গঙ্গা-পদ্মা নদী প্রণালী বা গঙ্গা-পদ্মা নদী ব্যবস্থা (ইংরেজি: Ganges-Padma River System) পৃথিবীর বৃহৎ নদীপ্রণালীর মধ্যে অন্যতম এবং এ নদী ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গঙ্গা-পদ্মা নদী ব্যবস্থা বাংলাদেশের ভূমি, বসতি, কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও যাতায়াত ব্যবস্থা অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে অবদান রাখছে। এক কথায় এ নদী ব্যবস্থা বাংলাদেশের জনগণের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত ও তিব্বত সীমান্ত নিকটবর্তী মধ্য হিমালয়ের গাড়োয়াল পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত গঙ্গোত্রী (৩০°৫৯ উত্তর ও ৭৮°৫৯ পূর্ব উচ্চতা ৭২৫০ মিটার, পুরুত্ব ২৩৬ কিমি এবং পরিধি ৭০ মাইল) নামক হিমবাহ থেকে গঙ্গা (পদ্মা) নদী উৎপত্তি লাভ করেছে। গঙ্গোত্রী হিমবাহের পূর্বদিক থেকে আগত অলকানন্দ ও পশ্চিম দিক থেকে আগত ভাগীরথীর সংগমস্থল দেব প্রয়াগ এর দক্ষিণ থেকে মিলিত ধারা গঙ্গা নামে পরিচিত। শিবালিক পর্বতমালা অতিক্রমের পর দক্ষিণবাহী হয়ে হরিদ্বারের নিকট গঙ্গা সমতল ভূমিতে পতিত হয়েছে। এরপর দক্ষিণ পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে এলাহাবাদের নিকট যমুনা ও সরস্বতী নদী গঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছে। পাটনার কিছু পূর্বে ঘাঘরা, বিপরীত দিকে গন্ডক এবং কিছু পূর্বে কোশী বামতীরে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। অতঃপর বিহার হতে রাজমহল হতে ১০০ কিমি ভাটিতে দুইভাগে বিভক্ত হয়। প্রথম শাখা ভাগীরথী কালিনি এবং পরে হুগলী নামে কলকাতা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। দ্বিতীয় শাখাটি গঙ্গা-পদ্মা নামে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা ও বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার মোহনপুর থেকে অতিক্রম করে গোদাগাড়ী, রাজশাহী, চারঘাট, বাঘা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ইত্যাদি অতিক্রম পূর্বক রাজবাড়ি জেলার দৌলতদিয়ার নিকটবর্তী যমুনার (ব্রহ্মপুত্রের ধারা) সঙ্গে মিলিত হয় এবং মিলিত ধারা চাঁদপুরের নিকট মেঘনার সাথে মিলিত হবার পর মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
গঙ্গা-পদ্মা নদীর গাঠনিক বৈশিষ্ট্যর মধ্যে দৈর্ঘ্য, আয়তন, প্রশস্ততা, গভীরতা ইত্যাদি পরিগণিত। উৎস হতে বাংলাদেশের মোহনা পর্যন্ত পদ্মানদীর মোট দূরত্ব ২৬০০ কিমি, প্রবেশ স্থল থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত প্রায় ২২৯ কিমি এবং মেঘনার সঙ্গে মিলিত হবার স্থান পর্যন্ত ১৪৬ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। গঙ্গা-পদ্মা নদীর প্রশস্ততার পরিসীমা ১.৬ কিমি থেকে ৮ কিমি এবং নদীটি কখনও বিনুনী ও কখনও সর্পিল প্রকৃতির। ভারত, নেপাল, চীন ও বাংলাদেশ নিয়ে এর অববাহিকা অঞ্চল যার মোট আয়তন প্রায় ১০৯৩২০০ বর্গকিলোমিটার
সারণী: গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার স্থানিক বিন্যাস:
দেশ | মোট আয়তন বর্গকিমি | শতকরা হার |
নেপাল | ১৪৭৪৮০ | ১৩.৫৬ |
ভারত | ৮৬০০০০ | ৭৯.০৯ |
চীন | ৩৩৫২০ | ৩.০৮ |
বাংলাদেশ | ৪৯২০০ | ৪.২৭ |
মোট | ১০৯৩২০০ | ১০০.০০ |
রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, খুলনার উত্তরাংশ নিয়ে বাংলাদেশের গঙ্গা অববাহিকা গঠিত যার মিলিত আয়তন প্রায় ৪৯২০০ বর্গকিলোমিটার।
১৯৮০ সালের ভূউপগ্রহ মানচিত্র হতে দেখা যায় যে, উজানে নদীখাতের গড় প্রশস্ততা ৫.১৭ কিমি, ভাটিতে ৭.৪৮১ কিমি, বাকের চরের সংখ্যা ৫ টি, নদীগর্ভে চরের সংখ্যা ১৯ টি বাঁকের সংখ্যা ৯ টি এবং বক্রতার সূচক ১.৩২ ছিল। নিম্নদিকে বক্রতার সূচক হ্রাস পেয়েছে। অতএব নদীখাতের ধরন তীর ক্ষয়ের ধরন ও সঞ্চয়ের ধরন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে পদ্মানদী নদীখাত নকসার ধরন প্রসারতা বা Reach type হতে চলেছে।
পানিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যাবলী: পানি নির্গমন, পানিতল, বন্যা ঘটন সংখ্যা, পলল নির্গমন মাত্রা, বিপদসীমা, বন্যা স্থায়িত্বকাল ইত্যাদি পানিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত। যেমন
পানি নির্গমন ও পানিতল: গঙ্গা-পদ্মা পুরাতন নদী হলেও পানি নির্গমন ও পানিতল রেকর্ড অতি সাম্প্রতিক কালের। ১৮১০ সাল হতে পানিতল ও ১৯৩৪ সাল হতে পানি নির্গমন তথ্য পাওয়া যায়। পদ্মানদী দিয়ে সর্বোচ্চ প্রায় ২৫ মিলিয়ন কিউসেক পানি নির্গমন হয়ে থাকে এবং সর্বনিম্ন ৪২০০০ কিউসেক। তবে ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাধ নির্মাণ ও পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারণে গড় বার্ষিক নির্গমন ৪১২০০০ কিউসেক। সর্বোচ্চ ২৬ মিলিয়ন কিউসেক, সর্বনিম্ন ৪২০০০ কিউসেক ও বর্ষাকালে ৭৫০০০ ঘন মিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে মাত্র ১৫০০০ ঘনমিটার পানি নির্গমন হয়ে থাকে। অপরদিকে সর্বোচ্চ পানিতলের পরিমাণ ৪৮ ফুট এবং সর্বনিম্ন ১৮.৯ ফুট।
গঙ্গা-পদ্মা নদী দ্বারা প্রতি বছর প্রায় ১৬০০ মিলিয়ন টন ভাসমান বোঝা পরিবাহিত হয়ে থাকে। এ নদীতে সাধারণতঃ আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বন্যা হয়ে থাকে।
গঙ্গার শাখানদী ও উপনদীসমূহ:
পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে নিম্ন গঙ্গার উল্লেখযোগ্য শাখা নদীগুলো হচ্ছে, ভাগীরথী, হুগলী, মাথাভাঙ্গা, ইছামতি, ভৈরব, কুমার, কপোতাক্ষ, চিত্রা, নবগঙ্গা, গড়াই, মধুমতি এবং আড়িয়াল খা অন্যতম। এগুলোর মধ্যে গড়াই-মধুমতির পশ্চিমস্থ নদীগুলো পূর্বতন গতিপথ হারিয়ে অতিমাত্রায় রুদ্ধ অবস্থায় পরিণত হয়ে পড়েছে। যে অঞ্চল দিয়ে এই নদীগুলো প্রবাহিত সে অঞ্চলটিকে মৃতপ্রায় বদ্বীপ বলা হয়। গড়াই মধুমতি পূর্বদিকের নদীগুলো এখনও সক্রিয় এবং এ অঞ্চলে বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
গঙ্গা-পদ্মা নদী ও ফারাক্কা বাঁধ:
গঙ্গা নদী এর অববাহিক অঞ্চলের প্রাণ। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষি, বসতি, পরিবহণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নদীর কার্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষের অভাবনীয় কষ্টের কারণ হয়ে দাড়ায়। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্ত হতে ১৬ কিমি দুরে ভারতের অভ্যন্তরে ১৯৭৫ সালে নির্মাণ করা ফারাক্কা বাধ। এই বাঁধের দ্বারা ভারত ইচ্ছামত পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। নিম্নে ফারাক্কা বাঁধ কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যাগুলো তুলে ধরা হলোঃ
১) শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি ধরে রেখে ভারত তাদের ইচ্ছামত সেচ কাজে ব্যবহার করছে। কিন্ত বাংলাদেশ অংশে পানির অভাবে কৃষি ব্যাহত হচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানি স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় পানীয় জলের সমস্যা দেখা দিচ্ছে, সেই সাথে অনেকের মতে আর্সেনিক সমস্যাকে পানি স্তর নীচে নেমে যাওয়ার জন্য দায়ী করা হয়।
২) শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদী বক্ষে চর পড়ছে বেশি মাত্রায়।
৩) পানির প্রবাহ কমে গেলে জোয়ার ভাটার পানির চাপ এসে পদ্মার নিম্নপ্রবাহ এলাকায় পৌছায়। ফলে এই মিঠা পানি প্রবাহিত নদী অঞ্চলে লোনা পানির অনুপ্রবেশ কৃষি ভূমির উর্বরতা হ্রাস করছে।
৪) বর্ষা মৌসুমে ভারত অতিরিক্ত পানি ফারাক্কার মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। ফলে হঠাৎ করে আসা পানি বাংলাদেশে পদ্মা অববাহিকা অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে।
৫) নদী বক্ষে চর পড়া আর বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে আসা প্রচুর পানির তোড়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নদী ভাঙ্গনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়াও ইহা আরও বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ ফারাক্কার নির্মাণকাল হতে বর্তমান পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে আলোচনা ও চুক্তির মাধ্যমেও এর সমস্যার সমাধান হয়নি। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দুই দেশের ন্যায্য পানির হিস্যা পাওয়া সম্ভব হয়নি। এর উপর ভারতের আন্তঃনদী পানি সংযোগ প্রকল্প যদি গৃহীত হয় তাহলে হয়ত আমাদের এই শস্য শ্যামল সবুজের নীড় বাংলাদেশ হয়ে যাবে ধূসর মরুভূমিতে যা বর্তমানে পরিবেশবাদিরা মনে করেন।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।