প্যারাডাইস লস্ট হচ্ছে ইংরেজ কবি জন মিল্টনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা মহাকাব্য

প্যারাডাইস লস্ট বা প্যারাডাইজ লস্ট (ইংরেজি: Paradise Lost) হচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ কবি জন মিলটনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা একটি মহাকাব্য। ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণে দশ হাজার লাইনের শ্লোকযুক্ত দশটি খণ্ড ছিল। ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দের পরে দ্বিতীয় সংস্করণটি ছোট ছোট সংশোধনসহ বারটি খণ্ডে সাজিয়ে প্রকাশিত হয়। এই মহাকাব্যের কাহিনী অংশ বাইবেল থেকে গৃহীত। এরূপ একটি ঘটনা বিরল কাহিনীর কাঠামোয় বারো সর্গের এই কাব্য দাঁড়িয়ে আছে, অথচ কখনো মনে হবে না, উপকরণের অভাব আছে কোথাও।[১]

স্বর্গ থেকে সদলে শয়তান বিতাড়িত হয়েছিল আর নিক্ষিপ্ত হয়েছিল নরকে। সেখানে সে পরামর্শকদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে ছলে বলে কলে কৌশলে এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে। ঈশ্বরের নতুন সৃষ্ট জীব, মানুষ তার উদ্দিষ্ট। সেই মানুষের সন্ধান পেলো এই পৃথিবীতে, ইডেন উদ্যানে, প্রথম নারী ইভকে প্রলুব্ধ করলো ওদের জন্য নিষিদ্ধ জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে। ফলে, নিস্পাপ মানুষ পাপী মানুষে পরিণত হলো। এবং সেই আদি পাপের শাস্তি, দুঃখকষ্ট পরিশ্রমের জীবন, ও জীবনের শেষে মৃত্যু, মাথায় নিয়ে বেরিয়ে এল ফিদাউসের নিরাপত্তা থেকে। অবশ্য বেরিয়ে আসার আগে মুক্তির আশ্বাসও নিয়ে এল। ঈশ্বরপুত্র যীশুই মানুষের পাপ নিজের মাথায় তুলে নিয়েছেন, এবং তার আত্মদানের মধ্য দিয়েই তিনি মানুষের মুক্তি আনার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।[২]

মানুষের পতনের কাহিনীই ‘প্যারাডাইস লস্টের’ জটিল রূপকল্পের কেন্দ্রবিন্দু। মানুষের সংগে ঈশরেব সম্পর্কসূত্র এবং খ্রিস্টের ভূমিকার তাৎপর্য মিলটনের রচনার মূল বিচার্য। শয়তান (Satan) ও বিদ্রোহী দেবদূতগণ (Rebel Angels) সামগ্রিক বিচারে গৌণ। তারা কেবলমাত্র আদম ও ইভের পতনের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেছে এবং শয়তান নয়, আদমই সমগ্র কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র। যদিও প্রথম দুটি গ্রন্থে শয়তানকেই ‘প্যারাডাইস লস্টে’র নায়ক বলে ভ্রম হয়। অনেক সমালোচক অদম্য ও অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন শয়তান চরিত্রের প্রতি মিলটনেব দুর্বলতা লক্ষ্য করেছেন এবং তাকেই নায়ক বলে চিহিত করতে চেয়েছেন। বারোটি গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বিচারে এ অভিমত গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। ঈশ্বরানুরাগী, শুদ্ধবাদী মিলটন তো ঈশ্বরের কার্যাবলীকেই যথার্থ প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে ‘প্যারাডাইস লস্ট’ রচনা করেছিলেন।

প্যারাডাইস লস্ট কাব্যগ্রন্থের বারটি খণ্ড

আলোচনার সুবিধার্থে এই মহাকাব্যের বারোটি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত, পর্যায়ক্রমিক বিবরণ দেওয়া হলো:

গ্রন্থ এক (Book i): শয়তান, তার সহযোগী বেলজিবাব (Beelzebub) ও অন্য পতিত দেবদূতদের জলন্ত নরককুণ্ডে নিদারুণ পীড়িত হতে দেখিয়েছেন মিলটন। শয়তান তার ওজস্বী বক্তৃতায় জাগিয়ে তুলেছে তার বাহিনীকে। নির্মিত হয়েছে তাদের মন্ত্রণাগৃহ ( Pandemonium)। শয়তান ও তার অনুচরেরা নতুন চক্রান্তে লিপ্ত। 

গ্রন্থ দুই (Book ii): মন্ত্রণাসভার নতুন করে যুদ্ধ করার বিষয়টি আলোচিত হয়। কিন্তু স্থির হয় নতুন সৃষ্টিপ্রাপ্ত পৃথিবী ও তার প্রাণীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার। শয়তান স্বয়ং এ দায়িত্ব গ্রহণ করে ও নরক থেকে নির্গত হয়। 

গ্রন্থ তিন (Book iii): শয়তানকে উড়ে আসতে দেখেন ঈশ্বর সিংহাসন থেকে। মানুষের পতনের চক্রান্তে শয়তানের সাফল্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন তিনি। ঈশ্বরের পুত্র মানবজাতির পরিত্রাণে নিজেকে সমর্পণ করেন। শয়তান ইউরিয়েলের পরামর্শে মানুষের খোঁজে এসে নামে নাইফেটিস পর্বতে।

গ্রন্থ চার (Book iV): এখানে ইডেন উদ্যানের বর্ণনা রয়েছে। এই উদ্যানেই শয়তান প্রথম সাক্ষাৎ পায় আদম ও ইভের। তাদের জ্ঞান বৃক্ষের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত আলোচনা আড়ি পেতে শোনে। সে ইভকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে স্বপ্নে। ধরা পড়ে ইডেন থেকে বহিস্কৃত হয়।

গ্রন্থ পাঁচ (Book V): ইভ তার দুঃস্বপ্নের কথা আদমকে জানায়। ঈশ্বর রাফায়েলকে পাঠান আদমকে সর্তক করতে। আদমের অনুরোধে শয়তানের কুকর্মের কাহিনী শোনান রাফায়েল।

গ্রন্থ ছয় (B))Vi): রাফায়েল বিবৃত করেন কিভাবে মাইকেল ও গ্যাব্রিয়েল শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। কিভাবে শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের পুত্র একক আক্রমণে শয়তানের বাহিনীকে পর্যদস্ত করেন। তারা স্বর্গ থেকে অতল গর্ভে নিক্ষিপ্ত হয়।

গ্রন্থ সাত (Book vii): রাফায়েল আরো বিবরণ দেন কিভাবে ঈশ্বর এ পৃথিবী সষ্টির সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তাঁর পুত্রকে নিয়োগ করলেন এই সৃষ্টিকার্য ছয় দিনে সমাপনের।

গ্রন্থ আট (Book Viii): আদম মহাকাশে বিভিন্ন বস্তু সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে রাফায়েলকে। রাফায়েলের সংগে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়েও আদমের কথা হয়। দেবদত,অতঃপর বিদায় গ্রহণ করেন।

গ্রন্থ নয় (Book ix): সর্পরূপী শয়তান ইভকে প্ররোচিত করে নিষিদ্ধ ফল খেতে। ইভ এরপর আদমকে দেয় সেই জ্ঞানবৃক্ষের ফল। উভয়েই তাদের সহজ সারল্য হারিয়ে ফেলে। পতিত হয়। 

গ্রন্থ দশ (Book X): ঈশ্বর তাঁর পুত্রকে পাঠান নির্দেশ অমান্যকারীদের বিচারে। পাপ, তার ফল হিসেবে মত্যু শাস্তিস্বরূপ ঘোষিত হয়। নিজ সাফল্যে উৎফুল্ল শয়তান নরকে ফিরে আসে ও সমস্ত পতিত দেবদূতেরাই সাপে রূপান্তরিত হয়। আদম-ই শাপমুক্তির অভিপ্রায়ে ঈশ্বর পুত্রের কাছে অনুতাপ জানায় এবং নিজেদের সমর্পণ করে।

গ্রন্থ এগার (Book xi): ঈশ্বর আদম ও ইভকে স্বর্গ থেকে নির্বাসিত করেন। মাইকেল এই আদেশনামা কার্যকর করতে আসেন। দেবদূত আদম-ইভকে একটি পর্বতচূড়ায় এনে মায়ের ভবিষ্যৎ দুর্দশার এক চিত্ররূপ দেখান।

গ্রন্থ বার (Book xii): মাইকেল আরো বিবৃত করেন কিভাবে মানুষের ত্রাণকতার আবির্ভাব ঘটবে। জানান তাঁর মৃত্যু, পুনরুজ্জীবন ও স্বর্গারোহণের ভবিষ্যত ঘটনাবলী। পরিত্রাতার দ্বিতীয় আগমন (Second Coming) ও স্বর্গ পুনরুদ্ধারের কথাও শোনান মাইকেল। আদম ও ইভ স্বর্গ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়।[৩]

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, “প্যারাডাইস লস্ট মহাকাব্য প্রসঙ্গে”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/literature/paradise-lost/
২. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, স্যামসন অ্যাগনিসটিজ, বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ, মার্চ ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ১০।
৩. কুন্তল চট্টোপাধ্যায়, ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস, জে এন ঘোষ এন্ড সন্স, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারী ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ৯৪-৯৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!