ইতিহাসের রাজপথে আজ রাতে উড়ছে ধূলাবালি,
মরুঝড়ে আটকা পড়ে থমকে গেছে কিছুক্ষণ ট্যাঙ্কের অগ্রাভিযান,
তবুও যুদ্ধ তার শক্ত পিঠে উড়ায় পদচিহ্ন,
গেঁথে নেয় শরীরে মৃত আর জীবিতের ভুলগুলি;
জঙ্গি বিমানের ককপিট হতে যারা উড়ে এসে দূরে বসে প্রাণ দিলো বলি
যাদের নির্দেশে— তাদের হৃদপিন্ডে শুধু রক্ত ঝরানোর রক্ত আছে;
তাদের আঙুলে আছে অমোঘ শক্তি,
তাদের হাতে আছে মানব বন্দির নিক্তি।
রক্তে ভেসে যাক পৃথিবীর সব ধূলিকণা,
সমগ্র ইরাক দখলে নিতে কেউ থামাতে পারবে না,
ক্ষমতার স্বার্থে তারা সমগ্র পৃথিবী দখলে নিতে চায়,
কামানের গোলা আর মর্টার শেলের আঘাতে রাতের আকাশ কাঁপায়,
বৃষ্টির মতো ঝরে মাটিতে গুচ্ছ গুচ্ছ বোমা,
মৃতেরা কি ডাকতে পারে আমাদের রক্ষা করো মা?
যে শিশুটির হাত দুটো উড়ে গেছে যুদ্ধের দাবানলে
হাত সে কোথায় পাবে এই ভয়াবহ রাত শেষ হলে;
যে মায়ের বুক হতে চলে গেছে বুকের প্রতিমা
সেই মায়ের কান্নার দামটুকু সভ্যতা দিতে পারবে না;
যে তরুণি সুখের সময়টুকু হারিয়েছে আগ্রাসনের গ্রাসে,
প্রতিশোধ প্রত্যাশি হৃদয় তার পতাকা হয়ে উড়ছে বসরার আকাশে;
পৃথিবী বাঁচে কী না বাঁচে তাতে যুদ্ধবাজের কী যায় আসে?
২.
সম্পত্তি লুটতে হবে তাই
এসে পড়েছে হানাদার,
আক্রমণ করছে তারা
তোমার শরীর,
মায়েদের খালি বুক,
পেছনে হাত দুটো বেঁধে
মুখে চটের বস্তা পেঁচিয়ে
তোমাকে বন্দি শিবিরে
বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
অর্ধমৃত অবস্থায় তোমার গায়ে
করেছে পেচ্ছাব,
মৃত তোমাকে ফেলে এসেছে
কিছুক্ষণ পরে সদর রাস্তায়,
তুমি দেখেছ তোমার পাশে
শুয়ে আছে তোমার মৃত মা বাবা
ভাই এবং তাদের পাশে এখনো ডুকরে কাঁদছে
তোমার সেনা ধর্ষিতা বোন
যাকে মৃত ভেবে সেনারা ফেলে চলে গেছে।
তোমার বন্ধু বন্দি আছে
আবু গারিব জেলে,
তার সারা গায়ে
গু ঢেলে
জোর পুর্বক হাঁটিয়েছে তাকে
পাখির মতো পাখা মেলে,
হয়নি মুক্তি তার
জেল হতে জিয়তকালে।
৩.
এসে গেছে একালের ত্রাস মহাসন্ত্রাসি
আছে তার ক্ষুধা এবং শক্ত মাংসপেশি
ত্রাস তৈরি করে কেড়ে নেবে ফুলের বাগান
সভ্যতার জন্মভুমে মারা যাক শত শত মানুষের প্রাণ
শুধু তেলে আগুন মেশালেই দেখা কী যায় দিগন্তে আলো
অন্ধকার তার চেয়ে আগ্রাসিরা বাসে বেশি ভালো
রাষ্ট্র চায় রাষ্ট্র চায় তারা একটা আস্ত রাষ্ট্র চায়,
সাম্রাজ্য না বাড়ালে দাদা দেশবাসিকে কী মিঠাই খাওয়ায়,
বাগদাদে মার্কিন সেনা আকাশে মাটিতে চলছে তুমুল লড়াই।
৪.
ফুসফুস টুকরো টুকরো,
পা দুটো গেছে উড়ে,
গাল নেই একজনের,
হাত নেই,
হৃদপিন্ড থেমে আসছে,
মাথার খুলি এলোমেলো,
পায়ের গোড়ালি পড়ে আছে মাটিতে,
দজলা ও ফোরাতের জলে ভাসছে কয়েকটি মৃত মানুষের লাশ,
মাছের খাবার হয়েছে মানব শরীর,
বাতাসে মাংসের পচা গন্ধ,
লাশকাটা ঘরে লাশের স্তুপ,
হাসপাতালের মেঝেয় রক্তের কালসিটে স্রোত,
উড়ছে মাছি,
ক্যামেরার লেন্স খোঁজে ব্যতিক্রমী আহত শরীর,
ছুটছে সাংবাদিক ও মৃত্যু পাশাপাশি,
কেউবা পড়ছে ঢলে মৃত্যুর কোলে,
ডাক্তারের কন্ঠে গান,
ব্যথানাশক ওষুধ নেই
ক্ষতবিত ক্ষত……,
৫.
গুজবের স্রোতে ভাসছে সবাই ডুবেছে সারা দেশ,
কালাশনিকভ রাইফেল হাতে যুদ্ধে তরুণেরা,
মায়েরা সব বাঁচতে গেছে শত্রুর দরজায়,
পলায়নকারি আজ দুহাতে গড়ছে প্রতিরোধ,
দুঃস্বপ্নের সুদীর্ঘ রাত হচ্ছে দীর্ঘতর,
ঘুমহীন চোখে বোমার শব্দে রাত্রি ফুরায় না,
আহত শিশুর গাল বেয়ে চলে টাইগ্রিসের স্রোত,
মাথার ভেতরে শব্দে শব্দে ঘনিভুত সাইরেন,
পুব পশ্চিমে চারিদিকে শুধু উদ্বাস্তুর দল,
দেখছে বৃষ্টি আসছে বৃষ্টি বৃষ্টি তোলপাড়।
তারা এখন পারে শুধুই রক্ত ঝরাতে,
কাটতে পারে মাংস তারা হৃদপিন্ড হতে,
আক্রমণে ভাঙে হাড়গোড় প্রাচ্য সভ্যতার,
চুরি করে যাদু-ঘরের অবশিষ্ট প্রাচীনতার
ভাস্কর্যহীন টুকরো ঘরে কিছুই নেইকো আর।
৬.
শান্তি আসুক পৃথিবীর শহরে গ্রামে সকল কোণায়,
শান্তি আসুক পাঠাগার স্নানাগার রঙধনুর কোমল আভায়,
শান্তি আসুক ধানখেতে কফি কাপে কৃষকের চিলেকোঠায়,
যুদ্ধহীন পৃথিবী সব শুভবাদি গড়ে যেতে চায়,
যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছাড়া মানুষের অন্য পথ নাই,
অস্ত্র শস্ত্র আগ্রাসন বলে আর কিছু থাকবে না,
অনাগত শিশুরা কোনোদিন যুদ্ধ দেখবে না,
তারা ট্যাঙ্ক গোলা যুদ্ধ বিমান দেখবে যাদুঘরে,
ইতিহাস পড়বে আর হাসবে হো হো করে।
৭.
এইবার বাঙলার বসন্তকালে
নাসিরিয়া উমকাসর বসরার উপকুলে
অগণিত পুষ্পবৃষ্টির বদলে ঝরে পড়ছে অগ্নিবৃষ্টি
ক্যালডিয় নারীর বুকের কোলাহলে
সপ্তাহের সাত দিনই ঢাকা পড়ে গেছে মরুঝড়ে,
হাডসন নদীর জলে টেমসের দুই কূলে রক্তের ঢেউ,
দাঁত চোয়াল কিডনি যকৃত পায়ের হাড়গোড়
ভাজি করে খাওয়া হবে ব্যাবসা ভালো হলে,
দূরদর্শনে শোনা হবে জাতীয় সংগীতের বাজখাঁই সুর,
চতুর্থ স্তম্ভের পাতায় দুমড়ানো শহরের ছবি
প্রতিদিনের আড্ডায় ঠান্ডা হয়ে জমে গেছে …….,
মানব চর্বি পোড়া গন্ধ ভাসে মেসোপটেমিয়ার বাতাসে
পলাশীর প্রান্তর এখন ঘোড়ায় চড়ে চলে গেছে বাগদাদের চারপাশে,
হালাকু খাঁনের তলোয়ারে উড়ে যাবে প্রাণবন্ত শিশির
রাষ্ট্র জুড়ে খোলা হবে অগুনতি মুক্তি শিবির,
রাষ্ট্রের পতাকায় মাখা হবে রক্তের রঙিন আঁচড়।
এই বসন্তকালে
ইরাকের কৃষিভূমি ঝলসানো আগুনে অসাড় বিষ মাখা,
কৃষকের ত্বকহীন দেহে শুধু দিনযাপনের সুতীব্র কামনা,
একদিন বাঁচা হলে হবে তাদের সপ্তমাশ্চর্য দেখা,
একদিন বাঁচা হলে ভালো লাগবে তোমার কবিতা,
একদিন বাঁচা হলে পড়া হবে তোমার চিঠি,
প্রতিদিন বাঁচা গেলে টিকে যাবে মানব জীবিতা।
৮.
বাসন্তি শহরে শুধু রক্তের চির কোলাহল,
অগ্নিধোঁয়া দেখে শিশু ভুলেছে মাতৃবোল,
তাদের ঘরে ফাঁদপাতা বীভৎস রাতের আন্ধার,
রক্তে ভেজা মাটি হতেই লুপ্ত হবে ভেদাভেদ সবার,
এসেছো কোথায় খুনি, এসেছো কার নির্দেশে,
আটকে রেখেছো কেন তোমার আত্মীয়াকে বদ্ধ দেশে;
তুমিই একদিন হেঁটেছিলে ধ্রুপদি গ্রিসের পথে,
সুমেরিয় এশিরিয় ক্যালডিয় সভ্যতার রথে,
সুশোভিত সভ্যতার শস্যখেতে সযতনে বীজ বুনেছিলে,
এক হাজার এক রাত নিশ্চিন্তে কাটিয়েছিলে
মেসোপটেমিয়ার কোনো সুন্দরির ঘরে,
দিনগুলো বয়ে যেতো চুমু খেয়ে তার অধরে,
নেবুচাদ নেজারের ঝুলন্ত উদ্যানে শুয়ে শুয়ে
নক্ষত্রের গতিবিধি দেখেছিলে;
ভালোবাসার পরির্পূণ দাম দিয়েছিলে;
সেই তুমি আজকে
করছো হত্যা অগণিত বন্ধুর প্রাণ!
চিত্রের ইতিহাস: কবিতায় ব্যবহৃত আলোকচিত্রটি অজানা আলোকচিত্রীর তোলা। ছবিটি মার্কিন সরকারের কোনো সামরিক অফিসার কর্তৃক সরবরাহকৃত। এখানে চিত্রটির উপর ও নিচ দিকে সামান্য ছেঁটে ব্যবহার করা হয়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।