মৃত্যু এসে নিয়ে যাক শৃঙ্খলিত প্রাণ

জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই জন্মেছো তুমি,

উঠেছো বেড়ে কন্টকাকীর্ণ সুবিস্তীর্ণ জনমানববহুল মাঠে,

তোমার মাথার উপরে গভীর পুঁজভর্তি সাদা আকাশ,

প্রভাত সূর্য অতিরুগ্ন বৃদ্ধের মতো লাঠি ধরে

এগিয়ে আসে ঘন দেয়ালের ভিতর দিয়ে,

অথচ তুমি জানো না আজো এদেশে

রাত্রি নামে ঘুষখোরের মতো বীরদর্পে,

তোমার মহানিয়ন্ত্রককে তুমি চোখে দেখোনি

কিন্তু উপনিয়ন্ত্রকের পা টিপে দাও,

গোসল করাও, রাত্রিকালে অবাধ সঙ্গ দাও।

 

তোমার পিঠের উপরে অনন্ত আঘাতের চাবুক,

তোমার মাথা বিক্রি হয়ে গেছে জেনে তোমার

স্ত্রী বা বোন, মা বা মেয়ে বড়র্কতার বাসার ঝি হয়ে

টকজল টেনে নেয় ঢেঁকির কোটরে;

দাঁতহীন বয়স্ক পুরুষ পুঙ্গবটি তাদের স্তনে মুখ চেপে টকটক

শব্দে বুঁদ থাকে, চটাঙ চটাঙ শব্দ করে

শিহরণে মাতিয়ে তোলে স্বর্গ-মর্ত-পাতালের বায়ু।

তাদের এসব অতি স্বাভাবিক;

তোমার রক্ত শুধু পরাধীনতার জল

তোমার রক্ত শুধু বরফ আসমুদ্রহিমাচল।

 

হে বহুজাতিক নদীসমুহ,

তোমাদের দুই পাড়ে কত সভ্যতার কারুকার্যময় সৌন্দর্য জন্ম নিলো,

জন্ম হলো দাসত্ব শৃঙখলিত নিষ্প্রাণ অট্টালিকা;

কয়লাখনি ও কারখানার শ্রমিকের ঘামে ঘুরলো সভ্যতার চাকা,

সেই চাকা— নিষ্পেষণের চাকা থামলো না থামছে না;

শ্রমিকের দুই হাত দুই পায়ে বাঁধা আছে অপুষ্টি ব্যধির শিকল

হীরা খুঁজতে গিয়ে খাড়া পাহাড়ের গায়ে ঠেস দেয়া মই দিয়ে ভার নিয়ে

উপরে উঠতে গিয়ে তারা উঠে যায় আকাশের ওইপারে।

ছোট বাড়ির উঠানে অহেতুক

মারা যায় একঝাঁক পায়রা-চড়ুই শক্তির ঘৃণ্যতায়,

নিয়মিত পাওয়া যায় পাশের রাস্তায় দারিদ্র ভুলে থাকা গাঁজা ও মদ,

সুদের শাসন, অক্টোপাসি মহাজন;

স্যাঁতসেঁতে সাতজনের খুপরি ঘরে মরণযাপন।

 

রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজনে খনির নিচে নামো, উপরে উঠো,

বয়স ও বোঝার ভারে অবনত সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে কর্মসিক্ত,

চামড়া কেটে বসে গেছে শরীর ও বোঝায় বাঁধা অতিশয় শক্ত মোটা দড়ি,

তোমাদের সহকর্মি শ্রমিকেরা মাকড়ের মতো থিকথিক করা পোকা-মানুষের

আরো পড়ুন:  বুড়ি বসন্ত

জীবনযাপনে ক্লান্ত, কোথায় পাবে তোমরা বন্ধুর হাত,

দৌড় শুধু দৌড়— থামবার নেই ফুরসত

খাদ্য কুক্ষিগত করবার দৌড়।

 

হে শ্রমিক, দাঁড় টেনে, গুন টেনে,

বোঝা বয়ে, গাড়ি ঠেলে, নির্মাণে মাথা ঠেলে, মাটি বয়ে,

তেল ঝুল গায়ে মেখে, কারখানায় মাটি আর পাথরের চাঁইয়ের সঙ্গে

গৃহস্থালি করে, রাজনীতির কোলাহলে গতর ডুবিয়ে

তবুও টিকে আছো অমর প্রাণী;—

সভ্যতার ভারে নুব্জ ভাঙা খাটিয়ার মাঝখানে

মৃত্যুর প্রত্যাশায়। 

 

চিত্রের ইতিহাস: কবিতায় ব্যবহৃত অংকিত চিত্রটি ক্রিস্টোবাল রোজাসের (১৮৫৭-১৮৯০) আঁকা চিত্র দুঃস্থ (La miseria)। শিল্পী ছবিটি আঁকেন ১৮৮৬ সালে। এখানে চিত্রটিকে উপরে নিচে ছেঁটে ব্যবহার করা হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!