আমরা আগে বাঙালি, না আগে মুসলমান সে নিয়ে এক সময় একটা বিতর্ক ছিল; বিজ্ঞজনেরা বলতেন যে বিতর্কটি নিতান্তই অহেতুক, কেননা একই সঙ্গে বাঙালি ও মুসলমান হতে কোনো অসুবিধা নেই। বাঙালিত্ব ও মুসলমানত্বের ভেতর বিরোধ যে নেই সেটা সত্য; কিন্তু তবু বিরোধ তো একটা তৈরি করা হয়েছিল এবং সেই বিরোধটা যখন তুঙ্গে উঠলো তখন অখণ্ড বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করা ছাড়া উপায় রইলো না। তাতে বাঙালির যে কতো বড় সর্বনাশ ঘটেছে সেটার পরিমাপ করা অসম্ভব। কিন্তু ঘটনার অল্প পরেই বেশিরভাগ বাঙালি বাস করে যেখানে সেই পূর্ববঙ্গে আওয়াজ উঠলো যে, ভুল হয়ে গেছে, আমরা আগে বাঙালি, তারপরে মুসলমান। দাবি উঠলো ওই ‘সত্যে’র বাস্তবায়নের। ফলে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হয়ে গেল, প্রতিষ্ঠা হলো বাংলাদেশের। বাংলাদেশে আমরা আগে বাঙালি, পরে অন্যকিছু-মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান ইত্যাদি।
ব্যাপারটা আত্মপরিচয়ের। বাঙালি নিজেকে বাঙালি বলেই পরিচয় দেবে, এটাই স্বাভাবিক, ঠিক যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে, আমরা সেভাবেই বলবো আমরা বাঙালি বটে। কিন্তু কাকে আমরা বাঙালি বলবো? নিরিখটা কী? প্রথম নিরিখটা পরিষ্কার। সেটা হলো বাংলাভাষার চর্চা। তাকেই বাঙালি বলা যাবে, যে বাংলায় কথা বলে, এই সংজ্ঞাটা সহজ। কিন্তু অবাঙালিও বাংলা বলতে পারে। তাই কেবল বাংলা বললেই বাঙালি হবে এটা বলা যাবে না। একটু এগিয়ে গিয়ে বলতে হবে যে, সেই হচ্ছে বাঙালি যে বাংলাভাষার চর্চা করে এবং অন্য বাঙালির সঙ্গে সহমর্মিতা অনুভব করে-তাদের দুঃখে কাতর হয়, তাদের আনন্দে উৎফুল্ল এবং সকলের উন্নতি চায়। এই যে সহমর্মিতা এর একটা নাম সামাজিকতা, আরেকটা নাম দেশপ্রেম।
সামাজিক হওয়া চাই, দেশপ্রেমিকও হওয়া চাই, নইলে নয়। অর্থাৎ এক কথায় বাঙালি হতে হলে মানুষ হতে হবে। সামাজিকতা ও দেশপ্রেম মনুষ্যত্বেরই অংশ বটে, অপরিহার্য অংশ। যে মানুষ সামাজিক নয়, যে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, সমাজে থেকেও দূর দ্বীপে কিংবা গহীন অরণ্যে বসবাস করে, একদিন নয়, দীর্ঘদিন, সবসময় সে লোকটি মানুষের মতো হলেও ঠিক মানুষ নয়। কেননা মানুষ প্রকৃত অর্থেই হচ্ছে একটি সামাজিক প্রাণী; তার বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয়ানুভূতি, জ্ঞান, রুচি যা কিছুকে মানবিক গুণ বলে আমরা জানি সবকিছুই সামাজিকভাবেই বিকশিত হয়। একা কোনো কিছুই সৃষ্টি বা অর্জন করা সম্ভব নয়। আমরা এও বলতে পারি যে, সামাজিক হলেই দেশপ্রেমিক হওয়া সম্ভব।
আসলে বাঙালি হওয়া মানেই মানুষ হওয়া। পরিপূর্ণ অর্থে মানুষ হওয়া। আর সেটা হওয়া ক্রমশ যে কঠিন হয়ে পড়েছে তা একটি বাস্তবিক সত্য বৈকি। এই যে পহেলা বৈশাখ আসে, আবির্ভাব ঘটে বাঙালির নববর্ষের, তখন অন্তত একদিনের জন্য বাঙালি হয়ে উঠলাম বলে আমরা মনে করি। সকলে নয় এমন কি নববর্ষের অনুষ্ঠানে যারা যোগ দেয়, তাদের ভেতরেও সবাই নয়।
বৈশাখ মানুষে মানুষে যে বৈষম্য সেটাকেই উন্মোচিত করে দেয়। এমন কি অল্প সংখ্যায় যারা উৎসবে অনুষ্ঠানে যোগ দেন তারাও কাছাকাছি হন বটে, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হন না, সামাজিক হয়ে ওঠেন না। সমাজে সামাজিকতা কি নেই? আছে, অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা এখন পারিবারিক হয়ে পড়েছে। এমনকি পরিবারের সবাই যে একত্র হবে তাও হয় না। পরিবার আয়তনে বড় হয়েছে এটা যেমন সত্য, পরিবারের ভেতরও বৈষম্য দেখা দিয়েছে এটাও মিথ্যা নয়; কোথাও কোথাও বৃদ্ধি পেয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ভাগবাটোয়ারার লড়াই, উত্তরাধিকার নিয়ে সংঘর্ষ। ফলে সামাজিকতা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে। পারিবারিক এবং বন্ধুবান্ধবের মিলনের বাইরে বড় জায়গায় গিয়ে যে মিলবো এমনটা দেখা যায় না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অভাব, খেলাধুলার জন্য মাঠ নেই, এমনকি জনসভাও এখন আর আগের মতো হয় না। আমরা সঙ্কীর্ণ হচ্ছি, ক্ষুদ্র হচ্ছি, ফলে মনুষ্যত্ব খর্ব হয়ে পড়ছে। আর মানুষ্যত্ব যদি না থাকে, তাহলে তো আমরা মানুষই থাকবো না, বাঙালি হবো কী করে ? পারছি না, হতে পারছি না।
মাতৃভাষার চর্চাটা দরকার। খুবই দরকার, অত্যাবশ্যক বলা যায়। সবাই মিলে বাংলাভাষার চর্চা করবো, তাতে আমাদের আত্মসম্মান বাড়বে, আমরা পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসবো, একে অপরকে বুঝবো, আমাদের শিক্ষাদীক্ষা একই রকম হবে। বৃদ্ধি পাবে সামাজিকতা তথা মানুষ্যত্ব।
“জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি” এবং “বাঙালীর জাতীয়তাবাদ” গ্রন্থের লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক। বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য এবং প্রগতিশীল মার্কসবাদী আন্দোলনে প্রভূত অবদান রেখে এই লেখক এখন জীবন্ত কিংবদন্তি। ২৩ জুন, ১৯৩৬ তারিখে জন্মগ্রহণ কারী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত।