পূরবী সম্মানিত
কবি ও ছোটগল্পকার

সকাল সকাল মমতার মায়ের ফোন।
-হ্যালো..হ্যালো… শুনছিস,কতক্ষণ ধইর্যা ফোন করছি, কোথায় ছিলি?
-এইতো,ওয়াশরুমে ছিলাম …বল মা, তোমার শরীর ভাল আছে তো ?
-আমার জন্য ভাবিসনা ,আমি আছি কোন রকম। শোন, যার লাইগ্যা ফোন করেছি, তুই জানস্ কিছু? অসুরটার ফাঁসির আদেশ হইছে। সকালে খবরে দেখলাম।
-হ্যাঁ মা, আমিও শুনেছি।
-কিন্তু অসুরটা তো পলাতক এখনো। ধরা পড়বো তো? রায় কার্যকর হইবো তো? -মা আশঙ্কায় থাকেন ।
মমতা জানে, মা কাকে অসুর ভাবে। মায়ের কণ্ঠে অস্থিরতা নাকি স্বস্তি? মমতার স্মৃতিতে নাড়া খায়।
রায় কার্যকর হলে মায়ের বুক থেকে শোকের পাথরটা নেমে যাবে? ভুলতে পারবে সখী রূপালীকে?
-সেই ঠা ঠা শব্দে হাসি, মাথায় ঘন কালো চুল, হাত ভর্তি চুড়ির রিনিঝিনি, আদরে বৌদি বলে গলা জড়িয়ে ধরা?
রূপালী ট্র্যাজেডী মমতার জন্মেরও বছর খানেক আগের । উনিশ’শ সত্তরের । দেশ জুড়ে তখন চরম উত্তেজনা । যুদ্ধ, না পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল? কোনো পথে এগোচ্ছে দেশ ? পাকিস্তানিরা বাঙালিদের মরণ কামড় দিচ্ছে,পাকিস্তান-পন্থিরাও সুযোগ নিচ্ছে। এলাকার ঘরে ঘরে তখন চুরি ডাকাতি। লোকজন রাত জেগে পাহারা দিতো। কারো ঘরে সুন্দরী মেয়ে থাকলে তো কথাই নেই; আর তা যদি হয় হিন্দু ঘরের, তাদের স্বাভাবিক ঘুম উড়ে যেতো দুঃশ্চিন্তায়।মমতাদের অনেক হিন্দু প্রতিবেশী এই অস্থির সময়টায় ইন্ডিয়া চলে গেছে।তাদের মধ্য কেউ কেউ যেতে না পারায় হতাশ হয়ে,ভাঙা মনোবল নিয়ে এখানেই থেকে গেছে।কেউ কেউ ইন্ডিয়া থেকে প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব খুইয়ে ফিরেও এসেছে।
সবই মা -ঠাকুমার কাছ থেকে ছেলেবেলায় শোনা স্মৃতি। মমতা এখন শৈশব, কৈশর, যৌবন পেড়িয়ে প্রৌঢ়ত্ব ছুঁয়েছে। সেই স্মৃতি বহুবর্ষজীবি বৃক্ষের মতো শেকড়-বাকড় ছড়িয়ে আজও এক বিমূর্ত অবয়ব হয়ে জড়িয়ে আছে মমতার চেতনায়। চারপাশের পরিস্থিতি কখনো সেটাকে আরো মূর্ত, আরো জীবন্ত করে তোলে।
মমতার ঠাকুমা গল্প বলতে জানতেন। মমতার ভাই বোনেরা ঠাকুমাকে ঘিরে গল্প শুনতো। রাক্ষস–খোক্কস, দেও–দৈত্য ,ভূত-প্রেত, উকুন বুড়ি ,গল্প ছাড়াও এ পাড়ার ও পাড়ার সত্যি কাহিনীগুলি গল্পের মতো করে বলতেন। সব শেষে বলতেন জীবন্ত রাক্ষসের গল্প ‘অইল কী, দেশে তহন বিরাট গন্ডগোল চলতাছে। যাক্, হেই কথা তোমরা বুঝবানা। খালি বুঝ, বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা পড়না?হেই মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে। রাক্ষসরা সুযোগ বুঝে মানুষের ঘরে ঘরে হানা দিতো। একদিন অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার, পাড়ার সব পুরুষ মানুষরা যাত্রা দেখতে গেছেগা। নামকরা নাইক্যা জোস্না আইছে তো, ‘নূরজাহান’ যাত্রাপালায় নূরজাহানের পার্ট করবো । যাত্রা দেখতে লোকে লোকারণ্য। হেই সুযোগে সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে ভাট বাড়িতে রাক্ষস ঢুকলো-মুখে চুন কালি মাইখ্যা।
-চুন কালি কেন ঠাকুমা? -মমতারা বলতো।
-বুঝ না? না অইলে তো রাক্ষসরে হগলে চিইন্যা ফালাইবো। রাক্ষসটা হগলের চেনা তো!
-তারপর, তারপর কী অইল ঠাকুমা?
-কি আর অইবো- ধুম ধুম কইরা ঘরে ঢুকলো । ভাট বাড়ির রাজকন্যা তহন মায়ের লগে শুইয়া শুইয়া গল্প করতেছিল। রাক্ষস ঘরে ঢুইক্যা ছুঃ মাইর্যা মুখে চাপা দিয়া ভাট বাড়ির রাজকইন্যারে নিয়া চইল্যা গেলো।
-হেই বাড়ির মানুষরা কিছু কইলোনা?
-কইবো কিবায়? বাড়ির হগল ঘরে ঘরে শিকল টাইন্যা দিছে। আর রাজকন্যার মা বাবারে তো দড়ি দিয়া বাইন্দা রাখছিল। কত কান্নাকাটি করছে হেরা ‘আমার মাইয়ারে ছাইর্যা দেও।তোমাদের পায়ে ধরি। আমাদের হগল কিছু নিয়া যাও, আমাদের মাইয়াডারে রাইখ্যা যাও।’
-তাও ছাড়ে নাই? -মমতারা অবাক হয়ে বলতো।
-রাক্ষসদের তো মায়া -দয়া নাইরে দিদি।
-তারপর হেই রাজকইন্যার কী অইল ঠাকুমা?
কী আর অইবো-
‘এই ছেড়িরে ধর, ডুলির ভিতর ভর।’-রাজকন্যারে ডুলির ভিতরে ভইরা রাখলো ’
এই পর্যন্ত বলার পর ঠাকুমা ফুঁপিয়ে কাঁদতেন ।
-ঠাকুমা কাঁদছ কেন?
-চোখে পোকা পড়ছে, খালি ক্যাডর ক্যাডর করছ্।যাতো! রাক্ষসে তোরারেও ধইরা নিয়া যাইবো!ঠাকুমা রেগে গেলে তুই করে বলতেন।
রুপালীকে নাকি ঠাকুমা মেয়ের মতো আদর করতেন, আদরের লোভে প্রায়ই পূবপাড়া থেকে পশ্চিমপাড়ায় মমতার ঠাকুমার কাছে এসে থাকতো রূপালী।
মমতাদের ছেলেবেলায়, রূপালীর গল্প মুখে মুখে শোনা যেতো; মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি আর্মি-রাজাকার-আলবদরদের তান্ডব, মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প,যুদ্ধের গল্প, কে কিভাবে পালিয়ে বেঁচেছিল এইসব গল্পের সঙ্গে। কিংবা তারো আগের ঘটনার সঙ্গে রুপালীর ঘটনা মিলেমিশে লোকের মুখে মুখে চলতো তখনো- স্বাধীন দেশে, তখনো কারো ভয়ে চুপি চুপি। অপহরণকারি-খুনিকে সবাই জানতো। রূপালীর খুনকে ঘিরে ভয়ানক সব গল্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল -আতঙ্ক তৈরী করার জন্য। ভয়ে কেউ মুখ খুলতোনা।
বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার পথে রূপালী গল্পের কিছু অংশ শুনতো মমতা-
-রূপালী পিসিরে না ড্রামে সিদ্ধ কইরা রাক্ষসে খাইছে।
-মিছা কথা,নাইলে তুই ভুল জানস্। রাক্ষসরা সিদ্ধ মাংস খায়না ,কাঁচা খায়।রুপালী পিসিরে কাঁচা কুচি কুচি কইরা খাইছে।
মমতার বাবা-মা চুপি চুপি কথা বলতো-
-যুদ্ধ শুরু অইল, রুপালীর ঘটনাও ধামাচাপা পড়লো। স্বাধীন দেশের পুলিশও এইডা নিয়া আর নাড়াচাড়া করেনা,দেখ্ছ?
-নাড়াচাড়া অইবো কেমনে? দেশে অহন কত কাজ! তবে একদিন অইবো। যুদ্ধ শুরু না অইলেও দেখতা।প্রদীপ দারোগা বাঘের বাচ্চা,গোয়েন্দা পুলিশও নামছিল,দেখ নাই ,জাইল্যা নামাইয়া শালুক বিল থাইক্যা রূপালীর জামা -কাপড় হাড্ডি, চুল কেমন বাইর করলো ?
-প্রমাণ লুপাট করনের লাইগ্যাই তো মেয়েডারে মারছিল।বিয়াতে রাজি করাইতেও চাইছিল নাকি !রূপালী রাজি অয় নাই।–বলে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন।
রূপালীর বাবা দীনেশ ভাটের কথা মনে পড়ে মমতার। অবিন্যস্ত লম্বা চুল- দাড়ি-নখ, হাটু পর্যন্ত খাকি হাফ প্যান্ট-শার্ট, হাতে পিতলের ঘটি -ভিক্ষা করতে আসতেন, দেউড়িতে দাঁড়াতেন। ঠাকুমা বলতেন-ভিক্ষা দেও বৌমা। মমতারা ভয়ে দরজার পিছনে লুকাতো, মা ভিক্ষা দিলে চুপচাপ চলে যেতেন। অবাধ্য বাচ্চারা পাগলের মতো দেখতে লোকটার পিছু নিতো। দীনেশ ভাট কাউকে কিছু বলতেন না। গুটিয়ে থাকতো শামুকের মতো।
সমবয়সী লোকেরা বলতো- কিয়ের লাইগ্যা এই দেশে পইর্যা রইছ ভাট? আত্মীয়-স্বজন হগলেই তো ওপারে গেছেগা , তুমি ফিইর্যা আইলা কিয়া? ভাইপো নিতেও আইলো, যাও নাই কিয়া ভাট?
সাধারণ ভাবে উত্তর দিতেন না ,কথাও বলতেন না কারো সাথে। মাঝে মাঝে বলতেন-হে যদি আইয়ে।
-আর আইছে,তোমার কী মাথা খারাপ?
কখনো কখনো আকাশের দিকে মুখ করে মা-মা বলে ডাকতেন ।
একমাত্র মেয়ের শোকে স্ত্রী মরেছিল ক’দিনের মাথায়। ভাই-জ্ঞাতিরা নামমাত্র দামে জমিজমা বিক্রি করে রাতারাতি ভিটে ফেলে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিল। মমতা ভাবে,ওদের ইন্ডিয়া যাওয়ার সাথে রুপালীর অপহরণের কোন সম্পর্ক ছিল কী? কিংবা এমনও তো হতে পারে ওদের ইন্ডিয়া যেতে বাধ্য করার জন্যই এই অপহরণ। কি জানি! এ নিয়ে তো কোন তদন্ত হয়নি । দীনেশ ভাটও ভাই-জ্ঞাতির সাথে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিল , দু’দিন পর মেয়ের টানে খালি ভিটেয় ফিরে এসেছিল, কপর্দকহীন- সবাইকে অবাক করে।
মমতা মনে করতে চেষ্টা করে দীনেশ ভাটকে-লোকটার নিস্প্রভ চোখ, যেন খোলসের ভেতর বসবাস করা এক মানুষ, হয়তো মানুষই নয়, তেলাপোকার মতো দৌড়ে পালিয়ে বাঁচা এক প্রাণী? কিন্তু মানুষটার বুকের ভেতর কী আগুন জ্বলতো না? চাইতেন না খুনের বদলে খুন? কিংবা যে সব কারনে কোন অপেশাদার খুনি মানুষ, খুনি হয়ে ওঠে? তেমন কোন প্রেষণা কী তিনি অনুভব করতেন না? রাক্ষসটা প্রতিদিন ভাট বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতো-সকাল বিকাল। নিজের মেয়ের অপহরণকারী –খুনি, চোখের সামনে হাঁটছে, ঘুরছে, লোকে খুনিকে মান্য-গন্য করছে, আদাব-সালাম দিচ্ছে, যতই হোক টাকা পয়সা ক্ষমতা-প্রতিপত্তির ভয়ে। করছে তো! দীনেশ ভাটের মনে কোন প্রতিক্রিয়া হতোনা? দীনেশ ভাটের তো কোন পিছুটান ছিলনা, ইচ্ছে হলেই তো পারতো রাক্ষসটাকে খুন করতে, কিংবা কোন একটা চেষ্টা!কেন করেনি ? আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, ভয়? হবে হয়তো। নাকি নিজের বদলা নেবার প্রবৃত্তিকে দমন করে করেই লোকটা পাগল হয়ে গিয়েছিল? লোকটার এই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টা নিয়ে মমতা আজও ভাবে । ভাট বাড়ি নিশ্চিহ্ন হওয়ার মতো; দীনেশ ভাটও ত্রমশ: পাগল -একদিন খালি ভিটেয় মরে পড়ে রইল।
ইতিহাস সামনে আসে । সময় পেছন ফিরে অতীতের হিসাব নেয়। খুন ,ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, পাকিস্তানিদের সহযোগিতা, দালালী, পথ চিনিয়ে দেয়া, দেশত্যাগে বাধ্য করা’র মতো ঘটনার সাথে রূপালীর ঘটনাও সামনে আসে। ইতিহাস খুঁড়ে বেড়িয়ে আসে রূপালীর সেদ্ধ রক্ত- মাংস- হাড়।
মমতা শুধু এখনকার ঘটনাগুলির সাথে রূপালীর ঘটনা মিলিয়ে নেয়।পান্না, রুপা, নূসরাত, আমিনা, পার্বতী….কিংবা অন্য যে কোন সহিংস ঘটনার মধ্য। রূপালীর সময় থেকেই নারীর প্রতি সহিংসতার শুরু? না তারও আগে থেকে,তারও অনেক আগে,বহু যুগ ধরে…।
অসুরটার অন্যায় অত্যাচারের বিচার হইল তাইলে? -মমতার মা বলেন।
হ্যাঁ মা, দেখো একদিন সব হবে, রূপালীদের মৃত্যুর মিছিলও শেষ হবে। –মমতার চোখে এক তপ্ত প্রত্যয়ের দৃঢ়তা ।
রোদ্দুরে ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।