চোখে আধো ঘুম থাকুক অসুবিধে নেই,
অস্ত্রহাতে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়া যায়,
শহরের চারদিকে আছে বহু সেনাকর্মিদল;—
তারাই দেখবে কারা পালালো এ-দেশ হতে রাবারের পিচ্ছিল পথ বেয়ে।
অলিগলি ফুটপাথে শহরের বন বাদাড়ে
ফোয়ারার জলের মতো উল্কাবেগে ছুটছে
জনস্রোতের রক্তধারা;
ছয় আঙুলের মাকড়সারা এ-সুযোগে
তৈরি করছে ক্ষুন্নিবৃত্তির সাধ মেটাতে
ঘুঁজিতে বৈদ্যুতিক জাল, গলিতে বৈদ্যুতিক ফাল।
বাঙলার খালি খালে বিলে
অতিথি পাখির কলকাকলিতে
ডুব দিয়ে তোমরা দুজন পালালেও
দূরে দূরতম দেশে পাবে না কোথাও খুঁজে স্বাধীন পাখার পাখি;
পেছনে রয়েছে গুলিভরা তাক করা মেশিনগান,
দুহাতে মৃত্যু চেপে ধরে ছুটে চলা ঝাঁকে ঝাঁকে
গাঙকবুতর আর মানিকজোড়ের দল পাবে না কোথাও সাধের ফাল্গুনি ভিটে;
হয়তো কোথাও তোমরা দুজনও ক্লান্তির পরে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে
সঙ্গতাকে গিলে ফেলবে আগ্রাসি পরিবেশ,
অপমান ঘৃণা ক্রোধ পুড়ে পুড়ে ছাই হবে;
সেই ছাইয়ে দাঁত মেজে দাঁত চকচকে করে
কতজনই হাসবে উল্লসিত অট্টহাসি;
দেবে দাওয়াই প্রতিদিন
‘কোনো তন্ত্রমন্ত্রই ভাই এখানে চলবে না একমাত্র হুযুগে মাতম ছাড়া,
এই বেশ চলছে ভালো; জমিদারের থুথু খেয়ে বেঁচে আছি তো’।
তীতুমিরের প্রাণের কেল্লা ভেঙে ফেলেছি
আমরা নব্য হিন্দু — মুসলমান,
আজ তাই কিল্লার মোড়ে চিল্লা মারে শত শত হায়েনা শয়তান।
শুধু পতাকার স্বাধীনতা নিয়ে কেউ একজন মনে মনে কাঁদে
আর মোটাভূঁড়ি লোকগুলো বিদেশি চক্রবলয়ে যোগাযোগ রেখে
সারা গায়ে দুহাতে মাখে সুশোভিত শান্তির তেল
আর কুটুম্বিতা পাতে ভিনদেশি ব্যবসায়ীর সাথে;
স্বাধীনতা বেচে দিয়ে সব পড়শিরা সাজে জাতিয়তাবাদি,
ফাও ফাও কে যেন মোহনলালের নাম করে
ছুটে আসে তরবারি হাতে জীবাশ্ম হতে।
কলকাতা কিঙবা ঢাকায় আগের মতো অভাব আর নাই,
পিঠে নেই কালসিটে দাগ,
জয়নুলের মড়া খেকোদের হাড়ে হাড়ে মাংসের মণ্ডা মিঠাই;
শুধু বোধ বুদ্ধিহীন নাদাপেটা হাঁদারাম
ভাবছিলো সঙ সাজবে গোটা দেহে পতাকা পেঁচিয়ে।
শুনি কথোপকথনের ফিসফাস শব্দ—
‘আজকে পাঠানো হলো কতিপয়কে আকাশের পথে’
লঞ্চডুবিতে ডেবে যায় শত শতাধিক,
আয়ুর মালিক স্বয়ং মহামহামান্যগন্য;
বেশাখের বাতাসে উড়ে গণধর্ষিতার তপ্তকণ্ঠ ঘ্যাগ, বোবা কুকুরের ঘেউ ঘেউ,
‘তুমি শালা শুয়োরের পোলা, বিরক্তি উৎপাদক যন্ত্র করো ক্যাঁটক্যাঁট’।
খাঁ খাঁ মরুভুমিতে পুড়ছে শান্তির আলো;
লেলিহান ইতিহাস, ভেঙে গেছে প্রগতিপ্রেম;
আচমকা তুমি এসে যদি বুঝে নিতে আমাদের চকচকে ব্যর্থতার পুরো খতিয়ান
কী জবাব দেবে আমার উত্তরসাধক;
আমরা যে মোটাতাজা জড়ভরত,
বুঝি না আপেক্ষিক ঘাঁত ঘোঁত।
কিছুই করার নেই, করার থাকে না কিছু;
জন্মসূত্রহীন আলো আঁধারির জগত সঙসারে
জন্মের পরেই বুঝেছে পিতৃমাতৃহীন ব্যর্থ বেকার যুবক;
সবকিছু পাওয়া হয়ে গেছে তার;
মত্যুই মেটাবে এক জীবনের শোধ;—
এ-জগতে কবি শুধু বড়োই নির্বোধ।
আর তোমরা মোটাতাজা জড়ভরত,
বোঝো না রাষ্ট্রের আপেক্ষিক ঘাঁত ঘোঁত।
চিত্রের ইতিহাস: কবিতায় ব্যবহৃত আলোকচিত্রটি ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গার ‘Great Calcutta Killings’। সেই দাঙ্গায় প্রায় হাজার দশেক সাধারণ হিন্দু-মুসলিম শয়তানের সাগরেদ মাউন্টব্যাটেন-গান্ধী-নেহেরু-জিন্নাহর ষড়যন্ত্রে পরস্পরকে হত্যা করে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।