ব্রহ্মপুত্র নদের উভয় দিকের অববাহিকা অঞ্চল হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা

আসাম অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের উভয় দিকের অববাহিকা অঞ্চলকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা (ইংরেজি: Brahmaputra Valley) অঞ্চল বলা হয়। এই অঞ্চলটি ছোট ছোট টিলা ও সমতল ভূমির সমন্বয়ে গঠিত। আমাদের আলোচ্য অঞ্চলটি নদের উভয় তীরে অবস্থিত।

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাটি গঠিত হয়েছে তিনটি উপ-উপত্যকা নিয়ে। পশ্চিম ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা গোয়ালপাড়া এবং কামরূপের অঞ্চলগুলিকে নিয়ে গঠিত; মধ্য ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছে দরং, নগাঁও এবং উত্তর তীর এবং পূর্ব ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাটি সোনিতপুর, লখিমপুর, ডিব্রুগড় এবং শিবসাগর জেলা নিয়ে গঠিত।

নদীর পশ্চিম অঞ্চলটির সাধারণত ‘নামনি-অসম বা পশ্চিম-অসম’ নামে পরিচিত এবং একইভাবে পূর্ব অংশটি উজানি অসম বা পূর্ব অসম নামে পরিচিত।

উপত্যকার বেশিরভাগ মানুষ হিন্দু, বেশিরভাগই অসমিয়া ভাষা এবং এর রূপগুলি বলে। উপত্যকাটি দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সহজে অভিগম্যতার কারণে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি জনবহুল এবং সমৃদ্ধ।

ব্রহ্মপুত্র নদ ছাড়াও তাছাড়াও কোকরাঝাড় ও ধুবুড়ি জেলায় আরও বেশ কয়েকটি ছোট বড় নদী দেখা যায়। এর মধ্যে প্রধান হলো চম্পাবতী, গদাধর-গঙ্গাধর, গৌরাংগ প্রভৃতি। এই সব নদ-নদীর পারে যেমন বন-জঙ্গল আছে, তেমনি ফাঁকা অঞ্চলে বসতি গড়ে উঠেছে প্রাচীন কাল থেকেই। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানকার সংস্কৃতির বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। এখানকার ভাওয়াইয়া ও গোয়ালপারিয়া গানে এই সব নদ-নদীর নাম প্রায়ই উঠে আসে।

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জন বিন্যাস

উত্তর-পূর্ব সীমান্ত বঙ্গের মতোই পশ্চিম সীমান্ত অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশেও মূলত মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর প্রাধান্য দেখা যায়। এখানেও মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখার সাক্ষাত পাওয়া যায়। যেমন বোড়ো, রাভা, কোচ, হাজং, জলধা, মদাহী প্রভৃতি। এর মধ্যে বোড়ো বা মেট, কোচ ও রাভা জনগোষ্ঠী উভয়দিকেই দেখা যায়। এই তিনটি জনগোষ্ঠী মূলত বোড়োমূলীয় বলে পরিচিত। এর মধ্যে কোচ জনগোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে আসা গোষ্ঠী হলো ‘রাজবংশী’ । কিন্তু রাজবংশী জনগোষ্ঠীকে কোচের পরিবর্তিত রূপ হিসাবে ধরাও যুক্তিযুক্ত নয়, কেন না পরবর্তীকালে অনেক মেচ বা রাভা জনগোষ্ঠীর মানুষও রাজবংশী সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাই এখানকার জনর্বিন্যাস বুঝতে হলে এর অতীত ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা করা দরকার।

আরো পড়ুন:  ভারত ছাড় আন্দোলন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে স্বাধীনতার দাবিতে সৃষ্ট বামপন্থীদের আন্দোলন

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ব্রহ্মপুত্রের উপত্যকা-ভূমিতে গড়ে উঠেছে বহু বিচিত্র জনজাতির বসতি, সাংস্কৃতিক আবহ, সামাজিক-ধর্মীয়-রাষ্ট্রনৈতিক-অর্থনৈতিক বিচিত্রগামিতা, আধিদৈবিক ও মনোসংস্কৃতির নানামুখী ঐতিহ্য, বিশ্বাস, বোধ, আচরণ, ক্রিয়া ও প্রবৃত্তি। অতীতের নানা চিহ্ন এবং মানুষের দৈহিক ও সমাজ-সংস্কৃতির স্বরূপ নির্ণয়ের মাধ্যমে প্রতিভাত নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের বিশেষ রূপটিও আমাদের কাছে বিচিত্র হয়ে ধরা দেয়।

পুরাণ, শাস্ত্রগ্রন্থ, কাহিনী-কিংবদন্তী, ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব, ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু এবং বিভিন্ন ঐতিহ্যিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নৃতত্ত্ব ও মানস-প্রকৃতির আসল পরিচিতি উদ্ধারে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের পণ্ডিত-সমাজ। তাঁদের মধ্যে রমাপ্রসাদ চন্দ, খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লা আহমদ, পদ্মনাথ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক ড. আনন্দগোপাল ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ বসু এবং বাংলাদেশ ও ভারতের বেশ কিছু গবেষক।[১]  নানা মতৈক্য, মতানৈক্য, যুক্তিতর্ক আর ভিন্নমুখী বহুবিধ বক্তব্য সত্ত্বেও এ অঞ্চল বিষয়ে চর্চার ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে কুয়াশার কাল কেটে যাচ্ছে।

আলোকচিত্রের ইতিহাস: তিব্বতের বাক্সোই অঞ্চলের লাইগু গ্লেসিয়ারের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার এই আলোকচিত্রটি তুলেছেন Jiangmy ১৫ মার্চ ২০১২ তারিখে।

তথ্যসূত্র

১. সমর পাল, ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি কথা: পৌরাণিক আখ্যান, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকা, চতুস্ত্রিংশ খন্ড, গ্রীষ্ম সংখ্যা জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, জুন ২০১৬, পৃষ্ঠা ১৩৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!