বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর কিশোরীদের স্বাস্থ্য গঠিত হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে প্রজনন স্বাস্থ্য (ইংরেজি: Reproductive health) সম্পর্কেও সে সময় তাদের জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন হয়। কিশোর ও কিশোরীদের পুষ্টি চাহিদা ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত আলোচনা এখানে করা হচ্ছে। আমরা জানি, বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের দৈহিক পরিবর্তন ঘটে। ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই শারীরিক কাঠামো মজবুত, দৃঢ় ও বর্ধিষ্ণু হয় বলে এ সময় অধিক পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন হয়।
বয়ঃসন্ধিকালের বিশেষ শারীরিক ও মানসিক অবস্থায় সুস্থ দেহ ও মন বজায় রাখতে খাদ্য নির্বাচনের সময় নজর দেয়া দরকার। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ক্রিয়াকর্ম বৃদ্ধি পায়। এ জন্য প্রতিদিনই তাদের সুষম খাদ্য সরবরাহ করা জরুরী। সুষম খাদ্য বলতে তাদের দেহের চাহিদা অনুযায়ী অধিক আমিষ ও শর্করাযুক্ত খাদ্য এবং অন্যান্য খাদ্য উপাদানের যথার্থ উপস্থিতিকেই বোঝানো হয়েছে। এ সময় কিশোরীদের লৌহ জাতীয় খাদ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সাধারণভাবে খাদ্যের ৬টি উপাদানই যথা আমিষ, শর্করা, স্নেহ, ভিটামিন, খনিজ লবণ, পানিসমৃদ্ধ খাদ্য দেহের চাহিদামত নির্বাচন করে খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। অন্যথায় পুষ্টির অভাবে দৈহিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হবে।
বয়ঃসন্ধিকালের প্রজনন স্বাস্থ্যবিধি
প্রজনন অর্থ সন্তান জন্মদান। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীরা সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা অর্জন করে। দেহের যেসব অঙ্গসমূহ সন্তান জন্মদানের সাথে সরাসরি যুক্ত সেসব অঙ্গের স্বাস্থ্যকে প্রজনন স্বাস্থ্য বলে। কাজেই, প্রজনন স্বাস্থ্য হলো প্রজননতন্ত্র ও প্রজনন প্রক্রিয়ার সুস্থতা। শিশুর নিরাপদ জন্ম ও সুস্থতা প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর নির্ভরশীল। সামগ্রিক প্রজনন স্বাস্থ্য বলতে একটি শারীরিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক সুস্থ অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়াকেই বোঝায়।
প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে মেয়েদের যে শারীরিক পরিবর্তন ঘটে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেক সময় শারীরিক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। প্রজনন স্বাস্থ্যের অন্যতম শর্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। বিশেষত মেয়েদের ঋতুস্রাব সময়কালীন পরিচ্ছন্নতা বিশেষ জরুরী। নিয়মিত গোসল, জনন অঙ্গ পরিষ্কার রাখা সবসময়ই উচিত। এ সময় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ও প্রচুর পানি পান করতে হয়। তা না হলে শরীর দুর্বল বোধ হতে পারে। অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হলে প্রজনন স্বাস্থ্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে এবং সন্তান ধারণ মা ও শিশুর জীবনকে রোগাক্রান্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। তাই প্রাপ্ত বয়সের বা ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দেয়া রীতিমত অপরাধ। নিয়মতান্ত্রিক, পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করলে যৌন রোগের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যাবে। অর্থাৎ সুস্থ, সুন্দর, প্রফুল্ল ও ঝুঁকিমুক্ত জীবনযাপনের জন্য প্রজনন স্বাস্থ্যরক্ষা একান্ত জরুরী।
প্রজনন স্বাস্থ্যবিধি
মানুষের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের একটি বিশেষ অংশ হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য। সুস্থ প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপদ জন্ম ও স্বাস্থ্য নির্ভর করে। কাজেই প্রজনন স্বাস্থ্য দেশ ও দশের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য প্রজনন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত। প্রজনন স্বাস্থ্যের অন্তর্গত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হলো।
১। বিয়ে ও গর্ভধারণ: মেয়েদের ১৮ বছর বয়সের আগে এবং ছেলেদের ২১ বছর বয়সের আগে বিয়ে দেয়া যাবে না। মেয়েদের গর্ভধারণে সর্বনিম্ন বয়স ২০ বছর। অর্থাৎ ২০ বছর বয়সের আগে গর্ভধারণ করা যাবে না। এতে মা ও শিশু উভয়ই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
২। নিরাপদ মাতৃত্ব: গর্ভধারণকালীন, প্রসবকালীন ও সন্তান প্রসব করার পর মায়ের সুস্থতা রক্ষা অত্যন্ত জরুরী। এসময়ের সুস্থতাকেই নিরাপদ মাতৃত্ব বলা হয়। নিরাপদ মাতৃতু শুধু শারীরিক সুস্থতাই নির্দেশ করে না। মায়ের মানসিক প্রফুল্লতা, নিরাপত্তা, যত্ন, সেবা, খাদ্য ইত্যাদিকেও বোঝায়।
৩। গর্ভকালীন যত্ন: গর্ভকালীন সময়ে মায়ের উপযুক্ত পুষ্টিকর খাদ্য, বিশ্রাম, ঘুম, ডাক্তারের নিয়মিত পরামর্শ, প্রয়োজনীয় টিকা, ওষুধ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও আপনজনদের সহযোগিতা একান্ত জরুরী।
৪। গর্ভধারণ বিরতি: প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হলে অধিক সন্তান ধারণ করা উচিত হবে না। এছাড়া ২টি সন্তানের মধ্যে ৩-৫ বছরের বিরতি দিতে হবে।
৫। প্রজননতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ: প্রজননতন্ত্রের বিভিন্ন সংক্রামক ও যৌন রোগ হতে রক্ষা পেতে প্রয়োজনীয় টিকা গ্রহণ ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রয়োজনে সেবাদানকারী সংস্থার কাছ হতে সেবা ও পরামর্শ নিতে হবে।
বয়ঃসন্ধিকালে পুষ্টি চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এ সময় পুষ্টির পাশাপাশি প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপর নজর দেয়া আবশ্যক। কারণ এসময় ছেলেমেয়েরা সন্তান জন্মদান ক্ষমতা অর্জন করে। প্রজননতন্ত্র ও প্রজনন প্রক্রিয়ার সুস্থতাই হলো প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষা। সুস্থ আগামী প্রজন্মের জন্য এবং মায়ের ঝুঁকি এড়াতে প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষা একান্ত প্রয়োজন। প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষায় যে বিষয়গুলো নজর দেয়া জরুরী সেগুলো হলো বিয়ে ও গর্ভধারণের সর্বনিম্ন বয়স মেনে চলা, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা, মায়ের গর্ভকালীন যত্ন নেয়া, সন্তান সংখ্যা সীমিত রাখা, দুটি সন্তানের মাঝে নির্দিষ্ট বিরতি দেয়া, প্রজননতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করা ইত্যাদি।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।