বিদেশিরা বাঁচাতে আসে না, মারতেই আসে; বাঁচতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই

না, কেউ বাঁচাবে না, যদি বাঙালি নিজে না বাঁচায় নিজেকে। ঋণদাতাদের উদ্দেশ্য চিরকালের জন্য ঋণী করে রাখা। এ এক নতুন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, আপাত-স্বাধীনকে বাস্তবে পরাধীন করে রাখার। এনজিওদের আসল রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী চরিত্র সম্পর্কে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা যাতে বিকশিত হতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। বিদেশিরা বাঁচাতে আসে না, মারতেই আসে। বাঁচতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই। যে দিন থেকে বাঙালি তার পরিচয় সম্পর্কে আত্মসচেতন হয়েছে সেদিন থেকেই এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে : কে তাকে বাঁচাবে? বঙ্কিমচন্দ্র জিজ্ঞাসা করেছেন ওই প্রশ্ন এবং ওই জবাবই দিয়েছেন, বাঙালি নিজেকে না বাঁচালে কেউ তাকে বাঁচাবে না। ইংরেজ ঠিক করেছিল বাংলাকে দুভাগ করবে, যাতে ইংরেজের থাবা থেকে সে আর বেরুতে না পারে। ১৯০৫-এর সেই বঙ্গবিভাগের বিরুদ্ধে সেদিন যারা বিক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ১৯৪৭ সালে তারাই দেখা গেল অস্থির হয়ে পড়েছে বাংলাকে ভাগ করার জন্য। নিজেদের স্বার্থে, সাধারণ মানুষের স্বার্থে নয়।

সাধারণ মানুষই বাঙালি আসলে, খাঁটি বাঙালি। বাংলা তাদেরই ভাষা। যারা ধনী ও শিক্ষিত অর্থাৎ অসাধারণ, তারা বাঙালি থাকতে চায় না। কেউ বিদেশে যায়, যারা যায় না তারা দেশে বসেই বিদেশি হয়ে যায়। বিদেশি পণ্য ব্যবহার করে না শুধু, ভাষাও ব্যবহার করে। তাদের আদর্শ দেশ নয়, বিদেশ। তাদের আদর্শ পুঁজিবাদী বিশ্ব। বাঙালিকে বাঙালি বলে চিনব কী দিয়ে? না, চেহারা দেখে নয়, পোশাকেও নয়, চিনতে হবে ভাষা দিয়েই। তবে সেই পরিচয় যথেষ্ট নয়। চিনতে হবে আরো এক নিরিখে। সে হচ্ছে বাঙালির প্রতি ভালোবাসা। সেই বাঙালি যে বাংলা বলে এবং বাঙালিকে ভালোবাসে। অন্যরা মেকি বাঙালি কিংবা খাঁটি অবাঙালি; কিছুতেই বাঙালি নয়। কিন্তু ভালোবাসব বলেই ভালোবাসা যায় না, পাত্রকেও উপযুক্ত হতে হয় ভালোবাসা পাওয়ার। সেটাও খুবই জরুরি। সেই বঙ্গভাষীই তাই বাঙালি যে তার দেশবাসীদের মনুষ্যত্বের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, চেষ্টা করে তাদের দারিদ্র্য ও অশিক্ষা অপনোদনের। এই বাঙালিরই আজ বড় অভাব এই বাংলাদেশে।

সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে যারা কলকাতায় যান, ব্যথিত হয়ে ফিরে আসেন। সবকিছুই পান, কেবল বাঙালি খুঁজে পান না। রাস্তাঘাটে, দোকানপাটে, ব্যাংকে-অফিসে হিন্দি শোনেন, বাংলা বললে পাত্তা পাওয়া যায় না, ইংরেজি বললে বরঞ্চ কাজ হয়, মনে করে কেউকেটা হবে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দির আগ্রাসনে বড়ই বিপন্ন। হিন্দি আর বাইরে নেই, ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে টেলিভিশনের মধ্য দিয়ে। বাংলা চলচ্চিত্রও আজ বিপন্ন, হিন্দি ছবির উৎপাতে। পশ্চিমবঙ্গেও এখন তাই একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হচ্ছে।

আরো পড়ুন:  বাঙালি কী করে বাঙালি হবে

বাংলার ভবিষ্যৎ আসলে বাংলাদেশেই। অবিভক্ত বঙ্গে এ অঞ্চল পশ্চাৎপদ ছিল, কিন্তু ইতিহাসের আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে আজ সে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করছে এবং এ স্বাধীনতাকে প্রকৃত স্বাধীনতায় পরিণত করার জন্য লড়ছে। তার সফলতা-বিফলতার ওপর এখন বাঙালির ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল অনেকাংশে।

কিন্তু বাংলাদেশে বাঙালির কী হাল আজকে? ষোল কোটি মানুষের মধ্যে কতজন আমরা বাংলা বলি? হ্যাঁ, অধিকাংশই যে বাংলা বলে তা ঠিক। কিন্তু শুদ্ধভাবে বলে না এবং না পারতে বলে। অধিকাংশ মানুষের শিক্ষা নেই। অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লোকের শতকরা হার বাড়ছে না কিছুতেই। অজ্ঞ লোক বাংলাই বলে (আর কী বলবে!); কিন্তু সে বাংলা বাংলা কি না সন্দেহ। অত্যন্ত আদিম এবং মোটেই যথার্থ নয়। আর যারা শিক্ষিত তাদের ভাষায় ইংরেজির মিশেল বাড়ছে, কেবলই বাড়ছে। এত বেশি ইংরেজি শব্দ, বাক্যাংশ, এমনকি আস্ত আস্ত বাক্য প্রবেশ করছে আমাদের মুখের ভাষায় যে কখনো কখনো মনে হয় বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মেশেনি, ইংরেজির সঙ্গে বাংলা মেশানো হচ্ছে; দুধে পানি নয়, পানিতে দুধ। পারলে ইংরেজিতেই কথা বলত। পারে না, সাহস নেই, ভয় পায় শুদ্ধ হবে না। ব্যাকরণের দায়িত্ব না নিয়ে তাই অনর্গল ইংরেজি বকে যায়, ইংরেজি না বলে। বাঙালি নিজের পায়ে দাঁড়াতে বড় ভয় পায়। এই তার এক ঐতিহাসিক গ্লানি, যুগ-যুগান্তরের পরাধীনতার কারণে। কাঁধের বোঝাকে ফেলে দেয়া যায়। চেতনার রোগকে ফেলবে কোথায়, কোন আস্তাকুড়ে? নিজের পায়ে দাঁড়াবে না তাই বাংলা বলবে না, এ ভয়ে যে অন্যরা মনে করবে বক্তা অশিক্ষিত, ইংরেজি জানে না; আবার পুরো ইংরেজিও বলবে না পাছে ভুল বলে ফেলে। কোনোটারই দায়িত্ব নেবে না, দুটোরই সুবিধা নেবে।

গল্পটা চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পর্কে প্রচলিত কিন্তু সেকালে অনেকের জন্যই সত্য ছিল। প্রথম যখন রাজনীতিতে আসেন তখন তিনি মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য আলাদা কাপড় পরতেন। সেই যে দুই পোশাক, ঘরে এক, সভাতে আরেক, এ কৃত্রিমতা মুছে ফেলার জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল। বাঙালি মুসলমানের জন্য ছিল আরেক অসুবিধা। সে ঘরে বলত পানি, বিদ্যালয়ে বলত জল। এ কৃত্রিমতা দূর করার জন্য পাকিস্তানের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তান হলো, ঘরে-বাইরে পানি বইল, কিন্তু দেখা গেল আরেক কৃত্রিমতা। এলো উর্দু্। বাঙালি চিরকাল বাঁ দিক থেকে লেখে, শাসকরা বলল ডানদিক থেকে লিখতে হবে। এ বিপদ দূর করতে হলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ভিন্ন উপায় ছিল না। তাই করা হয়েছে। ডানদিক থেকে লেখার আশঙ্কা দূর হয়েছে। কিন্তু কৃত্রিমতা? ইংরেজি বলার কৃত্রিমতা তো আরো বেশি ব্যাপক ও গভীর হয়ে পড়েছে। এখন আর ঘরে-বাইরে আলাদা নয়। ডান ও বাম বিচ্ছিন্ন নয়, সব একাকার করে দিয়ে ইংরেজি এসেছে। আরো আসবে। ইংরেজির প্রচলন বাড়বে। অবস্থা হয়েছে এমন যে, শুদ্ধ ও অবিমিশ্র বাংলা বলাটাই এখন কৃত্রিম ঠেকে; মনে হয় বক্তা বুঝি অবাঙালি, বাংলা শেখার চেষ্টা করছে, তাই অবাংলা শব্দ ব্যবহার করে না এবং সর্বদাই সতর্ক থাকে ভুল বাংলা যাতে না বলে। বাঙালি এখন ভুল বাংলা বলায় গৌরব বোধ করে; কৃত্রিমতাই তার জন্য স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।

আরো পড়ুন:  আসামে বাঙালি বিতাড়নের মুষল পর্ব

এককালে প্রশ্ন উঠেছিল বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষাটি কী- বাংলা নাকি উর্দু? সাধারণ মানুষ জিজ্ঞাসা করেনি, অসাধারণরা করেছে। প্রশ্নটা এখন হাস্যকর ঠেকে, কিন্তু যারা ওটা তুলেছিল তাদের কাছে হাস্যকর মনে হয়নি; খুবই জরুরি বিষয় ছিল ওটি তাদের জন্য। আজকেও ওই একই প্রশ্ন, শিক্ষিত বাঙালির মাতৃভাষা কী, বাংলা নাকি ইংরেজি? এখনো বাংলাই আছে, কিন্তু ইংরেজি হওয়ার পথে, আর মাতৃভাষা যদি ইংরেজি হয় তবে হবে না ওই এক কারণে, দায়িত্ব নেয়ার ভয়ে। কেউ কেউ বিদেশে গেছেন, আরো অনেকে যাবেন। তারা ইংরেজি ব্যবহার করেন, বাধ্য হয়ে। কিন্তু দেশে থেকেও বিদেশি যারা তারা করেন স্বেচ্ছায়। তারা যতটা করেছেন, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আরো বেশি করবে, স্বভাবতই।

সত্য বটে এই ব্যাধি অল্পকিছু লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু সংখ্যা দিয়ে বিচার হবে না। কেননা প্রথমত, এ অল্পসংখ্যকই হচ্ছে সব কিছুর নিয়ামক এবং সর্বক্ষেত্রে আদর্শ। অন্যরা এদের অনুকরণ করে এবং ব্যর্থ হলে আক্ষেপ করে, মনে করে হেরে গেল, পিছিয়ে পড়ল। প্রাতঃস্মরণীয় ইংরেজি বলনেওয়ালারাই, বাঙালিরা নয়। জিয়াউর রহমান বাঙালিকে বাংলাদেশি করেছিলেন, এখন কৃতী বাংলাদেশি মাত্রই অবাঙালি হওয়ার সাধনায় লিপ্ত।

বাঙালিকে তাই বাংলা বলতে ও লিখতে হবে, যদি সে বাঙালি হতে চায় এবং জাতিকে বাঁচানোর চেষ্টায় যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখে। কিন্তু ওই যে বললাম বাংলা ব্যবহার করা সেটাই যথেষ্ট হবে না, বাঙালিকে ভালোবাসতেও হবে এবং তাকে ভালোবাসার উপযুক্ত করতে হবে, গ্রামে না রেখে নিজের কাছে নিয়ে আসতে হবে, আপনজনের মতো। এ দ্বিতীয় কাজটা অনেক কঠিন প্রথম কাজের তুলনায়। হবেই। কিন্তু প্রথম কাজ, বাংলা ব্যবহারের কাজ হবে প্রাথমিক পদক্ষেপ। আগে ঘর, পরে পর। আগে ঘরেই শুরু করা চাই, পরে এগোনো যাবে। প্রত্যেকেরই তাই সিদ্ধান্ত হওয়া চাই বাংলা ব্যবহার করার এবং বাংলাকে সমৃদ্ধকরণে ব্রতী হওয়ার। কিন্তু বলাই বাহুল্য, এ পদক্ষেপ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, দ্বিতীয় এবং কষ্টকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রথম শর্ত মাত্র।

আরো পড়ুন:  এনআরসি অথবা গিলোটিনে অসমের বাঙালি

বাংলা ভাষা ও বাঙালির বর্তমান দুর্দশার কারণ এক ও অভিন্ন। সে হচ্ছে পুঁজিবাদ। বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসকদের বন্ধন ছিন্ন করেছে ঠিকই, কিন্তু পুঁজিবাদের শাসন ছিন্ন করতে পারেনি। ওই বন্ধন দৃঢ়তর হচ্ছে। পুঁজিবাদ অর্থনৈতিকভাবে আমাদের স্বাধীন হতে দিচ্ছে না। আর সেই স্বাধীনতা সর্বক্ষেত্রেই প্রতিফলিত, ভাষার ব্যবহারে তার ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট। পুঁজিবাদই আমাদের অবাঙালি করছে। শিক্ষিতদের বাংলা ভুলিয়ে ছাড়ছে, অশিক্ষিতদের বাংলা শিখতে দিচ্ছে না। বাংলাদেশে এখন ধনীরা বাংলা ব্যবহার করে না, গরিবরা ব্যবহার করতে পারে না, বাংলা আছে শুধু উপায়হীন মধ্যবিত্তের জীবনে, যে মধ্যবিত্ত সর্বক্ষণ ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে এবং ধনী হতে না পেরে গ্লানিতে ভোগে। বাংলা বুঝি ব্যর্থ মানুষদের ভাষা।

মূল লড়াইটা তাই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই। এখানকার সব বিকাশ এখন পুঁজিবাদী পথে। সাংস্কৃতিক সামন্তবাদের যে দৌরাত্ম্য সেও পুঁজিবাদের অভিভাবকত্বেই, নইলে ওই মামদো ভূতের সাধ্য ছিল না, এতকাল টিকে থাকে।

পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোকে পাওয়া যাবে না। এ দায়িত্ব তাই বামেরই, সেই বামেরই যারা সত্যি সত্যি এবং সত্যিকার অর্থে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে। কিন্তু এই বাম তো আকাশ থেকে নামবে না, বাঙালিকেই পুষ্ট করতে হবে। বাঙালির পক্ষে বাঙালি হিসেবে, অর্থাৎ মানুষ হিসেবে বাঁচার আর কোনো পথ দেখি না।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আসলে অভিন্ন এবং দুই-ই নির্ভরশীল সমাজতন্ত্রীদের সফলতা-ব্যর্থতার ওপর। কেননা ইতিহাস এ দেশের বুর্জোয়াদের ইতোমধ্যেই নাকচ করে দিয়েছে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখাটি ৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে যায় যায় দিনে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে সংগৃহীত। ঐ পত্রিকায় নিবন্ধটির নাম ছিল ‘বাঙালির বাঁচামরা’। বর্তমান শিরোনামটি রোদ্দুরের সম্পাদকের দেয়া।

Leave a Comment

error: Content is protected !!