বাঁশের কাজ (ইংরেজি: Bambooworking) হচ্ছে বাঁশ থেকে স্বতন্ত্র বস্তু তৈরি করার ক্রিয়াকলাপ বা দক্ষতা এবং এতে স্থাপত্যকর্ম, কাঠের কাজ, আসবাব এবং ক্ষুদ্র কক্ষের কাজ, খোদাই, জোড়ের কাজ ও বয়ন অন্তর্ভুক্ত। এশিয়াতে ঐতিহাসিক কাল থেকে সহস্রাব্দ জুড়ে এটির শিকড় সংস্কৃতি ও সভ্যতায় বিস্তৃত রয়েছে।
কাঠ, পাথর, বালু, কাদামাটি এবং পশুর অংশগুলির পাশাপাশি বাঁশ ছিল প্রথম দিকের মানুষদের দ্বারা তৈরি প্রথম উপকরণগুলির মধ্যে একটি। সভ্যতার বিকাশ ঘনিষ্ঠভাবে বাঁশের উপকরণগুলিতে দক্ষতার বৃহত্তর মাত্রা বিকাশের সাথে জড়িত ছিল। কাঠের কাজ করার মতোই বাঁশ মূলত বাঁশের নির্মাণ, বাঁশের টেক্সটাইল, বাঁশ এবং কাঠের স্লিপ, বাঁশের বাদ্যযন্ত্র, বাঁশের বুনন এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল।
কান্ড শক্তিশালী হওয়ায় এটি বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে যেমন ঘরবাড়ির কাঠামো তৈরিতে কাজে দেয়। এছাড়া বাগানে লতানো সবজির জন্য টাল বা মাচা তৈরিতে কাজে লাগে। আমাদের গ্রাম বাংলার আর্দ্র আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে বাঁশ অধিক উপযোগী, এটি পানি প্রতিরোধী একটা টিম্বার যা অতি আর্দ্রতায়ও সহজে পচন ধরেনা বা বাঁকা হয়ে যায় না। এ কারণে মাছ ধরার বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে এটা বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় মাছ ধরার ফাঁদ বা বৈচ্না, চাঁই, টেটা, খারি প্রভৃতি।
রান্নাঘরেও রয়েছে বাঁশের পরশ, বাঁশ কঞ্চি এবং এর পাতা জ্বালানির কাজ করে। রাধুনীকে পোড়া বাঁশীর শব্দ দিয়ে দিনদুপুরে উতলা করা ছাড়াও রয়েছে বাঁশের আরো ভূমিকা৷ তাই বাঁশি শুনে আর কাজ নেই। করিমন মনের সুখ দুঃখ এক করে চুলা ধরায়ে বাঁশে ফু দিয়ে, তাতে মধুর রোমাঞ্চকর সূর না বেরুলেও মোটেও ভাববেন না তা ফাটা বাঁশ, এবং উনুন জ্বললে পেটে ভাত পরবে মানুষের পেটের চুঁচুঁ শব্দ শান্ত হবে এতে। চালন, কূলা, ডুলা পাতি, বাঁশের শেলফ ইত্যাদি যেদিকে হাত দিবেন শুধু বাঁশ আর বাঁশ। চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশেও অনুরূপ। আমার সবাই বাঁশের প্রতি প্রীতিতে একাত্ব।
বাঁশের টিম্বারটা আঁশ প্রযুক্ত হওয়ায় এর যথেষ্ট নমনীয়তা আর প্রসারণশক্তি আছে যার দরুণ এটা সহজে ভাঙে না আর পূর্ণবয়স্ক হলে সহজে ফাটেও না। একে ইচ্ছেমতো বাকিয়ে পচ্ছন্দসই কাঠামো দেওয়া যায়। শহুরে জীবনেও বাঁশের আসবাবপত্রের ছোঁয়া রয়েছে।
বাঁশের যোজিত দ্রব্য
বাঁশ থেকে তৈরি প্লাইবোর্ড, পার্টিকেল বোর্ড, সিমেন্ট বন্ডেড পার্টিকেল বোর্ড ইত্যাদি হচ্ছে বাঁশের যোজিত দ্রব্য (ইংরেজি: Composite products)। বাঁশের যোজিত দ্রব্য তৈরীর ফলে একদিকে যেমন গুণগত মানের উন্নয়ন সাধিত হয় অন্যদিকে ফেলনা অংশ ব্যবহার করে মূল্য সংযোজিত দ্রব্য তৈরির ফলে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হয়।
বাঁশের প্লাই বোর্ড
পূরু দেয়াল বিশিষ্ট বাঁশের (বাঁইজ্যা/বোরাক ইত্যাদি) প্রসেস করা ফালি আঠা লাগিয়ে চাপ দিয়ে বাঁশের প্লাইবোর্ড তৈরি করা হয়। এই প্লাইবোর্ড টাইলস, ফার্নিচারের অংশ হিসাবে এবং বিভিন্ন প্যানেল তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।
বাঁশের প্লাই বোর্ড প্রস্তুতের কৌশল
১. নির্দিষ্ট মাপের বাঁশের টুকরাকে ৪/৬ ফালি করে বুক ও পিঠের দিকে সমান করে শুকানো হয়।
২. শুকনো বাঁশের ফালিগুলো প্ল্যানার মেশিন দিয়ে একই পুরুত্বে মসৃন করা হয়।
৩. সাইজকৃত ফালি এমনভাবে শুকাতে হবে যেন জলীয় অংশ শতকরা ২০ ভাগের বেশি না থাকে, তারপর ১০% বোরাক্স-বোরিক এসিডের সংরক্ষণী দ্রবনে তিন দিন চুবিয়ে নিতে হবে।
৪. সংরক্ষণী দ্রবনে চুবানোর পর ৮-১০% জলীয় অংশে শুকিয়ে, ইউরিয়া ফরমাল্ডিহাইড গ্ল ব্যবহার করে চাপ প্রয়োগে বিভিন্ন স্তর বিশিষ্ট বাঁশের প্লাইবোর্ড তৈরি করা হয়।
বাঁশের প্লাই বোর্ড তৈরিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি
ক. কোল্ড বা হট প্রেস/ক্লোপ
খ. সার্কুলার স
গ. প্ল্যানার মেশিন।
বাঁশের প্লাই বোর্ড এর ব্যবহারে সুবিধা।
১. বাঁশের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করে
২. রপ্তানী যোগ্য পণ্য তৈরি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
৩. শিল্প কারখানা স্থাপনের ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।
৪. কাঠের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
বাঁশের পার্টিকেল বোর্ড
বাঁশের বিভিন্ন পণ্য তৈরির পর প্রাপ্ত প্রান্তিক ফেলনা ও অব্যবহৃত অংশ দ্বারা পার্টিকেল বোর্ড তৈরি করা হয়। কাঠের বিকল্প হিসাবে আসবাবপত্রের অংশ, ঘরের পার্টিশন এবং সিলিং তৈরিতে ইহা ব্যবহার করা যায়। বোর্ডের উপরে বাঁশের চাটাইয়ের আচ্ছাদন ব্যবহার করলে বোর্ড মজবুত হয় এবং আকর্ষণীয় দেখায়।
বাঁশের পার্টিকেল বোর্ড উৎপাদনের কৌশল
১. বাঁশের কুঁচি এমনভাবে শুকাতে হবে যেন জলীয় অংশ শতকরা ৪-৬ ভাগ থাকে, এরপর মিহি অংশ ছাকুনি দ্বারা আলাদা করা হয়।
২. গ্লু মিক্সচার মেশিনে ৪-৫% আদ্রতা বিশিষ্ট কুঁচির সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ তরল ইউরিয়া ফরমাল্ডিহাইড গ্লু মিশানো হয়।
৩. হট প্রেসে নিদিষ্ট তাপে ও চাপে পার্টিকেল বোর্ড তৈরি করা হয়।
বাঁশের পার্টিকেল বোর্ড তৈরিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি
ক হ্যামার মিল
খ. হট প্রেস
গ. সার্কুলার ‘স
ঘ. গ্লু মিক্সার মেশিন।
বাঁশের পার্টিকেল বাের্ডের উৎপাদন ও ব্যবহারে সুবিধা
১ অব্যবহৃত বনজ সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করে
২. নারী জনগোষ্ঠীকে কর্মে সম্পৃক্ত করে দারিদ্র বিমোচনে সহায়ক হয়
৩. শিল্প কারখানা স্থাপনের ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি সম্ভব।
৪. নিরেট কাঠের উপর চাপ কমবে
বাঁশের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের বনজ সম্পদের চাহিদা পূরণ ছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণ করা যায়। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শের মাধ্যমে বাঁশের কম্পোজিট প্রোডাক্টস তৈরিতে শিল্প উদ্যোক্তাগণ উৎসাহিত হবে বলে আশা করা যায়। বাঁশের কম্পোজিট প্রোডাক্টস তৈরির মাধ্যমে ব্যক্তি ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। এ ব্যপারে শিল্প উদ্যেক্তাদের সক্রিয় উদ্যোগ অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।