সুদূর আকাশ হতে ঝরতে থাকা অস্তিত্বের
ফোঁটায় তোমাকে অনুভব করি, বুঝতে পারি
জলের বুদবুদে ভেসে যাওয়া তুমি শিকড়হীন
নির্বাক কথা বলে যাও দেহের ভঙ্গিমায়,
তুমি কখনো দুরন্ত দুর্বার নদীর জলস্রোতে
দুকুল ছাপানো কীর্তিনাশা,
জলোচ্ছাস ও ঝড়ের দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত;
কখনো তুমি শান্ত নিস্তব্ধ পুকুরের জলে ফুটে থাকা অগনিত চাঁদমালা,
গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা তুমি গাঁয়ের বধুর চাপা কান্না আর
প্রেমিকের সাথে অসময়ে দেখা দেয়ার চুরি করা সময়টুকু,
তুমি নৈশপ্রহরির চোখের পাশে ফুটে থাকা পিটুলি ফুলের ছড়ি,
লাল বকফুল, রক্তের কিনারে সবুজের আয়তাকার পতাকা,
তুমি আকাশ মুক্ত রাখার দৃঢ়প্রত্যয়,
বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কদ্বীপের ব্যর্থতার ভাস্কর্য,
গভীর রাতে হঠাৎ মিছিল ‘সমাজতন্ত্র আসুক,
বটফুলের বীজে ভর করে সারা পৃথিবীর ঘরে ঘরে’।
তুমি জনগণতন্ত্রের মৌমাছি, গেয়ে চলো
শ্বেতসংগীত, কোনোদিন গাব গাছে ঝিমুতে
থাকা বকের ছানার কান্নাভেজা বিনিদ্র হৃদয়;
তুমি অজস্র জীবনের প্রতিভু, পাপড়ি বিলিয়ে দেয়া
আধুনিক শহরের আদুরে রেস্তোরাঁ,
জৈষ্ঠের খরতাপের পরে ঝরঝর বৃষ্টি,
কামনা বাসনার ধুমায়িত উজ্জ্বল শিখা, বাতাবিলেবুর ফুলের ঘ্রাণ,
লিচু গাছের মাথা মুড়োনো জালের ভিতরে
বন্দি থাকা অজস্র পাকা ফল।
তোমার চোখ এখন কারিগরের স্বপ্ন বানায়,
রঙধনুর স্বপ্ন ছড়ায় ছায়াচ্ছন্ন বাঙলাদেশের বাড়ির মাচায়;
তুমি আমার লোমকুপে জ্বেলে দেয়া উল্কা ঘৃণা,
ভাঙা খাটে সবার মায়ের লাশ বহনকারি
গাড়ির অবিরাম ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দের বেসুরো গান;
তুমি গণধর্ষিতা বোনের গগণবিদারি চিৎকার
ভাতার যার ঘর ছেড়ে চলে গেছে শহরে,
চাপা পড়ে মরে গেছে ইট পাথরে,
তুমি এক ব্যাগ রক্তের জন্য ছুটে চলা ভাইবোন—
প্রসুতি-মাতা যাদের হাসপাতালে জন্ম দেবে বলে;
তুমি ফুটপাতের বাস্তুহারা নর-নারীর চাপড়ানো ক্ষতবুক,
রেললাইনের বস্তির পাগলি মেয়েটির সম্মোহনি শরীর;
তুমি জন্ম দাও আজও অজস্র পুরুষ যারা
চেটে পুটে খায় প্রেম ও পেশি অর্থের বিনিময়ে,
যারা খায় পালাক্রমে মেঘনার ইলিশের ঘ্রাণ,
বাউলের একতারা ভাটিয়ালি শিশুর তবলা
ডুগডুগি আর স্মৃতির মেঘে ভাসা বায়োস্কোপ।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের তুমি ব্যর্থ প্রতিনিধি,
সাতকন্যাকে রান্না করে খাওয়া গান্ধীর অহিংস ভারত,
আন্তরাষ্ট্রিক রক্ত ভরা তেলের নল;
তুমি দেখেও দেখ না কত কী,
কেননা চুপ করে থাকাই ডিপ্লোমেসি,
তুমি ছিঁড়ে যাওয়া মানচিত্রের কয়েকটা পরিত্যক্ত টুকরা,
মহানগরের ফুটপাতে হেঁটে চলা বৈচিত্রহীন নাগরিক,
শিহরণহীন পাল তোলা ক্যান্টনমেন্টের শান্তির পতাকা,
মানুষের দেহের পুঁজ ও মাথার উকুনের ঢিবি,
বিদেশি উইপোকার গড়ে তোলা মোহন প্রাসাদ,
তোমার খনিতে রোগজীবাণুর পোয়াবারো সঙসার,
কোমরে লেগেছে ঘুণ, কুরে কুরে খাচ্ছে নাঁড়ি ভুঁড়ি,
ভাগ বাটোয়ারা করেছে তোমার শরীর তোমার সুপুত্রেরা,
অথচ সূর্য প্রতিদিন মেঘদল ভেদ করে তোমার অঙ্গে
গ্রীষ্মকালে ঢেলে দেয় শিরীষ ফুলের আলো।
তুমি এখনো বেঁচে আছো তোমার নিজের মাংস খেয়ে
কেননা তুমি জানো জন্ম সমান মৃত্যু, মৃত্যু সমান ধ্বংস
তবু তুমি প্রতিদিন বকুলের মালা গেঁথে
কাদের প্রতীক্ষায় দাওয়ায় বসে থাক,
রক্তের সাথে রক্ত মিশিয়ে রক্তের ভাই বোন
ভাই ভাই বোন বোন সেজে কাটিয়ে দিতে চাও আরো সহস্র বছর;
অথচ তুমি চাইলেই পেতে পারো ঝকঝকে পার্লামেন্টের সেবা,
দিতে পারো রাজনীতির মিথ্যাভাষণ,
শুধু তুমি এখন জান শুধু পাহাড়েই কেন জ্বললো আগুন,
যেমন জ্বলছে কবিতায়, একদিন জ্বলবে জনগণের ফুলেল পাপড়িতে;
ভরসা ছিলো না যেদিন তুমি অজান্তে
গোবরের উপরে পদদ্বয় রেখে
পিছলে পড়েছিলে নিরাশার চোরাকাদাজলে।
২৬.০৫.২০০২; সূর্যসেন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোকচিত্রের ইতিহাস: কবিতায় ব্যবহৃত আলোকচিত্রটি Nedco তুলেছেন বুলগেরিয়া থেকে। চিত্রটিতে একটি ঘরের অভ্যন্তরের ছাদে মোজাইক করা হাতুড়ি কাস্তেকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এখানে চিত্রটিকে উপরে নিচে সামান্য ছেঁটে ব্যবহার করা হয়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।