের জন্যেই বৈষয়িক পূর্বশর্ত স্থাপনের কাজ ইংরেজ বুর্জোয়ারা না করে পারবে না। তার বেশি কি বুর্জোয়ারা কখনো কিছু করেছে ? রক্ত আর কাদা, দুর্দশা ও দীনতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিবর্গ ও জাতিকে টেনে না নিয়ে বুর্জোয়ারা কি কখনো কোনো অগ্রগতি ঘটিয়েছে?

খাস গ্রেট ব্রিটেনেই যতদিন না শিল্প কারখানার প্রলেতারিয়েত কর্তৃক তার বর্তমান শাসক শ্রেণি স্থানচ্যুত হচ্ছে অথবা হিন্দুরা নিজেরাই ইংরেজদের জোয়াল একেবারে ঝেড়ে ফেলার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী যতদিন না হচ্ছে, ততদিন ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ বুর্জোয়া কর্তৃক ছড়িয়ে দেওয়া এই সব নতুন সমাজ উপাদানের ফল ভারতীয়রা পাবে না। যাই হোক, ন্যূনধিক সুদূর ভবিষ্যতে আশা করতে পারি, দেখবো এই মহান ও চিত্তাকর্ষক দেশটির পুনরুজ্জীবন, সেই দেশ যেখানকার শিষ্ট দেশবাসীরা— প্রিন্স সালতিকভের ভাষায়— এমন কি হীনতম শ্রেণিগুলিও Plus fine et plusadroits que les Italiens, যাদের পরাধীনতাও এক ধরনের শান্ত মহত্ব দ্বারা সহনীয় (Counterbalanced) স্বাভাবিক অনীহা সত্ত্বেও যারা ব্রিটিশ অফিসারদের চমৎকৃত করেছে তাদের সাহস দেখিয়ে, যাদের দেশটা হলো আমাদের ভাষা আমাদের ধর্মের উৎসভূমি, এবং যাদের জাটদের মধ্যে আমরা পাই প্রাচীন জার্মান ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রাচীন গ্রীকদের জাতিরূপ।

উপসংহারে কিছু মন্তব্য না দিয়ে ভারত প্রসঙ্গে ছেদ টানতে পারছি না।

আরো পড়ুন:  মহামতি কার্ল মার্কসের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতি বিষয়ক কয়েকটি উদ্ধৃতি

স্বদেশে যা ভদ্ররূপ নেয় এবং উপনিবেশে গেলেই যা নগ্ন হয়ে আত্মপ্রকাশ করে সেই বুর্জেয়া সভ্যতার প্রগাঢ় কপটতা এবং অঙ্গাঙ্গি বর্বরতা আমাদের সামনে অনাবৃত। ওরা সম্পত্তির সমর্থক, কিন্তু বাংলায়, মাদ্রাজে ও বোম্বাইয়ে যে রকম কৃষি বিপ্লব হলো তেমন কৃষি বিপ্লব কি কোনো বৈপ্লবিক দল কখনো সৃষ্টি করেছে? দস্যুচূড়ামণি স্বয়ং লর্ড কাইভের ভাষায়, ভারতবর্ষে যখন সাধারণ দুর্নীতি ওদের লালসার সঙ্গে তাল রাখতে পারছিলো না, তখন কি ওরা নৃশংস জবরদস্তির পথ নেয়নি? জাতীয় ঋণের অলঙ্ঘনীয় পবিত্রতার কথা নিয়ে ওরা যখন ইউরোপে বাগাড়ম্বর করছে, তখন ভারতে কি তারা রাজাদের ডিভিডেন্ট বাজেয়াপ্ত করেনি— কোম্পানির নিজস্ব তহবিলেই যে রাজারা তাদের ব্যক্তিগত সঞ্চয় ঢেলেছিল? আমাদের “পবিত্র ধর্ম” রক্ষার অছিলায় ওরা যখন ইউরোপে ফরাসী বিপ্লবের বিরুদ্ধে লড়ছিলো তখন একই সময়ে কি তারা ভারতে খৃষ্ট ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ করে দেয়নি, এবং উড়িষ্যা ও বাংলা মন্দিরগুলিতে তীর্থ যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা তোলার জন্যে জগন্নাথের মন্দিরে অনুষ্ঠিত হত্যা ও গণিকাবৃত্তির ব্যবসায় চালায়নি? “সম্পত্তি শৃঙ্খলা, পরিবার ও ধর্মের” পুরোধা হল এরাই।

ইউরোপ সদৃশ বিপুল ১৫ কোটি একর এক ভূখন্ডের দেশ ভারতবর্ষের প্রসঙ্গে দেখলে ব্রিটিশ শিল্পের বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়া সুস্পষ্ট এবং হতভম্ব করার মতো। কিন্তু ভোলা উচিত নয়, বর্তমানে যে ভাবে সমগ্র উৎপাদন সংগঠিত, ও হলো তারই অঙ্গাঙ্গি ফলাফল। এ উৎপাদন দাঁড়িয়ে আছে পুঁজির চূড়ান্ত প্রভুত্বের ওপর। স্বাধীন শক্তি হিসাবে পুঁজির অস্তিত্বের জন্য পুঁজির কেন্দ্রীভবন অপরিহার্য। বর্তমানে প্রতিটি সুসভ্য শহরে অর্থনীতিশাস্ত্রের যে অন্তর্নিহিত অঙ্গাঙ্গি নিয়মগুলি কাজ করছে, বিশ্বের বাজারের ওপর এ কেন্দ্রীভবনের বিধ্বংসী প্রভাব শুধু সেগুলিকে উদঘাটিত করছে বিপুলতম আকারে। ইতিহাসের বুর্জোয়া যুগটার দায়িত্ব নতুন জগতের বৈষয়িক ভিত্তি সৃষ্টি করা— একদিকে মানব জাতির পারস্পরিক নির্ভরতার ওপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বময় যোগাযোগ, এবং সে যোগাযোগের উপায়; অন্যদিকে মানুষের উৎপাদনী শক্তির বিকাশ এবং প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের ওপর বৈজ্ঞানিক আধিপত্যরূপে বৈষয়িক উৎপাদনের রূপান্তর। ভূতাত্ত্বিক বিপ্লবে যেমন পৃথিবীর উপরিতল গঠিত হয়েছে, তেমনি বুর্জোয়া শিল্প ও বাণিজ্য সৃষ্টি হচ্ছে এক নতুন জগতের বৈষয়িক শর্ত। বুর্জোয়া যুগের ফলাফল, বিশ্বের বাজার এবং আধুনিক উৎপাদনী শক্তিকে যখন এক মহান সামাজিক বিপ্লব আত্মস্থ করে নেবে এবং সর্বোচ্চ প্রগতিসম্পন্ন জাতিগুলির জনগণের সাধারণ নিয়ন্ত্রণে সেগুলো টেনে আনবে, কেবল তখনই মানব প্রগতিকে সেই বিকটাকৃতি আদিম দেবমূর্তির মতো দেখাবে না যে নিহতের মাথার খুলিতে ছাড়া সুধা পান করতে চায় না।

(সূত্র: – কার্ল মার্কসের লেখা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল বই থেকে)

2 thoughts on “ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল”

  1. হ্যালো,
    লেখাটি প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ। ভবিষ্যতেও আপনাদের এই চেষ্টা অব্যাহত থাকুক। শুভেচ্ছা সহ!

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!