দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপালে দুই দফায় সাধারণ নির্বাচন শেষ হয়েছে। নেপালের নির্বাচনী বিজয় ঘটেছে সংশোধনবাদী বামপন্থী জোটের। নেপালের এই বাম জোটের জেতার পেছেন চীনের যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি আছে ভারতের শোষণমূলক ভূমিকা। নেপালে ভারতবিরোধী মনোভাব বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপালের জনগণ সবচেয়ে বেশি শোষিত হয়েছে, এবং এই শোষণ চালিয়েছে ভারতের সম্প্রসারণবাদ। নেপালকে ভারত এই পরিমাণে শোষণ করেছে যে নেপালী জনগণের গড় উচ্চতা অন্তত ভারতীয়দের চেয়ে দুই ইঞ্চি কমে গেছে।
নেপালের অর্থনীতিকে বলা যায়, আধা-সামন্তবাদী। রাজতন্ত্র উৎখাতের পর এবং গ্রামীণ সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা কিছু ক্ষেত্রে উৎখাতের পর নেপালে গণতন্ত্রের দিকে বিকাশ অবশ্যই এগিয়েছে। কিন্তু এই গণতন্ত্র ব্যর্থ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও বিস্তারবাদের কারণে। নেপালে খুব দ্রুত সাম্রাজ্যবাদনির্ভর ক্ষুদে মালিকানার বিকাশ ঘটছে। পুষ্প কমল দহলের সংশোধনবাদে নিমজ্জিত হবার জন্য যাদেরকে দায়ি করা হয়, তার ভেতরে একটি হচ্ছে এনজিওর প্রভাব বৃদ্ধি।
ক্ষুদে মালিকানা, সাম্রাজ্যবাদ নির্ভরতা, এবং বিস্তারবাদী আধিপত্যের কারণে নেপাল একেবারেই বাংলাদেশের মতো পরনির্ভর একটি দেশে পরিণত হতে চলেছে। নেপালের অর্থনীতি দুর্বল বিধায় সেখানে রাজনীতি শক্তিশালী, বিষয়টি এমন নয়, নেপালের জনগণের লড়াইয়ের গত আড়াইশ বছরের ইতিহাস তাঁদেরকে লড়াকু হিসেবে গড়ে তুলেছে। যারা জগদীশ চন্দ্র বসুর “অব্যক্ত” বইটি পড়েছেন তারা অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে নেপালী জনগণের ব্রিটিশবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস দেখে থাকবেন। নেপালের জনগণ চিন্তায় এখন বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে অনেক অগ্রগামি। তদুপরি নেপাল গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দিকে সহজে এগোতে পারবে না।
নেপালে মূলত যে পরিবর্তন হচ্ছে তা ক্ষুদে মালিকানা ও মুৎসুদ্দি পুঁজির বিকাশ। এইটা জনগণের জন্য মোটেই ভালো নয়, গোটা দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ এটা করছে একটা সুবিধাভোগী মধ্যশ্রেণি তৈরি করে। সাম্রাজ্যবাদের যুগে মুৎসুদ্দি পুঁজির বিকাশ মানেই প্রতিক্রিয়াশীলতা, যা সাম্রাজ্যবাদকে শক্তিশালী করে, ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণি যে সুবিধাবাদী হয়েছে তা এই মুৎসুদ্দি পুঁজি থেকে বা পুঁজির নিপীড়িত দেশগুলোতে রপ্তানি থেকে শোষণের ছিটেফোটা ভাগ তারা পায় বলেই।
এই ক্ষুদে মালিকানা থেকেই ইউরোপে সুবিধাবাদ এসেছিল, লেনিন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সেইসব দালালকে চাবুক মেরেছিলেন। এখন যে ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণি নির্বোধ হয়ে গেছে, তা তো এই সুবিধাবাদের পাপের ফল। কিছু ক্ষুদে মালিকের অগ্রগতিকে সব জনগণের অগ্রগতি হিসেবে দেখা কি মার্কসবাদ বিরোধিতার চূড়ান্ত প্রকাশ নয়?
যে কোনো দেশ অন্তত নেপালের আয়তনের সমান একটি দেশ অবশ্যই স্বাধীনভাবে চলতে পারবে। নেপালে কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন খুব সম্ভব, যেমন এটি সম্ভব বাংলাদেশেও। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারত কোনোদিনই বিনা যুদ্ধে তা হতে দেবে না।
আমরা অনেকেই ভেবে থাকি নেপাল অন্য দেশের উপর নির্ভরশীলতা ছাড়া চলতে পারবে না। সেদেশে খাদ্যাভাব দেখা দেবে, কিন্তু বাস্তবে এই কথার ভিত্তি খুব একটা নেই। বরং বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষে পতিত হবে, কিন্তু নেপাল হবে না, নেপালের ভূপ্রকৃতি আলাদা। নেপালে ১৯৪৩-এও দুর্ভিক্ষ হয়নি। নেপালের আড়াই কোটি লোক ভুট্টা এবং ধান দিয়ে চালিয়ে নিতে পারবে। নেপালিরা বাংলাদেশের মতো গণহারে হাইব্রিড বীজকে গ্রহণ করেনি। নেপালিরা শুধু খুব লড়াকু ও পরিশ্রমীই নয়, বরং তারা স্বাধীনতার বিষয়ে সচেতনও এবং তারা চিন্তা চেতনায় প্রগতিশীলতার বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহালও। তারা কোনো বিষয়েই বাঙালির মতো অন্যের আধিপত্য মেনে নেয় না, কথা বলার সময় তারা অন্য দেশের মানুষের কথায় সায় দিলেও কাজ করে নিজেদের মতামত অনুসারে। ভারত এবং চীনের মাঝখানে স্যান্ডউইচ হয়ে টিকে থাকতে তাঁদের চরিত্রে এইরকম একটি বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটেছে।
নেপালের নির্বাচনে সংশোধনবাদী বামপন্থীদের বিজয়কে উৎসাহের সাথে উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশের মার্কসবাদ-লেনিনবাদবিরোধী খ্রুশ্চেভপন্থী সুবিধাবাদীরা, মূলত সমাজগণতন্ত্রী সিপিবি এবং বাসদ। এই মার্কসবাদ-লেনিনবাদবিরোধী সংগঠন দুটি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে না, দেশকে স্বনির্ভরতার বিরোধীতা করে, মুৎসুদ্দি পুঁজির সুবিধা নেয়, ক্ষুদে মালিকানার পক্ষে লড়াই জারি রাখে এবং জাতীয় পুঁজি এবং মুৎসুদ্দি পুঁজির পার্থক্য গুলিয়ে দেয়।
সমাজতন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদের পার্থক্যটা হচ্ছে সমাজতন্ত্রে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সহযোগিতা থাকে, শোষণ থাকে না। যে কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশ অন্য সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে প্রযুক্তি সহায়তা বিনা মূল্যে মুনাফা ছাড়াই পায়, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ দেয় মুনাফার বিনিময়ে। সমাজতন্ত্রে শোষণ এবং বেতন ও মজুরির পার্থক্য থাকে না। এসব মার্কসবাদী আলাপের অআকখ না উল্লেখ করেই এইসব সুবিধাবাদীরা বলতে শুরু করেছে নেপাল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে গেছে।
নেপালে সংশোধনবাদের নির্বাচনী বিজয় হচ্ছে প্রগতির উলটো দিকে যাত্রা। চীন এবং বর্তমান রাশিয়ার উন্নতি কি আদৌ প্রগতি? কিংবা ইউরোপ আমেরিকার উন্নতি? নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন কি প্রগতি? লেনিন “রাষ্ট্র ও বিপ্লব” বইয়ে কী এসব কথা লিখেছেন? নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হচ্ছে নিখাদ প্রতিক্রিয়াশীলতা, প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের বিরোধী।
অন্য দেশকে শোষণ করে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হওয়া তো পরাধীনতা। নেপালকে এতোদিন শোষণ করত ভারত, এবার চীন তাতে ভাগ বসাচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে মুৎসুদ্দি ফড়িয়া আর মধ্যস্বত্বভোগীরা নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি, সিপিএন (এমালে) এবং শ্রমিক শ্রেণির বিশ্বাসঘাতক প্রচন্ডকে ক্ষমতায় এনেছে। নেপালের এই দল দুটি হচ্ছে সেই ক্ষুদে ব্যক্তিগত মালিকানার সমর্থক। আর সেরকমই ক্ষুদে মালিকানার যন্ত্রণায় বাংলাদেশের শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণি আজ দিশেহারা। বাংলাদেশে ক্ষুদে মালিকানার যেসব ব্যাধি এখন প্রকট হয়েছে, নেপালে আগামি দশ-পনের বছরে তার সবগুলো লক্ষণই খুব নোংরাভাবে দেখা যাবে।
কমিউনিস্টরা কেন ক্ষুদে মালিকানার বিরোধী, কারণ তা প্রতিনিয়ত কিছু বড় মালিক তৈরি করে। বাংলাদেশে গত ৫ দশকের লুটের ফলে যে হাজার পঞ্চাশেক কোটিপতি পাচ্ছি তা তো এই ক্ষুদে মালিকানার থেকেই উদ্ভূত। এই কোটিপতিরা তো দেশের জনগণকে শোষণ এবং ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ভারত চীনের দালালী করেই এই টাকার মালিক হয়েছে।
সমাধান কি ছিলো বা আছে? সমাধান আছে মার্কসবাদে। মানুষ সৃজনশীল প্রানী, যে দেশে যে অবস্থায় প্রলেতারিয়েত আছে, তা সংখ্যায় যত ক্ষুদ্রই হোক, সহযোগীদের নিয়ে সেখানে সে অবস্থাতেই তাঁদের একনায়কত্ব কায়েম করতে হবে। এটা সৃজনশীলভাবেই করতে হয়েছে লেনিন ও মাওকে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের দ্বারা পুঁজির বিকাশ মানেই শোষণ, কমিউনিস্টরা সেটাকে সব উপায়েই বিরোধীতা করবে, এটা না করাই হচ্ছে সুবিধাবাদ।
যখন কোনো একটি দেশ নিজস্ব সম্পদের উপর ভিত্তি করে পুঁজির বিকাশ ঘটায়, তখন সেটা জাতীয় পুঁজি, যা মুৎসুদ্দি পুঁজির বা দালাল পুঁজির বিরোধী। এই দ্বন্দ্বটিকে কাজে লাগিয়ে মাও সেতুং পুঁজিপতিদের বিভক্ত করেছিলেন।
পুঁজির নিয়মই হচ্ছে তা শোষণের মাধ্যমে বড় হবে। এই নিয়ম সমাজতন্ত্রে বদলে যাবে কীভাবে? কারণ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো অন্য দেশকে শোষণ করবে না, অন্য নিপীড়িত দেশগুলোকে মুক্ত করবে কলকারখানা গড়ে দিয়ে। সাম্রাজ্যবাদ করে উল্টোটা, তারা শুধু মুনাফা করে। দেশগুলোর বৈচিত্র্যের কারণে একেক দেশে একেক ভাবে কলকারখানা বাড়বে। পুঁজির বৃদ্ধি প্রগতিশীলতা নয়, পুঁজির বিকাশকেই প্রগতি ভাবা চলে না সাম্রাজ্যবাদের যুগে, কেননা সাম্রাজ্যবাদ এখন সামন্তবাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদীরা পুঁজির বিকাশকেই প্রগতি বলছিলও, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে অনিচ্ছুক ছিলো। তাদের যুক্তি ছিলো রাশিয়ার মতো একটি পশ্চাৎপদ দেশে ক্ষমতা দখল ঠিক হয়নি। ফলে ক্ষমতা পুনরায় বুর্জোয়াদের কাছে ছেড়ে দিতে হবে।
সাম্রাজ্যবাদ যখন সরাসরি যুদ্ধ না করে পুঁজিটা রপ্তানী করে, সেটাও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিই। উপনিবেশবাদ-সাম্রাজ্যবাদ নিপীড়িত দেশগুলার নিজ কাচামাল নির্ভর কারখানা গড়ে উঠাটার বিরোধীতা করে। জাতীয় পুঁজি সেটা চায় না। মুৎসুদ্দি এবং জাতীয় পুঁজির দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে হবে, বিপ্লবের আগে ও পরে, দুই সময়েই।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।