সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে কিউবা এবং ফিদেল ক্যাস্ত্রোর প্রভাব প্রসঙ্গে

কিউবা (ইংরেজি: Cuba ) বর্তমান পৃথিবীর একটি অন্যতম সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশ এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন কিউবার সাফল্য দ্বারা বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত। লাতিন আমেরিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন দঢ়করণের পক্ষে ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, জনগণের শ্রীবৃদ্ধি, শান্তি ও সমাজতন্ত্রের জন্য লাতিন আমেরিকা’ ঘােষণাপত্রটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৫ সালে হাভানায় অনুষ্ঠিত লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দেশগুলির কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে এটি সর্বসম্মতিক্রমে গহীত হয়েছিল। এই কর্মসূচিমূলক দলিলে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে সমাজতন্ত্রই লাতিন আমেরিকায় সত্যিকার উন্নয়ন নিশ্চায়ক সমাজব্যবস্থা।[১]

দীর্ঘকাল কিউবা ছিলো সাম্রাজ্যবাদী স্পেন দ্বারা নিপীড়িত একটি ক্ষুদ্র দেশ। ১৮৬৮ সালের স্পেনের বিরুদ্ধে কিউবার বিদ্রোহ দশ বৎসর কাল স্থায়ী হলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৮৯৫ সালে কিউবায় আবার বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধে স্পেন পরাজিত হয় এবং কিউবা স্বাধীনতা লাভ করলেও কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ ও কর্তৃত্বই সেখানে স্থাপিত হয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমুহের তুলনায় কিউবার অর্থনৈতিক অবস্থা তখন ভালো থাকলেও জাতীয় স্বাধীনতা কিউবার কাছে প্রায় অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।[২]

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পরে ১৯৪০ সালে বাতিস্তা (Fugencio Batista) কিউবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন, কিন্তু পরে ১৯৫২ সালে তিনি নিজেকে কিউবার স্থায়ী শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। দারিদ্র্য, অসাম্য, দুর্নীতি এবং স্বৈরতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত বাতিস্তার শাসনের বিরুদ্ধে ফিদেল ক্যাস্ত্রো (Fidel Castro)-র নেতৃত্বে কিউবাতে এক আন্দোলন গড়ে উঠে। কিউবার নির্যাতিত বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাতিস্তার শাসনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ক্যাস্ত্রোর আন্দোলনকে সমর্থন করতে থাকে। ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে বাতিস্তা সরকারের সেনাদল হঠাৎ আক্রান্ত হয়, কিন্তু এই আক্রমণ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হলো। ১৮ মাস কারাবাসের পরে ক্যাস্ত্রো মেক্সিকো থেকে দ্বিতীয় আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন, কিন্তু ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরের আক্রমণও ব্যর্থ হয়। তখন এই হঠাৎ আক্রমণের নীতি পরিত্যাগ করে ক্যাস্ত্রো বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে পার্বত্য অঞ্চল থেকে গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করেন। গেরিলা যুদ্ধে বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৫৯ সালের পয়লা জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট বাতিস্তা কিউবা পরিত্যাগ করে চলে যান এবং তখন ক্যাস্ত্রো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

আরো পড়ুন:  Che, the blood smeared light

ক্যাস্ত্রো ক্ষমতায় এসে কিউবার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। প্রধানত চিনি রপ্তানী করেই কিউবাকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে হতো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ছিলো এই চিনির প্রধান ক্রেতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর এই নির্ভরতা দূর করার জন্যে ক্যাস্ত্রো এবং চে গ্যেভারা চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নে চিনি রপ্তানী করার ব্যবস্থা করেন। প্রায় সমস্ত সাম্যবাদ অভিমুখী দেশের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন করে ক্যাস্ত্রো অল্প সময়ের মধ্যেই সমাজতান্ত্রিক জগতের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশ থেকে ক্যাস্ত্রো আর্থিক সাহায্য এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করেন এবং ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, হাইতি, নিকারাগুয়া, ভেনেজুয়েলা প্রভৃতি দেশের মার্কিন বিরোধী বৈপ্লবিক আন্দোলনকেও উৎসাহিত করতে থাকেন। কিউবার অর্থনীতি থেকে মার্কিন প্রভাব দূর করার জন্য মার্কিন পুঁজিতে পরিচালিত সমস্ত কোম্পানী ও প্রতিষ্ঠানগুলির উপর—যেমন কিউবার টেলিফোন কোম্পানী, তৈল শোধনাগার, চিনি শোধনাগার, ব্যাংক, হোটেল ইত্যাদিতে সরকারি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬১ সালের জানুয়ারী মাসে কিউবা হাভানাতে মার্কিন দূতাবাসের কর্মীর সংখ্যা এগারোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য দাবী জানায়। ফলে মার্কিন সরকার কিউবার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। কিউবার সাথে ব্যবসায় বাণিজ্যও মার্কিন সরকারের নির্দেশে ইতিমধ্যে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার (Eisenhower) তখন কিউবার ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে ল্যাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের সাথে একত্র হয়ে সম্মিলিত ভাবে ক্যাস্ত্রো সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাই কিউবা সমস্যা আলোচনার জন্য ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে কোস্টারিকার সেন জোস (San Jose, Costa Rica)-এ আন্তঃ আমেরিকান পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের এক সম্মেলন আহ্বান করা হয়। এই সম্মেলনে পশ্চিম গোলার্ধে বৈদেশিক হস্তক্ষেপের নিন্দা করলেও কিউবার বিরদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া অনুমোদন করে না। অগত্যা মার্কিন সরকার একাই কিউবার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার প্রস্তুতি আরম্ভ করে।

আরো পড়ুন:  ফিদেলের জন্য গান --- চে গ্যেভারা

ফ্লোরিডা এবং গুয়েতেমালাতে ক্যাস্ত্রোবিরোধী কিছু রাজনৈতিক নেতা ও শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং আইসেনহাওয়ার সরকার সিআইে-এর তত্ত্ববধানে তাদের স্যমরিক শিক্ষা দিয়ে কিউবা আক্রমণ করার ব্যবস্থা করে। মার্কিন সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৬১ সালের ১৪-১৫ এপ্রিলের মধ্যরাত্রে প্রায় দেড় হাজার লোক কিউবার Bay of Pigs-এ অবতরণ করে। নিকারাগুয়া থেকে বিমান বাহিনী তাদের সাহায্য করে কিন্তু এই আক্রমণ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই কিউবা সরকার বহু বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করে কিউবা থেকে বিরোধী পক্ষকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়। কিউবা সরকারের এই সাফল্যের ফলে সমস্ত ল্যাতিন আমেরিকাতে ক্যাস্ত্রোর মর্যাদা অনেকখানি বৃদ্ধি পায়। এই আক্রমণ যখন ঘটে তখন কেনেডী ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

ক্যাস্ত্রোর ভয় ছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় কিউবা আবার আক্রান্ত হতে পারে এবং তাই দেশকে সুরক্ষিত করার জন্য তিনি সোভিয়েতের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। ক্রুশ্চেভ সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে কিউবাতে পারমাণবিক অস্ত্র প্রেরণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডী সরকার প্রবল আপত্তি জানায় এবং মার্কিন-সোভিয়েত সম্পর্কের মধ্যে এক দারুণ সঙ্কট দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত কিউবাকে আর আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দিলে ক্রুশ্চেভ কিউবা থেকে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে নিতে রাজী হন।

কিউবাই পশ্চিম গোলার্ধের প্রথম সমাজতন্ত্র অভিমুখী রাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এতো কাছাকাছি একটি সমাজতন্ত্র অভিমুখী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী দলের নেতা হিসেবে ক্যাস্ট্রো কিউবাতে আন্দোলন আরম্ভ করেন নি বা ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হন নি। কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। জনসাধারণের উপর সেই পাটির প্রভাবও ছিল খুব সীমিত। ক্যাস্ত্রো নিজের চেষ্টায় স্বাধীন ভাবে আন্দোলন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে স্পষ্টভাবে নিজেকে মার্কসবাদী বলে ঘোষণা করেন। এর পূর্বে তিনি যে মার্কসবাদে বিশ্বাসী তাও প্রচারিত হয় নি। অবশ্য তিনি সমাজতান্ত্রিক জগতের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করে কিউবার বৈদেশিক রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতিকে গড়ে তোলেন। জীবিতকালে তিনিই ছিলেন কিউবার সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা। বর্তমানে তাঁর ভাই রাউল ক্যস্ত্রো কিউবার আন্দোলন ও রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন।

আরো পড়ুন:  আমেরিকার দর্শন চিন্তাধারা প্রসঙ্গে

তথ্যসূত্র:

১. কনস্তানতিন স্পিদচেঙ্কো, অনুবাদ: দ্বিজেন শর্মা: বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূগোল, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, বাংলা অনুবাদ ১৯৮২, পৃ: ১২৩।
২. গৌরীপদ ভট্টাচার্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ ডিসেম্বর ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৩৬০-৩৬২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!