নিকারাগুয়া মধ্য আমেরিকার একটি ক্ষুদ্র দেশ হলেও এখানে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মত নিকারাগুয়াও স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা নিপীড়িত দেশ ছিল এবং ১৮২১ সালে নিকারাগুয়া জাতীয় স্বাধীনতা লাভ করে। জাতীয় স্বাধীনতা লাভ করলেও নিকারাগুয়ার অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয় এবং দেশের রেলওয়ে, ব্যাংক, খনিজ সম্পদ সব কিছুই মার্কিন পুঁজি ও মার্কিন কোম্পানী দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে।
নিকারাগুয়ার তথাকথিত স্বাধীন সরকার ও সেনাবাহিনীও মার্কিন সরকারের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে এবং মার্কিন সৈন্যও নিকারাগুয়াতে অবস্থান করতে থাকে। এই অবস্থার বিরদ্ধে ১৯২৬ সালে নিকারাগুয়াতে এক বিদ্রোহ আরম্ভ হয়। এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন নিকারাগুয়া দেশেরই এক সেনানায়ক—জেনারেল সিজার অগাস্টো স্যাণ্ডিনো (General Cesar Augusto Sandino)। দেশে মার্কিন প্রভাবের বিরুদ্ধে তিনি ৬ বৎসর ধরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে চলেন এবং সমস্ত ল্যাতিন আমেরিকাতেই তার প্রভাব বিস্তার লাভ করে।
পরবর্তীকালে রুজভেল্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হলে মার্কিন সৈন্য নিকারাগুয়া থেকে চলে যায় এবং স্যাণ্ডিনো তাঁর গেরিলা যুদ্ধ বন্ধ করেন। কিন্তু মার্কিন সৈন্য চলে গেলেও নিকারাগুয়া সরকার ও তার সেনাবাহিনীর অনেকেই ছিলেন মার্কিন সরকারের প্রভাবাধীন এবং নিকারাগুয়ার ন্যাশনাল গার্ডের সেনাধ্যক্ষ এনাস্টাসিও সোমোজা (Anastasio Somaza) ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এই ন্যাশনাল গার্ডের চক্রান্তে ১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্যাণ্ডিনো নিহত হন। ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে সোমোজো দেশের প্রেসিডেন্ট পদ লাভ করেন এবং পরে তাঁর দুই পত্র পর পর নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। এই সোমোজাদের শাসনকালে স্যাণ্ডিনোর দলভুক্ত লোকজনের উপর অকথ্য অত্যাচার চলে এবং তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় নিকারাগুয়াতে এক ধরনের ত্রাসের রাজত্ব স্থাপিত হয়।
এই অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য ১৯৬২ সালের জুলাই মাসে বামপন্থী গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী মতাদর্শে আস্থাশীল Sandinist Front of National Liberation (FSLN) গড়ে উঠে। স্বভাবতই এই ফ্রণ্ট ছিল নিকারাগুয়াতে মার্কিন প্রভুত্বের চরম বিরোধী এবং এই ফ্রন্টের অনেকেই সমাজতন্ত্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে আকৃষ্ট হয়। কমিউনিস্টদের প্রভাবও ফ্রন্টে যথেষ্ট ছিল। কিউবার বিপ্লব এবং ভিয়েতনামের যুদ্ধ দ্বারাও এই ফ্রন্টের নেতৃবন্দ বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়।
১৯৭৪ সালে নিকারাগুয়ায় গণতন্ত্র ভাবাপন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি দ্বারা Democratic Liberation Union নামে আর একটি সংগঠন স্থাপিত হয়। এই সংগঠনের মধ্যে কমিউনিস্টদের কোনো প্রভাব ছিল না, কিন্তু নিকারাগুয়ার শাসকগোষ্ঠী এই সংগঠনের সাথেও কোনোরকম বোঝাপড়ায় আসতে রাজী হয় না। গেরিলা যুদ্ধ, ছাত্র আন্দোলন এবং দেশব্যাপী বিক্ষোভের বিরুদ্ধে সোমোজা সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় নিজের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করে এবং ১৯৭৫ সালে নিকারাগুয়াতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আন্দোলন সমান ভাবেই চলতে থাকে এবং সশস্ত্র সংগ্রাম ও সাবিক ধর্মঘটে দেশে অচলাবস্থা দেখা দেয়। ১৯৭৯ সালে সোমোজা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন এবং FSLN পাল্টা এক অস্থায়ী সরকার গঠন করে তোলে। প্রথমে কোস্টারিকা (Costa Rica)-তে এই সরকার স্থাপন করা হয় এবং ১৯৭৯ সালের ১৯ জুলাই এই সরকারের সদস্যগণ নিকারাগুয়ার রাজধানী মানাগুয়াতে এসে দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। কিউবা প্রথম এই নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং অল্প পরেই এই সরকার সোভিয়েতের স্বীকৃতি লাভ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বভাবতই এই সরকার সম্বন্ধে বিরূপ মনোভাব গ্রহণ করে এবং অর্থনৈতিক সমস্ত সাহায্য বন্ধ করে দিয়ে এবং এই নতুন সরকারের বিরোধী পক্ষকে নানাভাবে সাহায্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিকারাগুয়ায় ১৯৭৯ সালের বিপ্লবকে বিনষ্ট করতে এখন বদ্ধপরিকর।
FSLN-এর নেতৃত্বে গঠিত নিকারাগুয়ার এই নতুন সরকার গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার প্রস্তুতিপর্ব সেখানে আরম্ভ করেছিল। ১৯৮৪ সালের নিকারাগুয়ান সাধারণ নির্বাচনে, যা মুক্ত এবং ন্যায্য ছিল গণ্য করা হয়েছিল, সান্ডানিস্তারা সংসদীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং তার নেতা ড্যানিয়েল অরতেগা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জয়ী হন। ১৯৯০ সালে সান্দানিস্তারা মার্কিন ষড়যন্ত্রে পরাজিত হয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নরপিশাচ প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান প্রশাসন কন্ট্রা বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে নিকারাগুয়ার বিপ্লবকে ধুলিস্মাত করে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয় এবং লক্ষ লক্ষ নিকারাগুয়াবাসীকে হত্যা করে।
তথ্যসূত্র:
১. গৌরীপদ ভট্টাচার্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ ডিসেম্বর ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৩৬২-৩৬৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।