বিশ্লেষণবিহীন ছোট লেখা বস্তুর সমস্ত দিকের দীর্ঘ বিশ্লেষণ হাজির করতে অপারগ

বিশ্লেষণবিহীন ছোট লেখা হয়ত মনের ছোট একটি ভাব প্রকাশের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ছোট এক দুই বাক্যের লেখা কোনো গবেষণাকর্ম নয়। দার্শনিক চিন্তার অনেক কাজের একটি হচ্ছে বিভিন্ন সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণিটি দর্শনকে নিজ শ্রেণির সেবায় কাজে লাগাতে চেষ্টা করে। ফলে প্রাধান্যকারি শ্রেণিটির চিন্তা সেই নির্দিষ্ট সময়ের প্রভাবশালী দার্শনিকগণ উপস্থাপন করেন। এই উপস্থাপনার ভেতরেই লুকিয়ে আছে ছোট ছোট লেখার ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। ছোট লেখা দীর্ঘ বিশ্লেষণ ও বস্তুর সমস্ত দিকের বিশ্লেষণ হাজির করতে অপারগ।

অনেক তরুণ যারা লেখক হতে চান, বা যারা ইতিমধ্যেই লিখছেন তারা মনের ভাব প্রকাশের জন্য এক দুই বাক্য লিখেন। এঁদের ভেতরে একটি পক্ষ আছেন যারা প্রবন্ধ নিবন্ধ বা নিদেনপক্ষে একটি অনুচ্ছেদ লেখার সামর্থ্য রাখেন। কিন্তু তারা সেটি না করে বিশ্লেষণবিহীন একটি দুটি বাক্য লিখেই লেখার কাজে ইস্তফা দেন। এতে পাঠকের ও বন্ধুদের আকর্ষণ করা গেলেও বন্ধুদের বিশ্লেষণশক্তি নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছি। পাঠ, বই, দলিল (Text, Book, Document) ইত্যাদির যে ভূমিকা মানবজাতি তৈরি করেছে; তাও এসব এক বাক্যের লেখায় নষ্ট হয় বলে মনে করি।

এছাড়াও যে কোনো গবেষণাকর্মে আছে তথ্যসূত্র দেবার প্রয়োজনীয়তা। তথ্যসূত্র আসলে কী কাজ করে? তথ্যসূত্র আপনার কথার সাথে অন্যের কথার যোগসূত্র; এছাড়াও এটি যে শুধু আপনি চিন্তা করছেন তাই নয়; এর আগেও অনেকে তেমন চিন্তা করেছে তা তুলে ধরে।

প্রসঙ্গক্রমে একটি উদাহরণ দেয়া যায়। টলেমি গবেষণা চালিয়েছিলেন, প্রমাণ করেছিলেন সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে। কীভাবে এটি লোকজন প্রায় ১৫০০ বছর বিশ্বাস করেছিলো। কারণ হচ্ছে তিনি সেসবের পাঠ, বই, দলিল হাজির করেছিলেন। তাঁর Almagest বা “Great Compilation” ১৩ খণ্ডের; তাঁর Geographia আট খণ্ডের; তাঁর Terabiblos বইটির নামই হচ্ছে “Four Books”। অর্থাৎ টলেমির ভুল এবং সঠিক সিদ্ধান্তগুলি মোটামুটি ২৫ খণ্ডের রচনাবলী দিয়ে তৈরি।[১][২] উল্লেখ্য তাঁর কিছু কাজ অবশ্যই বিজ্ঞানে অগ্রগতি এনেছে। তবে ভুল জিনিসকে সত্য হিসেবে দেখাতে একের পর এক ভুলকে সত্য বলেছিলেন তিনি। ফলে ২৫ খণ্ডকে ভুল প্রমাণ করতে মানবজাতির প্রায় ১৫০০ বছর লেগেছে। এইটাই পাঠ, বই, দলিল ইত্যাদির অবদান। টলেমির ২৫ খন্ড রচনাবলী একটি বড় মিথ্যাকে তৈরি করেছিল। গোটা মহাবিশ্বের ভুল ছবি এঁকে, অঙ্ক দিয়ে ভুল জিনিসকে সত্য বলে হাজির করার জন্য কি বিশাল দালিলিক প্রমাণ হাজির করেছিলেন টলেমি!

আরো পড়ুন:  আলেক্সান্দ্রীয় দর্শন হচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞানে প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া শহরের অবদান

ঠিক তেমনিভাবে দাসত্বকে ন্যায্য হিসেবে, সামন্তবাদকে ন্যায্য হিসেবে, পুঁজিবাদকে ন্যায্য এবং ন্যায় হিসেবে, বিভিন্ন ভাববাদী বিষয়গুলোকে ন্যায্য ও সঠিক হিসেবে উপস্থাপন করতে সেসব মতের দার্শনিকেরা লাখ লাখ পাঠ, বই, দলিল হাজির করেছে। আমাদেরও সমাজতন্ত্রকে ন্যায্য হিসেবে উপস্থাপনে এই তিনটি জিনিস মানুষের সামনে চাক্ষুষ বয়ান দ্বারা হাজির করতে হবে। পুঁজিবাদীরা প্রতিদিন হাজার হাজার পৃষ্ঠা, কোটি কোটি বাক্য লিখছে, লেখতাছে, আমাদের উচিত সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কোটি কোটি লেখা হাজির করা।

লেখা হাজির করার অর্থ প্রচারে হাত লাগানো। প্রচারের প্রথম করণীয় হচ্ছে মার্কসবাদ লেনিনবাদ ও মাওবাদের প্রচার। এগুলো প্রচার করতে গিয়ে জনমত তৈরি হবে। প্রথম স্থিতিশীলতার ও আত্মরক্ষার ধাপ হিসেবে এই জনমত তৈরিই জরুরি। জনমত তৈরি হলে মার্কসবাদের করণীয় পথ বের হবে।

কিন্তু জনমত তৈরি এবং লেখা হাজির করলেই হচ্ছে না, মার্কসবাদী বিশ্লেষণ পদ্ধতিও থাকা দরকার। মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন তাঁদের গবেষণায় প্রচুর সূত্র দিয়েছেন। সূত্র দেয়ার অর্থ হচ্ছে এটি ঐতিহাসিক গবেষণা। কোনো মনগড়া ব্যাপার নয়। মাও সেতুং লিখেছেন,

“হেগেল ও ফয়েরবাখ থেকে মার্কস দর্শন শিখেছিলেন, তার অর্থনীতি ছিল ইংল্যান্ডের রিকার্ডো ও অন্যান্যদের থেকে, এবং ফ্রান্স থেকে কাল্পনিক সমাজতন্ত্র তিনি অধ্যয়ন করেন। এগুলো সবই ছিল বুর্জোয়া। এ থেকে এক দুই-এ বিভক্ত হয়ে গেল এবং মার্কসবাদের সৃষ্টি হলো। আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, মার্কস যখন কমবয়েসি ছিলেন তখন কি তিনি কোনো মার্কসের লেখা পড়েছিলেন?”[৩]

মার্কসবাদের সারমর্ম সম্পর্কিত নানামুখি ধারনা, তত্ত্ব ও মতবাদকে প্রচার করতে হবে, জনগণের বিশাল অংশকে মার্কসবাদের সমর্থকে রূপান্তর করতে হবে, এসব বিষয় সম্পর্কে শত শত গ্রন্থ রচিত হতে হবে। এরকম লেনিনবাদ এবং মাওবাদ সম্পর্কেও অনেকগুলো বিষয় আসবে। সাথে বিবেচনা করা দরকার বিশ শতকের গোটা পৃথিবীর বিদ্রোহগুলোর সারসংক্ষেপ। রুশপন্থী পার্টিগুলোর শান্তিবাদি হয়ে যাওয়ার কারণ বিশ শতকের বিদ্রোহগুলো বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে।

আরো পড়ুন:  বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণ কাকে বলে?

একা লেনিন ৫৪,০০০ পৃষ্ঠা লিখেছিলেন, সাথে ভাবুন প্রচারণার ও কাজের হ্যাপা। মাওয়ের দার্শনিক চিন্তাগুলোর লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে কর্মের ফলেই বের হয়েছে। বাংলাদেশে কি করা হয়েছে তা নিয়ে মূল্যায়ন অনবরত করা হচ্ছে। শতশত কমরেড দায়িত্ব গ্রহণ করলেই জনমত তৈরি হবে। ইউরোপের বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত দুধরনের পার্টি গঠনের ইতিহাসকেই দেখতে হবে। উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি, পার্টি গঠন, পলিটব্যুরো, কেন্দ্রীয় কমিটি, পার্টি কংগ্রেস ইত্যাদি চিন্তাতে সমস্যা আছে।

প্রথমত, মালেমাবাদের প্রচার করতে আমাদের অসুবিধা নেই। অর্থাৎ মূল টেক্সটগুলো আমরা প্রচার করব, নিজেরা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বুঝবো। দ্বিতীয়ত, যদি মালেমাবাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতার সমালোচনা করতে হয়, তবে সেইভাবেই সমালোচনা করব যা সাম্রাজ্যবাদী প্রচারমাধ্যমের মতো না শোনায়। কেননা যে সমালোচনা তারা লুফে নেবে সেরকম সমালোচনা সাম্রাজ্যবাদ ও তার পক্ষের অন্য মতাদর্শের সহায়ক হবে। তৃতীয়ত আমরা অভ্যন্তরীণভাবে সুবিধাবাদ, সংশোধনবাদ, মতান্ধতাবাদ, নৈরাজ্যবাদ, অর্থনীতিবাদ, উদারতাবাদের বিরোধিতা করব; এসব বিষয় জানা বোঝার চেষ্টা করব। চতুর্থত, সমসাময়িক উত্তেজনায় গা না ভাসিয়ে আমাদের মত তুলে ধরব। সমাজে এবং দেশে বুর্জোয়ারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি করে বড় ঘটনা ঘটায়, আর সব দেশপ্রেমিকেরা অনবরত সামাজিক প্রচারমাধ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরকম সমসাময়িক উত্তেজনায় গা না ভাসিয়ে দীর্ঘমেয়াদি মুক্তির লক্ষে কাজ করার জন্য মতামত প্রদান ও কাজ করব। প্রলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলনে যেহেতু আমাদের সম্পৃক্ততা করার চেষ্টা দরকার।

তরুণ বুদ্ধিজীবী, প্রচারকদের জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধতা হবে শক্তির ভিত্তি; তাত্ত্বিকদের সাহিত্য প্রচার ও পাঠ তৈরি করবে দালিলিক ভিত্তি; পুরনোদের সাথে ঐক্যবদ্ধতা আনবে অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধি। মার্কসবাদের প্রচার ও কর্মসূচি নির্ধারণে ছোট লেখাকে বিরোধিতা করার এইগুলোই আমাদের কয়েকটি কারণ।

তথ্যসূত্রঃ

[১] https://www.geolounge.com/ptolemys-geographia/

[২] https://www.britannica.com/biography/Ptolemy

[৩] মাও সেতুং, ১৯৬৪; একটি আলোচনার সময় মন্তব্য।

Leave a Comment

error: Content is protected !!