জ্বর সারানোর কার্যকরি ১৬টি ভেষজ চিকিৎসা

জ্বর  (ইংরেজি: Fever) হচ্ছে শারীরিক অসুস্থতার অন্যতম প্রধান লক্ষ্মণ, যা শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার পার্থক্য ঘটায়। জ্বরের সময় শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি সত্ত্বেও সাধারণত ঠান্ডা অনুভূত হয়। অনেক কারণে জ্বর হতে পারে এজন্য খেয়াল রাখতে হবে জ্বরের সাথে অন্য কোনো অসুখ হয়েছে কি না বা জ্বর অন্য কোনো রোগের সংকেত কিনা। এখানে কিছু ভেষজ চিকিৎসার নিয়ম উল্লেখ করা হয়েছে জ্বরের লক্ষণ দেখে যেগুলোর প্রয়োগ আবশ্যক।

১. নতুন জ্বর হয়েছে এমনটি হলে কিসমিস লবণজলে ভিজিয়ে সেই কিসমিস কয়েকটি করে খেলে জ্বর চলে যায়।

২. নতুন জ্বরকে চাপা দিয়ে ছাড়ানো হলো, কিন্তু অগ্মিবল রক্তে ফিরে গেল না, ঢিসঢিসে শরীর, মুখেও কিছু ভাল লাগে না, তার সঙ্গে যা তা খেয়েই চলেছে, আবার দেখা যাচ্ছে বিকালের দিকে শরীরটায় একটু উত্তাপ, কোনো দিন একটু ভালো কোনো দিন মন্দ এই ভালো মন্দটা কিন্তু অগ্মিমান্দ্যের জন্য হয়। এই করে রক্তের অগ্নিবল নষ্ট হয়ে যায় যাকে বলা যায় রক্তের মেটাবলিজিম হ্রাস পেয়ে যাওয়া, এক্ষেত্রে কুড়চি ছাল চূর্ণ ১ গ্রাম ও তার বীজ ইন্দ্রযব চূর্ণ ১ গ্রাম, এই দুটি একসঙ্গে সকালে ও বিকালে দুবার জল দিয়ে খেতে দিতে হয়। আরও আশ্চর্য ফল পাওয়া যায় যদি শিউলি পাতার (Nyctanthes arbortristis.) রস ৪ চা চামচ একটু গরম করে ওর সঙ্গে একবেলা বা দুবেলা মিশিয়ে খাওয়া যায়; যদি নিতান্ত দুবেলা না হয়, একবেলা খেলেও চলে। অনেক সময় এইসব ক্ষেত্রে মুখে অরুচিও হয়, সেক্ষেত্রে মুখ ছাড় হিসেবে একটি ফুলুরির কথা বলি শিউলির পাতা ও কাঁচা মুগের ডাল একসঙ্গে বেটে বড়া করে খেলে মুখের রুচি ফিরে আসবে।

৩. পুরাতন বা জীর্ণ জ্বর হয়েছে দেখলে গুলঞ্চের পাতা শাকের মতো কুচিয়ে ভেঙ্গে খেলে জ্বর ছেড়ে যায়। পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব না হলে ৮ থেকে ১০ গ্রামের মতো গুলঞ্চের ডাঁটা অল্প জল দিয়ে থেতো করে নিংড়ে ঐ রসকে ছেঁকে, অল্প গরম করে খেতে হবে, এটাতেও কাজ হবে অথবা থেতো করা ঐ গুলঞ্চ এক কাপ জলে সিদ্ধ করে আধা কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে অল্প চিনি মিশিয়ে খেতে হবে অথবা গুলঞ্চের রস বা ক্বাথ দিয়ে ঘি তৈরী করে খেতে হবে। এতে জ্বর ছেড়ে যায়।

আরো পড়ুন:  চুলকানি কমানোর ১৩ টি ঘরোয়া সহজ সমাধান

৪. সর্দি কাসি কিছুই নেই, হঠাৎ হাই উঠে কেঁপে জ্বর আসে, আবার খানিকক্ষণ বাদে কমে যায়, একে বলে বাতিকের জ্বর, এ ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১০ গ্রাম গুলঞ্চকে থেঁতো করে তার ক্বাথ ছেঁকে ঠাণ্ডা হয়ে গেলে খেতে হবে।

৫. যে জ্বর ৩ সপ্তাহের মধ্যে সুচিকিৎসার অভাবে অথবা ভুল চিকিৎসায় তাঁর শরীর দোষমুক্ত হলো না, সেক্ষেত্রে পুনরাক্রমে ভয়ও তাঁর গেল না; পরিণতিতে সেই দোষাংশ রক্তগত হবে, যার ফলে অল্প অল্প জ্বর মাঝে মাঝে হাতে থাকবে এবং যকৃৎ বা লিভার প্লীহাও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। এক্ষেত্রে ফুল সমেত দ্রোণপুষ্প গাছকে কলার পাতায় জড়িয়ে, একটু মাটি লেপে, তাকে পোড়াতে হবে; তারপর মাটি ছাড়িয়ে গাছগুলি একটু থেঁতো করে, ছেঁকে, সেই রস এক চা চামচ নিয়ে সকালে ও বিকালে দু’বার দুধসহ খেতে দিতে হবে; তবে দুধ পাওয়া না গেলে জলের সঙ্গেও খাওয়ানো যায়। একে দেশগাঁয়ে বলা হয় ঘুসড়ো করে খাওয়ানো।

৬. জ্বর প্রায় মাঝে মাঝে হচ্ছে, মুখে অরুচি, দাস্ত পরিষ্কার হয় না, যকৃত প্লীহায় ব্যথা, আস্তে আস্তে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২ গ্রাম ছাতিম ছাল ৩ বা ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে (শুষ্ক হ’লে ৫ থেকে ৬ গ্রাম), ছেকে নিয়ে সেই জল দু’বেলায় ভাগ করে খেতে হয়, এর দ্বারা দুই-এক দিনের মধ্যেই জ্বর ছেড়ে যাবে। এর সঙ্গে নাটা করঞ্জের Caesalpinia bonduc বীজের শাঁস ২ বা ৩ গ্রেণ (১৫০-২০০ মিলি গ্রাম) মাত্রায় খেলে ভালো থাকবেন।

৭. জ্বর যে হবে তার সব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, মাথা ভার, সারা শরীরে কামড়ানি, এই অবস্থায় কাঁচা তেলাকুচা ফলের রস ১ চা চামচ একটু মধুসহ সকালে ও বিকালে ২ বার খেলে জ্বরভাবটা কেটে যাবে, তবে অনেক সময় একটু বমি হয়ে তরল সর্দিও উঠে যায়; এটাতে শরীর অনেকটা হালকা বোধ হয়। তবে যে ক্ষেত্রে এই রোগে বায়ু অনুষঙ্গী হয় সেখানে কাজ হবে না, যেখানে পিত্ত অনুষঙ্গী হয় সেখানেও কাজ হবে না; কেবল যেখানে শরীরে কফের প্রবণতা আছে, তার সঙ্গে ডায়েবেটিস, সেখানেই কাজ করবে। এ ক্ষেত্রের লক্ষণ হবে থপথপে চেহারা, কালো হলেও ফ্যাকাসে, কোমল স্থানগুলিতে ফোড়া হতে চাইবে বেশী, এদের স্বাভাবিক টান থাকে মিষ্ট রসে, এরা জলা জায়গার স্বপ্ন বেশী দেখেন। রমণের স্থায়ীত্বও নেই যে তা নয়, এই বিকার যে কেবল বৃদ্ধকালে আসবে তা নয়, সব বয়সেই আসতে পারে। এদের ক্ষেত্রে আলু খাওয়া, মিষ্টি খাওয়া, ভাত বেশী খাওয়া নিষেধ করেছেন আয়ুর্বেদের মনীষীগণ, যাঁরা বায়ু বা পিত্ত বিকৃতির সঙ্গে ডায়েবেটিস রোগে আক্রান্ত হন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই সব বর্জনের খুব উপযোগিতা আছে বলে আয়ুর্বেদের মনীষীগণ মনে করেন না।

আরো পড়ুন:  অরুচি কমাতে শস্যকণা ও ভেষজ উদ্ভিদের ১২টি ঔষধের ব্যবহার

 ৮. নতুন জ্বরের সময় পিপাসা পায় সেজন্য ১০ থেকে ১২ গ্রাম ধনে পাতা একটু কুটে নিয়ে, ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সমস্তদিন ৩ থেকে ৪ বারে ঐ জলটা খেতে দিতে হবে, এর দ্বারা জ্বরের তাপটা কমে যাবে এবং পিপাসারও নিবৃত্তি হবে।

৯. চোখ মুখ ঝামরে জ্বর; যাকে বলা হয় শরীর রসস্থ হয়ে জ্বর হয়েছে, সেক্ষেত্রে পারিজাত বা মান্দার গাছের ছালের রস এক চা চামচ একটু জল মিশিয়ে ও গরম করে সকালে ও বিকালে দুইবার একটু মধু মিশিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা দু’দিনের মধ্যে জ্বর ছেড়ে যাবে।  

১০. যে জ্বর তিন সপ্তাহের মধ্যে আসছে, যাচ্ছে বা থাকছে এ সংজ্ঞায় সে পড়ে না, কিন্তু জ্বর যদি মাঝে মাঝে হতে থাকে বা চাতুর্থক জ্বর বা পালাজ্বরে দাঁড়ায়; এই জ্বর তিন দিন বাদে আসে, সেখানে বুঝতে হবে বায়ু রসবহ স্রোতে বিকারগ্রস্থ হয়েছে, সুতরাং এই বায়ুকে স্বাভাবিক করে দিলেই এই জ্বর সেরে যাবে, তারই জন্য পুনর্নবা মূল সহ গাছ কুচিয়ে থেঁতো করে, কাঁচা হলে ২০ থেকে ২৫ গ্রাম, আর শুকনো হলে ১০ থেকে ১২ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে সকালে ও বিকালে দুইবারে খেতে হবে। এর দ্বারা বিকৃত বায়ু আবার স্বাভাবিক হয়ে ঐ জ্বর নিরাময় করবে।

১১. এ জ্বরে সাধারণত মাথায় ও ঘাড়ে যন্ত্রণা তো হয়ই, অধিকন্তু সমস্ত শরীরেও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি; এক্ষেত্রে বকুল ফুলের চূর্ণের নস্য নিলে ঐ অসুবিধাগুলি চলে যায়।

১২. বাত জ্বরে কাঁপানি থাকবে আর তার সঙ্গে বকবক করার প্রবণতা ও চোঁচামেচিও বাড়ে এবং সঙ্গে থাকে মুষ্কের যন্ত্রণা যদি পুরুষ হয় সেক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে কচি মূলা ৫০ গ্রাম আন্দাজ ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছোঁকে সেই জুসটা কয়েকবারে একটু একটু করে খেতে দিলে ঐ বাতজ্বরের উপসর্গ গুলির উপশম হবে। তবে জ্বরের চিকিৎসা পথিক করতে হবে। 

আরো পড়ুন:  বোলতা ও ভীমরুল বা কীটের কামড় ও হুলের ব্যথানাশের ঘরোয়া উপায়

১৩. জীর্ণ জ্বর যেটাকে সাধারণত ঘুসঘুসে জ্বর বলা হয় এক্ষেত্রে ২o থেকে ২৫ গ্রাম খোসাসহ মসুর ডাল ৫ কাপ জলে সিদ্ধ করে ৩ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে ঐ জলটা ২ থেকে ৩ বারে খেতে হবে।

১৪. শ্লেষ্মা জ্বরের কারণে সর্দিতে বুক ভার, সেক্ষেত্রে এই পাতার রস ২ চামচ একটু, গরম করে ছেকে নিয়ে খেতে দিতেন প্রাচীন বৈদ্যরা।

১৫. টাইফয়েড জ্বরে পিপাসা ও সঙ্গে মাথা চালাও প্রবল থাকে, এ ক্ষেত্রে ঐ পাতার রস গরম করে, ছেকে ঐ রস ১০ ফোঁটায় একটু, জল মিশিয়ে খেতে দিতে হয়। আধ ঘণ্টা অন্তর দুই/তিন বার খাওয়ালে এই উপসর্গটা প্রশমিত হয়, তবে দুই-তিন বারের বেশী খাওয়ানো উচিত নয়।

১৬. সাময়িক জ্বর বা জ্বরভাব এর সঙ্গে সর্দির প্রাবল্য থাকলে অল্প দু’টো পাতা ঝোল করে বা শাক রান্না করে খেলে উপশম হয়।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১ ও ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।

1 thought on “জ্বর সারানোর কার্যকরি ১৬টি ভেষজ চিকিৎসা”

  1. বাত জরের ওষুধ দেয়া হয় ;
    কলঃ ০১৭৮১৪৪৫৫৩৭

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!