মূত্রনালীর সংক্রমণ বা প্রস্রাবের নানা ধরণের সমস্যা (ইংরেজি: Urinary infection) যে কোনো বয়সে হতে পারে। এরজন্য ব্যক্তিকে ভুগতে হয়। ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় এবং নানা প্রকার ঔষধ সেবন করতে হয়। এই ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি সময় মতো সমস্যা বুঝতে পারেন তাহলে খুব সহজেই ঘরোয়া পদ্ধতিতে রোগের সমাধান করা যাবে।
মূত্রনালীর সংক্রমণ বা প্রস্রাবের নানা সংক্রমণ থেকে মুক্তির ঘরোয়া উপায়:
১. আমের পাতা: আমের নতুন পাতা শুকিয়ে গুড়া করে পানিতে মিশিয়ে খেলে বহুমূত্র প্রশমিত হবে।
২. আমলকী: যাঁরা প্রস্রাব সংক্রান্ত কোনো রোগে আক্রান্ত, এমন কি ডায়াবেটিস; তাঁরা দিনে ৩ থেকে ৪ গ্রাম আমলকী যে কোনো আকারে সেবন করবেন। কাঁচা রস করেই হোক বা মুখশুদ্ধি হিসেবেই হোক।
৩. এরন্ডা: প্রশ্রাবের স্বল্পতায় সমস্যা থাকলে এরন্ডা কাঁচা মূল ১৫ থেকে ২০ গ্রাম মাত্রায় ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করতে হবে। এক কাপ থাকতে নামিয়ে নিয়ে ছেঁকে সকালে অথবা বিকালে একবার খেলে প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং বার বার প্রস্রাব করতে যেতে হবে না।
৪. গনিয়ারি: মূত্রনালীর সংক্রমণ বা প্রস্রাব সংক্রান্ত সমস্যায় গনিয়ারি গাছের বা মূলের ছালের ক্বাথ পান করার উপদেশ দিয়েছেন সুশ্রুত ও চক্রদত্ত।
৫. চালকুমড়া: পেট ফাঁপা ও প্রস্রাব ভালো হচ্ছে না; এমন ক্ষেত্রে চালকুমড়োর রস পেটে মালিশ করলে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে দুটোই সমস্যা দূর হয়ে স্বাভাবিক হয়।
৬. জামপাতা: শয্যামুত্র এই রোগে শিশু ও বৃদ্ধ অনেকেই অসুবিধায় পড়েন এবং অনেক মাকেও সন্তানের জন্য ভুগতে হয়। সেক্ষেত্রে ২ থেকে ৩ চা চামচ জামপাতার রস বয়সানুপাতে খেলে উল্লেখযোগ্য উপকার হবে।
৭. জালজামানি: অনেকের প্রস্রাবের পূর্বে বা পরে কিছু ক্ষরতি হতে থাকলে যেমন লালামেহ বা শুক্রমেহ spermatorrhoea। সেক্ষেত্রে জালজামানির পাতা উপরিউক্ত নিয়মে সরবত করে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে ব্যবহারবিধি সহজ করতে গেলে এটাকে শুকিয়ে গুড়ো করে ৬ বা ৮ গ্রেণ অর্থাৎ ৩ থেকে ৪ রতি মাত্রায় সকালে বা বিকালে সুবিধে মতো সময়ে একবার দুধ বা জল দিয়ে খেতে হযবে। এটাতে দাস্তও ভাল পরিষ্কার হয়।
৮. তেঁতুল: প্রস্রাবের জ্বালায় এক চা চামচ আন্দাজ তেতুল পাতার রস দিয়ে সরবত খেলে উপশম হয়।
৯. দুর্বা: মুত্র কৃচ্ছ্রতায় প্রস্রাব হতে কষ্ট হচ্ছে অথচ পাথুরী সমস্যা নয়। সেক্ষেত্রে দূর্বার রস দেড় বা দুই চামচ দুধ ও জল মিশিয়ে খেলে সুন্দর ফল হয়; তবে অর্শ থাকলে কাজ হবে না।
১০. নিশিন্দা: শয্যামুত্রে দীর্ঘদিন পর্যন্ত অনেক ছেলেমেয়েকে নিয়ে মায়েদের এই সমস্যায় ভূগতে হয়, এ ক্ষেত্রে নিশিন্দার পাতার গুড়ো ২ গ্রেণ মাত্রায় (৬ থেকে ৭ বৎসর বয়স হলে) বিকালে জলসহ খাওয়ালে ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে এ জ্বালা থেকে মায়েরা রেহাই পাবেন। যদি ৭ দিন ব্যবহারে না কমে, তবে সকালে-বিকালে ২ বার খাওয়াবেন। এটি ব্যবহারের সব থেকে সুবিধে হচ্ছে যেকোন প্রতিক্রিয়া (Reaction) নেই।
১১. পেয়াজ: যে কোনো কারণে শরীর গরম হয়ে প্রস্রাব কষা হয়ে গিয়েছে, সেক্ষেত্রে পেয়াজের রস ১ চা-চামচ ঠাণ্ডা জলের সঙ্গে খেলে ঐ অসুবিধেটা চলে যায়। তবে রস বেশি খেলে যেমন বমি হওয়ার ভয় থাকে, আবার অল্প খেলে তেমনি বমি বন্ধও হয়।
অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রস্রাব চাপলে আর দাঁড়াতে পারা যায় না, প্রায় বেসামাল হয়ে পরে। এক্ষেত্রে পেঁয়াজের রস এক চা-চামচ করে কিছুদিন খেয়ে দেখুন; ওটা সামলে দেবে।
১২. অপরাজিতা: অনেক বালকেরও দেখা যায় যে নড়েচড়ে আর প্রস্রাব করে, অথচ পরিমাণে অল্প। আবার বড়োকালেও এটা দেখা যায়। এক্ষেত্রে সাদা বা নীল যাই পাওয়া যাক, অপরাজিতা গাছে-মূলে নিয়ে, রস করে ১ চা চামচ আন্দাজ প্রতিদিন ২ বার একটু দুধ মিশিয়ে খেতে হয়। এটি কিন্তু পূর্ণমাত্রা।
১৩. আঙুর: তরকারি কম কম করে খাওয়ার অভ্যোস অথচ ঘি, দুধ এক ফোঁটা পেটে পড়ে না। তার ওপর বয়স হয়েছে, এইজন্য পেটে বায়ুও হয় প্রচুর। তাই তার দাস্ত ও প্রস্রাব হতে সমস্যা হয়, এই রকম ক্ষেত্রের মূত্রকৃচ্ছ্রতায় দেখা দিলে ২০ গ্রাম কিসমিস ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ বা আন্দাজ এক পোয়া থাকতে নামিয়ে নিতে হবে। এরপরে চটকে, সিটেগুলি ফেলে দিয়ে সকালে ও বিকালে দুবার ঐ জলটা খেতে হবে। এর দ্বারা ২ থেকে ১ দিনের মধ্যেই ঐ কৃচ্ছ্রতা চলে যাবে।
১৪. কাঁকুড়: প্রস্রাবের স্বল্পতা এই ধরণের অসুবিধেটা এসেছে কিন্তু বায়ু বিকারগ্রস্ত হয়েছে মনে হলে। সেক্ষেত্রে মিষ্টি কচি কাঁকুড়ের রস ২ চা চামচ ৭ থেকে ৮ চা চামচ জল ও একটু মিছরি মিশিয়ে সরবতের মতো করে প্রত্যহ একবার খেলে প্রস্রাবটা স্বাভাবিক হবে।
১৫. কাকমাচী: বায়ু বিকারে মূত্রবহ স্রোতের গ্রন্থি যখন শিথিল হয়ে যায়, তখন প্রস্রাব ধরে রাখার ক্ষমতা আর থাকে না, আর যদি গ্রন্থি স্ফীত হয় তাহলে বারে বারে প্রস্রাব হয় বটে, কিন্তু কষ্টের সঙ্গে এবং পরিমাণেও অল্প হতে থাকে। এইটাই মূত্রকৃচ্ছ্র রোগ। অবশ্য অস্মরী হলে কোনো কোনো সময় তার সঙ্গে ব্যথাও অনুভূত হতে থাকে। এক্ষেত্রে স্বাদু কাকমাচী পাতার রস গরম করে, ছেঁকে নিয়ে এক বা দুই চা চামচ খেতে হবে।
১৬. কুরচি: কৃচ্ছ শব্দের অর্থ হলো কষ্টে হওয়া। এটা অনেক কারণেই আসতে পারে প্রোষ্টেট গ্ল্যান্ড বড় হলে কৃচ্ছতা ততটা থাকে না। কিন্তু প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, সেটাকে মূত্রাঘাত বলা হয়; তবে যেখানে প্রস্রাবের কৃচ্ছতা থাকে, সেখানে কুরচির ছাল চূর্ণ ৮ থেকে ১০ গ্রাম পূর্বদিন রাত্রে ১ গ্লাস গরম জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে, তার পরদিন সকালে ছেকে নিয়ে এক থেকে দেড় ঘণ্টা অন্তর ৪/৫ বারে সেটা খেতে হবে। এটাতে ঐ কৃচ্ছতাটা চলে যাবে।
১৭. গাঁদাল বা গন্ধভাদুলি: গ্রন্থিস্ফীতি নেই। অথচ প্রস্রাব আটকায়, সেক্ষেত্রে গাঁদাল বা গন্ধভাদুলি পাতার রসে ৩ থেকে ৪ চা চামচ আধ পোয়া আন্দাজ কাঁচা দুধ মিশিয়ে কয়েকদিন খেলে এ দোষটা সেরে যাবে।
১৮. গোলমরিচ: প্রস্রাব একটু একটু হতে থাকে এবং থেমেও যায়।পূর্ব থেকে এদের হজমশক্তিও কমে গিয়েছে ধরে নিতে হবে। এরা গোলমরিচ ২ গ্রাম নিয়ে চন্দনের মতো বেটে একটু মিশ্রি বা চিনি দিয়ে সরবত করে খেতে হবে।
১৯. ডাব বা নারকেল: অজীর্ণজনিত কারণে, অত্যধিক রৌদ্রে ঘুরাঘুরি করার জন্য, অত্যধিক পরিশ্রমে অথবা একনাগাড়ে এক আসনে চেপে বসে থাকায় যে প্রস্রাবের কৃচ্ছতা আসে, সেক্ষেত্রে একটা বা দুটো কচি ডাবের জল খেলে সাময়িক ঐ অসুবিধেটা চলে যাবে।
প্রস্রাবের সঙ্গে শকরাবৎ অর্থাৎ দেখতে চিনির দানার মতো একটা জিনিস বেরিয়ে যাচ্ছে, যাকে Crystalluria বলা যায়। এক্ষেত্রে নারকেলের ফোঁপল অন্ততঃ ১০ গ্রাম দই দিয়ে বেটে প্রত্যহ সকালে একবার করে খেতে হবে। এত দ্বারা মূত্রের সহিত শর্করা নিগমন বন্ধ হবে।
২০. পানিফল: অম্ল, অজীর্ণ ও পেটের বায়ুতে অনেক সময় প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেল, সেক্ষেত্রে পানিফল বেটে মূত্রাশয় (bladder) উপরটায় প্রলেপ দিলে প্রায় ক্ষেত্রেই প্রস্রাব হয়ে যায়।
২১. পারিজাত বা মান্দার: এই কৃচ্ছ্রতার কারণ থাকে অন্য; যাকে বর্তমান যুগে বলা হচ্ছে বি-কোলাই ইনফেকশন। এর সঙ্গে একটু জ্বরও থাকে; এক্ষেত্রে ঐ ক্রিমিই তো এই রোগের কারণ; যার জন্য প্রস্রাব পরীক্ষা করা হয়, তাই পারিজাত বা মান্দার পাতার রস ১ চা চামচ অল্প জল মিশিয়ে একটু গরম করে সকালের দিকে একবার ও বিকালের দিকে একবার খাওয়ালে ঐ ব্যাকটিরিয়াগুলি অর্থাৎ ক্রিমিগুলো ধবংস হয়ে রোগ নিরাময় হবে।
২২. বকুল গাছ: বাতশ্লেষ্মা ও পিত্তশ্লেষ্মার ধাতু যাদের ঋতুবিশেষে তাঁদের মূত্রবেগ কখনও ঢিলে কখনও কষা হতে দেখা যায়। তাঁদের ধারণা হয় প্রোষ্টেট গ্লান্ড বড় হয়েছে অথবা তাকে ধরে রাখার ক্ষমতা চলে গিয়েছে। এক্ষেত্রে বকুলছাল ১০ গ্রাম একটু কুটে থেঁতো করে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সেইটাকে সকাল, বিকাল ও রাতে ৩ বারে খেতে হব। এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে। যদি দেখা যায় কোষ্ঠবদ্ধতা আসছে, তবে ৫ গ্রাম ওজন নিয়ে একটু থেঁতো করে, ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করার পর এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে ৩ বারে খেতে হবে।
২৩. বেড়েলা: মেদস্বী লোক প্রস্রাব করতে গেলে কষ্ট হয়, দাঁড়িয়েও সরলভাবে প্রস্রাব হচ্ছে না, যেন ভেতর থেকে একটা বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, এ বাধাটা কিন্তু রসবহ স্রোতে বায়ুবিকার। এক্ষেত্রে বেড়েলার বা পীতপুষ্প মূল ১০ গ্রাম একটু থেঁতো করে ২ কাপ জলে সিদ্ধ করে, এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সেই ক্বাথটা সকালে অর্ধেক ও বিকালে অর্ধেকটা খেতে হবে, এর দ্বারা ঐ কৃচ্ছ্রতার কিছুটা উপশম হবে।
২৪. মসূর ডাল: কৃচ্ছ্রতা গ্রন্থিস্ফীতিজনিত ক্ষেত্রের নয়। এটা এসেছে চোরা অম্বলরোগ থেকে। কোনো কারণে পেটে বায়ু হয়েছে, উর্ধ্ব বা অধঃ কোনো দিকেই নিঃসরণ হচ্ছে না, এক্ষেত্রেও মূত্রকৃচ্ছ্রতা দেখা দেয়, সেখানে খোসা সমেত মসূরের ডাল এক লিটার জলে সিদ্ধ করে ৫০০ মিলিলিটার থাকতে নামিয়ে রেখে দিতে হবে, ওটা থিতিয়ে গেলে, উপর থেকে পাতলা জলটা আস্তে আস্তে ঢেলে নিতে হবে এবং এক ঘণ্টা অন্তর ৩ থেকে ৪ বারে খেতে হবে। এর দ্বারা অপানবায়ুর স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে; তার ফলে এই কৃচ্ছ্রতাটা চলে যাবে।
২৫. মূলা: মূত্রকৃচ্ছ্রতা বায়ুর জন্য এসেছে, সেক্ষেত্রে এর লক্ষণ হলো অল্প অল্প প্রস্রাব হয়, দাঁড়িয়ে বা বসে যেভাবে প্রস্রাব করতে যান না। কোনোটাতেই সুবিধা হচ্ছে না, এক্ষেত্রে মূলার বীজ চূর্ণ এক বা দেড় গ্রাম জল দিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে। এটি ব্যবহার করলে আর একটি রোগকে আটকে দেওয়া যায়; সেটি হলো পাথুরী রোগ।
২৬. শতমূলী: পাথুরী যে হয়েছে তাও নয়, অথচ কষ্টে প্রস্রাব হচ্ছে, তখনই বুঝতে হবে যে, রসবাহ ও রক্তবহ স্রোত দূষিত হয়েছে; এক্ষেত্রে শুষ্ক শতমূলীকে চূর্ণ করে ১ গ্রাম মাত্রায় সকালে ও বিকালে ঠান্ডা জলসহ খেলে ২ থেকে ৪ দিনের মধ্যে মূত্রের কৃচ্ছতা চলে যাবে।
তথ্যসূত্র
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ১ ও ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।