রাশিয়ার প্রায় সমস্ত বড় শহরের শ্রমিক ল. ন. তলস্তয়ের জীবনাবসান প্রসঙ্গে ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে এবং কোনো-না-কোনোভাবে এই লেখকের প্রতি মনোভাব জানিয়েছে, এই যে-লেখক এমন কতকগুলি শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছেন যাতে তাঁর স্থান হয়েছে পৃথিবীর মহালেখকদের মধ্যে, তারা মনোভাব জানিয়েছে এই চিন্তাবীরের প্রতি, যিনি সমসাময়িক রাজনীতিক ব্যবস্থা আর সমাজব্যবস্থার বুনিয়াদী উপাদানগুলো সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন বিপুলে ক্ষমতা, আত্মপ্রত্যয় আর আন্তরিকতার সঙ্গে। মোটের উপর, তৃতীয় দুমায় [১] শ্রমিক প্রতিনিধিদের পাঠানো তারবার্তায় এই মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে, সেটা সংবাদপত্রগুলিতে ছাপা হয়েছে।
ল. তলস্তয়ের সাহিত্যিক কর্মজীবন শুরু করার সময়ে ভূমিদাসপ্রথা তখনও ছিলো, কিন্তু স্পষ্টতই তখন সেটার দিন ফুরিয়ে এসেছিল। রাশিয়ার ইতিহাসের দুটো সন্ধিক্ষণ ১৮৬১ আর ১৯০৫ সালের অন্তবর্তী কালপর্যায়ই তলস্তয়ের প্রধান ক্রিয়াকলাপের সময়। এই সমগ্র কালপর্যায়ে দেশের সমগ্র আর্থনীতিক (বিশেষত গ্রামাঞ্চলে) এবং রাজনীতিক জীবনে পরিব্যাপ্ত ছিল ভূমিদাসপ্রথার চিহ্নগুলো, তার প্রত্যক্ষ অবশেষগুলো আর তার সঙ্গে সঙ্গে এটা ছিল নিচ থেকে পুঁজিতন্ত্রের ত্বরিত বৃদ্ধি এবং উপর থেকে তার পরিবাপনের কালপর্যায়।
ভূমিদাসপ্রথার জেরগুলো প্রকাশ পেয়েছিল কিসে? সেটা প্রকাশ পেয়েছিল প্রধানত এবং সবচেয়ে স্পষ্টভাবে এই বাস্তব অবস্থাটার মধ্যে : মোটের উপর কৃষিপ্রধান দেশ রাশিয়ায় তখন কৃষি ছিল জেরবার-হয়ে যাওয়া দারিদ্রজর্জরিত কৃষকের হাতে, এই কৃষক সাবেকী আদিম প্রণালীতে কাজ করত পুরান সামন্ততান্ত্রিক আবণ্টিত ভূমিখণ্ডে, সে ভূমিখণ্ডের পরিমাণ ১৮৬১ সালে জমিদারদের সুবিধামতো ছেটে ফেলা হয়েছিল। আর অন্যদিকে, কৃষি ছিল জমিদারদের হাতে, তারা মধ্য রাশিয়ায় জমিতে চাষ-আবাদ চালাত ‘কেটে-নেওয়া জমি’[২], তৃণভূমি, পশুর জলপানস্থল ইত্যাদির বিনিময়ে কৃষকের শ্রম, কেঠো লাঙল আর ঘোড়া দিয়ে। বস্তুত, এটাই ছিলো অর্থনীতির পরেন সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই সমগ্র কালপর্যায়ে রাশিয়ার সমগ্র রাজনীতিক ব্যবস্থায়ও পরিব্যাপ্ত ছিলো সামন্ততন্ত্র। ১৯০৫ সালে রাষ্ট্রের গঠন বদলাবার প্রথম প্রথম ধাপগুলোর আগেকার গঠন থেকে, রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলিতে ভূমিসম্পত্তিবান অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রাধান্যকর প্রভাব থেকে এবং আমলাদের (এদেরও বেশির ভাগ, বিশেষত উপরতলার অংশগুলো ছিলো ভূমিসম্পত্তিবান অভিজাতসম্প্রদায়ের মানুষ) অবাধ ক্ষমতা থেকে সেটা স্পষ্ট প্রতীয়মান।
১৮৬১ সালের পরে বিশ্ব পুঁজিতন্ত্রের ক্রিয়ার প্রভাবে পরেন প্যাট্রিয়ার্কাল রাশিয়া দ্রুত ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। কৃষকেরা ছিল-খেয়ে, তারা মরে শেষ হয়ে যাচ্ছিল, তারা সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছিল যেমনটা আগে আর কখনও হয় নি, ভিটে-মাটি ছেড়ে তারা চলে যাচ্ছিল শহরে। জেরবার-হয়ে-যাওয়া কৃষকদের সস্তা শ্রমের কল্যাণে রেলপথ আর কল-কারখানা নির্মাণ চলছিল তেজী তোড়ে। রাশিয়ায় বৃহদায়তন ব্যবসা-বাণিজ্য আর শিল্পের সঙ্গে একত্রে গড়ে-বেড়ে উঠছিল বৃহৎ ফিনান্স পুঁজি।
পুরন রাশিয়ার সমস্ত পুরন ‘খুটিগুলোর’ এই দ্রুত, যন্ত্রণাকর, তীব্র ভাঙনই প্রতিফলিত হলো শিল্পী তলস্তয়ের রচনাবলিতে, চিন্তাবীর তলস্তয়ের অভিমতে।
গ্রাম-রাশিয়া সম্বন্ধে, জমিদার আর কৃষকদের জীবনযাত্রাপ্রণালী সম্বন্ধে তলস্তয়ের জ্ঞান ছিল অতুলনীয়। তাঁর সৃষ্টি-করা শিল্পকর্মগুলিতে এই জীবনের যে-বর্ণনা আছে সেটা বিশ্ব-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলিরই মধ্যে পরিগণিত। গ্রাম-রাশিয়ার সমস্ত ‘পুরান খুঁটি’ তীব্রভাবে ভেঙে পড়তে থাকার ফলে চারদিকে যা ঘটছিল সে সম্বন্ধে তাঁর মনোযোগ শাণিত হয়ে উঠেছিল, তাঁর আগ্রহ হয়েছিল গভীরতর, মুলগত পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল তাঁর সমগ্র বিশ্ববীক্ষায়। জন্মসূত্রে আর শিক্ষাদীক্ষায় তলস্তয় ছিলেন রাশিয়ার সবচেয়ে উপরতলার ভূমিসম্পত্তিবান অভিজাতসম্প্রদায়ের মানুষ এই পরিবেশের যাবতীয় প্রচলিত মতামত। থেকে ভেঙে বেরিয়ে এসে শেষদিককার রচনাবলিতে তিনি সমস্ত সমসাময়িক রাষ্ট্রীয়, যাজকমণ্ডলীয়, সামাজিক আর অর্থনীতিক প্রতিষ্ঠানাদির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা-আক্রমণ চালিয়েছিলেন, ঐসব প্রতিষ্ঠানের ভিত ছিল জনগণের দাসত্বদশা, জনগণের গরিবি, কৃষক আর সাধারণভাবে ছোট মালিকদের সর্বনাশ, সমগ্র সমসাময়িক জীবনে পরিব্যাপ্ত জুলুম আর ভণ্ডামি।
তলস্তয়ের সমালোচনা নতুন কিছু নয়। ইউরোপীয় আর রুশ উভয় সাহিত্যে মেহনতী জনগণের সহৃদেরা তাঁর অনেক আগে যা বলেন নি এমন কিছুই তিনি বলেন নি। কিন্তু, তলস্তয়ের সমালোচনার অনন্যতার কারণ আর তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য এই যে, কেবল মহাপ্রতিভাধর শিল্পীরই যা থাকে সেই প্রবলতা দিয়ে তাতে প্রকাশ করা হয়েছে ঐ কালপর্যায়ের রাশিয়ার, অর্থাৎ গ্রামীণ, কৃষক রাশিয়ার সবচেয়ে বিস্তৃত জনগণের অভিমতে আমূল পরিবর্তনটা। সমসাময়িক প্রতিষ্ঠানাদি সম্বন্ধে সমসাময়িক শ্রমিক আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সমালোচনা থেকে ঐসব প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে তলস্তয়ের সমালোচনার পার্থক্য এই যে, তলস্তয়ের দৃষ্টিকোণ হলো প্যাট্রিয়ার্কাল অতি-সরল কৃষকের দৃষ্টিকোণ এবং নিজ সমালোচনা আর মতবাদে তিনি হাজির করেছেন সেই কৃষকের মানসতা। ‘একেবারে মূলে পৌছবার চেষ্টায়, জনগণের যন্ত্রণা-দুর্দশার আসল কারণগুলো বের করার চেষ্টায় তলস্তয়ের সমালোচনায় এমন প্রবল হৃদয়াবেগ, এমন ভাবাবেগ, প্রত্যয়জনকতা, তেজ, আন্তরিকতা আর নির্ভীকতা বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে, তার কারণ ঠিক এই যে, বহু, লক্ষ-লক্ষ কৃষকের ভাব-ধারণায় প্রখর পরিবর্তনটা যথার্থই প্রকাশ পেয়েছে এই সমালোচনায় – তারা এমন কৃষক যারা ভূমিদাসপ্রথা থেকে, সবে মুক্তির রাজ্যে এসে দেখল, এই মুক্তির অর্থ হলো সর্বনাশের নতুন-নতুন বিভীষিকা, অনাহারমৃত্যু, শহরবাসীদের নিম্নতর স্তরের মানুষের গৃহহীন জীবন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাদের মনোভাবটাকে তলস্তয় প্রতিফলিত করলেন এমনই যথাযথভাবে যে, নিজ মতবাদের মধ্যে তিনি নিয়ে এলেন তাদের অতি-সরলতা, রাজনীতিক জীবন থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতা, তাদের অতীন্দ্রিয়বাদ, তাদের জগৎ থেকে ফারাক থাকার কামনা, ‘অমঙ্গলের বিরুদ্ধে না-প্রতিরোধ’, পুঁজিবাদ আর ‘টাকার ক্ষমতার বিরুদ্ধে তাদের অক্ষম অভিশাপবর্ষণ। তলস্তয়ের মতবাদে যুক্ত-সমন্বিত হলো লক্ষ-লক্ষ কৃষকের প্রতিবাদ আর হতাশ-মরিয়া ভাব।
সমসাময়িক শ্রমিক আন্দোলনের প্রতিনিধিরা দেখছেন, যেসব কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা চাই এমন জিনিস আছে অজস্র, কিন্তু হতাশমরিয়া হবার নেই কিছুই। যেসব শ্রেণী ধংস হয়ে যাচ্ছে তাদেরই পক্ষে হতাশ-মরিয়া ভাব স্বাভাবিক, কিন্তু মজুরি-শ্রমিকদের শ্রেণীটা রাশিয়া সমেত প্রত্যেকটা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে বাড়ছে অনিবার্যভাবেই, বিকশিত হচ্ছে, হয়ে উঠছে আরও শক্তিশালী। যারা অমঙ্গলের কারণগুলো বোঝে না, নিস্কৃতির কোনো পথ দেখতে পায় না, সংগ্রাম করতে অপারগ, তাদেরই পক্ষে হতাশ-মরিয়া ভাব স্বাভাবিক। এমনসব শ্রেণীর মধ্যে পড়ে না আধুনিক শিল্পক্ষেত্রের প্রলেতারিয়েত।
৭ নং ‘নাশ, পুৎ,
২৮ নভেম্বর, ১৯১০
স্বাক্ষর: . ভ. ই— ইন।[৩]
টিকা:
১. ল. ন. তলস্তয়ের পরম বন্ধু ও শিষ্য ভ. গ. চেকোভের নামে তৃতীয় দুমার সােশ্যাল-ডেমােক্র্যাটিক প্রতিনিধিদের দ্বারা আস্তাপভােতে প্রেরিত তারবার্তার কথা বলা হচ্ছে: ‘প্রতিভাবান শিল্পী, সরকারী গির্জার বিরুদ্ধে আপসহীন ও অপরাজেয় সংগ্রামী, অত্যাচার ও নিপীড়নের শত্র, মত্যুদণ্ডের বিরদ্ধে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদকারী, নিপীড়িতের বন্ধু, এই ব্যক্তিটির মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় দুমার সােশ্যাল-ডেমােক্র্যাটিক গ্রুপ রাশিয়া ও আন্তর্জাতিক প্রলেতারিয়েতের তরফ থেকে গভীর শােক প্রকাশ করছে।
২. ‘কেটে-নেওয়া জমি’ – ১৮৬১ সালে রাশিয়ায় ভূমিদাসপ্রথার বিলােপের সময় কৃষকদের কাছ থেকে জমিদার কর্তৃক ছিনিয়ে-নেওয়া জমি।
৩. লেখক অনুপ সাদি সম্পাদিত ভি. আই. লেনিনের প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্য প্রসঙ্গে, টাঙ্গন ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ৩৯-৪১ থেকে এই লেখাটি রোদ্দুরে ডট কমে সংকলন করা হয়েছে।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।