আমার কাছে কবিতা-সম্পর্কিত ব্যাপার নিয়ে আসাটাই উচিত হয় নি। ভুল অ্যাপ্রোচ! বেশ লোকের কাছে এসেছেন আপনারা! কবিতার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর অধিবাসী আমি, ও মেরুর প্রায় কোনো খবরই রাখি না, বলতে গেলে অনেকের নামধামই জানি না। ছোটোবেলায় কাব্যি করা, অল্প বয়সের বায়ু-রোগ যাকে বলে, তারই ভিত্তিতে আপনাদের প্রশ্নগুলি সম্বন্ধে ভাবতে পারি।
প্রথমত বলা যায়— কবিতা সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে না এবং তা হলে সে শিল্প, শিল্পই থাকে না। রবি ঠাকুরের ভাষায়— শিল্পকে সৌন্দর্যনিষ্ঠ হতে হবে কিন্তু তার আগে তাকে সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। আজকের সত্য হচ্ছে—আজকের বর্তমান। তা থেকে বেরিয়ে এসে বায়ুভূক শিল্প সৃষ্টির চেষ্টা যাঁরা করেন, তারা সর্বসাধারণের পালিয়ে যাওয়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন। এক কথায় আমরা যাকে বলি— পলায়নী মননধর্মিতা। সেটাও কিন্তু বর্তমান সমাজে নেতিবস্থার স্বীকৃতি। এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায়ই নেই। রাবণে রাম পুজো আর কি…!
আমার কাছে যে-সব কবির নাম করলেন, তাদের কিছু লেখা আমার প্রচণ্ডভাবে ভালো লাগে। রবীন্দ্রনাথের যত কবিতা আমি পড়েছি, তার অর্ধেকের বেশি অচল বলে মনে হয়। বাকি যারা থাকেন তাদের সব লেখাগুলো একত্র করলেও অতদূর পৌঁছোয় না। সেখানে নজরুল বা মুকুন্দ দাস অতীব ছাড়বস্তু। তবু নজরুলের জায়গায় জায়গায় একটু-আধটু ঝিলিক দেখা যায়, কিন্তু তাও তাৎক্ষণিক। আর প্রমুখদের মধ্যে কে পড়েন মশাই?
কবিতা একটি মিছিলের ভূমিকা নিতে অবশ্যই পারে, কিন্তু সেরকম কবিতা বর্তমানের কোনো কবির কাছে আশা করতে পারি না। সেরকম কাঁচা হলেও সুকান্ত, কচিৎ সুভাষ। ব্যাস শেষ! আর এখন? এখন মশায়, মাঝে মাঝে এধার-ওধার ছুটকো-ছাটকা যেসব কবিতা-টবিতা পড়ি— তা যে কী বস্তু, তা আমার ধারণার বাইরে। আরে, এই তো সেদিন আমার এক পরিচিতি ছেলে, কী যেন একটা কবিতার বই হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল। সেও নাকি আজকাল বেড়ে লিখছে-টিখছে। বইয়ের নামটাও ভুলে গেছি, কী যেন ‘ঘাম ধুলো ঘাস’ এ রকম গোছের একটা কিছু হবে; তা, এ আমার বোধগম্যির বাইরে। ইদানীং সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরা নাকি কবিতা লিখছেন। মদটদ খেয়ে কবিতাও নাকি আওড়াচ্ছেন! তা, সেটা শুধু পয়সা ওড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়! এরাও নাকি শুনছি আবার নামটাম করেছে। সিদ্ধেশ্বর সেন আমার বন্ধু লোক হন, এরও কবিতা আমি এক বর্ণও বুঝতে পারে না। আমার সঙ্গে স্টুডিওতে কাজটাজ করে, একেবারে হাল আমলের অনন্য-দেরও লেখাটেখা পড়ে দেখেছি-তা এদের কবিতা কোষ্ঠকাঠিন্যের ফলশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই বলে মনে হয় না। এইসব পড়েটড়ে আর বেশি কিছু আশা করার অবকাশ থাকে কি?
কবিতা মতবাদের ভিত্তি করেও হতে পারে। মতবাদ ভিত্তি করে অনবদ্য কবিতা সৃষ্টি হয়েছে, এদেশেও, বিদেশেও। সৎ ও ক্ষমতাবান একজন সত্যিকারের শিল্পীর হাতে সে ধরনের কবিতা একটা যুগজয়ী রূপ নিতে পারে, এর সম্পূর্ণটা নির্ভর করছে শিল্পীর শৈল্পিক সত্তা ও ক্ষমতার ওপরে। একজন মায়কোভস্কির কাছে যে শুধু ব্যাপারটা কিছুই নয় তাই নয়, ব্যাপারটাই সব। মতবাদের ভিত্তি না থাকলে মায়কোভস্কি জন্মায় না। আমার কাছে কবিতা মানব-অনুভূতির চেতনা বা অভিজ্ঞতা সর্বস্তর থেকে রসাহরণ করে, করেও থাকে। আমার মনে হয় এ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ শিল্পীর মানসিক গঠনের ওপর নির্ভরশীল। মোদ্দা কথাটা হলো — ভঙ্গি। [ঢঙ করে যেটা করা হয়, সেটা আর যাই হোক শিল্প থাকে না] অন্তরের গভীরতম প্রদেশ থেকে যে উপলব্ধি, যাকে আমরা বলি অন্তর্দৃষ্টি, তা উৎসারিত হলে তাই আমার কাছে শিল্প এবং কবিতা। আমি তাই-ই চাই যা সৎ, সত্যদ্রষ্ট এবং সৌন্দর্যনিষ্ঠ।
আজকের জনগণ থেকে কবিতা বিচ্যুত বলেই আমার মনে হচ্ছে। অন্তত আমাদের দেশে। কারণ এদেশে সমাজের শ্রেণীবিন্যাস। আজকের সময়ে আমাদের এই সমাজ প্রচণ্ড ভাঙচুরের মুখে। সাধারণত এদেশে কবিরা যে শ্রেণি থেকে আসেন, সে শ্রেণি হলো নিম্ন মধ্যবিত্ত। সেখানে যে প্রচণ্ড তোলপাড় চলছে। তাতে এরাও বোধ হয় পুরোপুরি খেই হারিয়ে ফেলেছে। নিজেদের শ্রেণি সত্তার ভিত্তি বোধ হয় খুব একটা দৃঢ় নেই। ফলে কবিতা যে সময়ে হাটে মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে পড়া উচিত ছিল, ঠিক সেই সময়ে দেখি বিভিন্ন ‘মুক্ত’ যুক্ত’ ‘গুপ্ত’ মেলাফেলা করে কিছু পেট-রোগা বংশের বদহজম উদ্গার উৎসারিত হয়ে চলেছে। মশায়, এ কখনো জনপ্রিয় হতে পারে? আর এই প্রশ্নের শেষ অংশে যা তুলে ধরেছেন অর্থাৎ জনগণ। দয়া করে জানাবেন এই জনগণ’টা কী? বিড়লা, গোয়েঙ্কা এরাও কি জনগণ নয়? ধরুন একজন কলকারখানার মেহনতী মানুষ বা একজন ভূমি-চাষি আর একজন মার্চেন্ট অফিসের বড়োবাবু এঁরা কি সব্বাই এক? এঁরা কি মিছিলে একই শ্লোগান তুলবেন? নিম্ন মধ্যবিত্ত কবিরা আমার মতে ক্ষয়িষ্ণু। আজকের সাধারণ অর্থে প্রতিষ্ঠিত কবিরা দাঁড়াচ্ছে যাদের ইংরেজিতে বলা যায় Production। Productive অর্থের অংশীদার এঁরা নন। তাই এঁরা শহরে সীমাবদ্ধ পরগাছা বলে আমাদের মনে হয়। এঁরা জীবনবিচ্যুত, এঁদের কাছে কিৎসু আশা করি না। এরা জনগণ থেকে বিচ্যুত।
এবং আমার ছবিতে আধুনিক কবিতা ঢোকাবার কথা সচেতনভাবে আমি কোনোদিন ভাবি নি। এ সম্বন্ধে আমার কোনো বিশাস নেই। তবে যদি ছবির প্রয়োজনে লাগে তবে নিশ্চয়ই তা আমি দেবার কথা চিন্তা করব। তবে কবিতা ব্যবহারের জন্যে কবিতা ব্যবহার করতে হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ কবিতা আমার কাছে কোনো পবিত্র ব্যাপারই নয়। ছবিতে যেমন গানের প্রয়োজনে গান জুড়ে দেওয়া হয়, নাটকের জন্যে নাটক; তেমনি যদি কখনো দেখি কবিতার প্রয়োজন হয়েছে, তা হলে নিশ্চয়ই কবিতা নেব।
ঋত্বিক ঘটক (জন্ম : ৪ নভেম্বর, ১৯২৫ – মৃত্যু : ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) একজন বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম বহুবার বহুভাবে উচ্চারিত। তিনি পরিচালনা করেছেন নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭) প্রভৃতি চলচ্চিত্র।