ইউরোপ উত্তর ও পূর্ব গোলার্ধে অবস্থিত পৃথিবীর একটি মহাদেশ

ইউরোপ বা ইউরোপা (ইংরেজি: Europe) হচ্ছে পুরোপুরি উত্তর গোলার্ধে এবং বেশিরভাগ পূর্ব গোলার্ধে অবস্থিত পৃথিবীর একটি মহাদেশ। আয়তনের দিক থেকে ক্ষুদ্রতমদের অন্যতম হওয়া সত্ত্বেও ইউরােপ বিশ্বের জনবহুল অঞ্চলগুলির অন্তর্গত। ১৯৮০ সালে ইউরোপের মোট জনসংখ্যা ছিলো ৬৭.৮ কোটি এবং একই বছর জনসংখ্যার ঘনত্ব এখানে বর্গকিলােমিটার প্রতি ছিলো ৬৪ জন এবং এই হিসাবে ইউরােপ বিশ্বে প্রথম স্থান দখল করেছে। জনাধিক্যে এশিয়ার পরই ইউরােপের স্থান। পথিবীর এক-পঞ্চমাংশেরও কম জনসংখ্যা সত্ত্বেও ইউরােপ সারা দুনিয়ার ৫০ ভাগের বেশি শিল্পপণ্যের উৎপাদক।

ইউরােপের জনসংখ্যার ৫০ ভাগেরও বেশি শহরবাসী। এই মহাদেশ নগরসমৃদ্ধ। লণ্ডন, মস্কো, লেনিনগ্রাদ, প্যারিস, বুদাপেস্ট সহ এখানে ১০ লক্ষাধিক বাসিন্দার ৩০টিরও বেশি শহর রয়েছে। ইউরােপীয় শহরগুলি প্রধান শিল্পকেন্দ্র এবং শ্রমিক শ্রেণী অধ্যুষিত।

ইউরােপের রাজনৈতিক মানচিত্রে রাষ্ট্রসংখ্যা ৩০। এগুলির কয়েকটি খুবই ছােট। এসব দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা অভিন্ন নয়। ইউরােপের ৬০ শতাংশেরও বেশি অংশ মধ্য, পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সমাজতান্ত্রিক দেশ ও সােভিয়েত ইউনিয়নের ইউরােপীয় ভাগের অন্তর্গত। ইউরােপীয় ভূখণ্ডের তিন-পঞ্চমাংশের অধিকারী এসব দেশেই মহাদেশের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ বসবাস করে এবং ইউরােপের শিল্পপণ্যের অর্ধেকের বেশি উৎপন্ন হয়। সমাজতান্ত্রিক ইউরােপ বিশ্বের অন্যতম অত্যুন্নত ও গুরুত্বপূর্ণ শিলপাঞ্চল। উন্নয়নের হার, অর্থনীতির কাঠামােগত পরিবর্তন ও শিল্পােৎপাদনের স্তর অনুসারে ইউরােপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগলি বহু, উন্নত পজিবাদী দেশ থেকেও বহুদূর প্রাগ্রসর।

পশ্চিম ইউরােপ পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিল্পপণ্যের উৎপাদক ও সাম্রাজ্যবাদী সামরিক সামর্থ্যের এক উল্লেখ্য অংশের শরিক।

আয়তন ও জনসংখ্যায় পশ্চিম ইউরােপের এক-চতুর্থাংশের কম হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ছােট দেশগুলি ইউরােপের একচতুর্থাংশ বা বৃটেনের সমপরিমাণ শিল্পপণ্য উৎপাদন করে। অর্থনৈতিক সূচক অনুসারে, দৃষ্টান্ত হিসাবে মাথাপিছু, মেশিন টুলস তৈরিতে বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যাণ্ড ইতিমধ্যেই ব্রিটেনকে অতিক্রম করে গেছে অথবা অন্যান্য প্রধান পশ্চিম ইউরােপীয় দেশগুলির সমপর্যায়ে পৌছে যাচ্ছে। অবশ্য সব মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর জার্মানি, ব্রিটেন ও পশ্চিম ইউরােপীয় অন্যান্য শক্তিবর্গই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তিকেন্দ্র।

আরো পড়ুন:  বাংলাদেশের বন্যপ্রাণ বা জীববৈচিত্র্য এবং প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত জটিলতা

আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী অন্তঃর্দ্বন্দ্ব প্রশমনের প্রচেষ্টায় পশ্চিম ইউরােপীয় দেশগুলির একচেটিয়া চক্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমন্বয়ের, অর্থাৎ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমাবন্ধনের সাহায্য নেয়। এরই অন্যতম রূপ হল ইউরােপীয় অর্থনৈতিক গােষ্ঠী বা সাধারণ বাজার।

১৯৫৭ সালে গঠিত এই গােষ্ঠীতে ছ’টি দেশ – ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়ম, নেদারল্যান্ডস ও লক্সেমবুর্গ অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে সাধারণ বাজারে ইংলণ্ড, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড ও গ্রীস যোগ দেয়। এর ফলে ইউরােপীয় অর্থনৈতিক গােষ্ঠীর অবস্থান মজবুত এবং আক্রমণাত্মক ন্যাটো জোটের অর্থনৈতিক ভিত্তি সম্প্রসারিত হয়। এর সঙ্গে সাধারণ বাজারভুক্ত দেশ বিশেষ করে ইংলণ্ড, পশ্চিম জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যেকার অন্তদ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে ওঠে। 

জাতিগুলির ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি ইউরােপে একটি নির্ভরযােগ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরির কথা বলে থাকে। মৈত্রী, সহযােগিতা ও পারস্পরিক সহায়তাভিত্তিক গঠিত ওয়ারস চুক্তিভুক্ত দেশগুলি বহু আগেই ন্যাটোর সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদনের প্রস্তাব দিয়েছিল। শান্তিপূর্ণ সহযােগিতা বৃদ্ধি, ইউরােপে ও সারা দুনিয়ায় নিরাপত্তা দৃঢ়করণের এই নীতি সকল প্রগতিশীল শক্তি ও বৃহত্তর জনসাধারণের সমর্থন লাভ করে।

১৯৭৫ সালে সমাজতান্ত্রিক সহমিতালীর রাষ্ট্রগুলির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সারা ইউরােপের রাষ্ট্রসমূহের অধিবেশন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল বিবেচনা করে শক্তি প্রয়ােগের নীতি ও ‘ঠাণ্ডা লড়াইয়ের নিন্দা করেছিল। এই অধিবেশনের ফলে ইউরােপে শান্তি ও নিরাপত্তা দঢ়করণের পক্ষে এবং অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পরিবেশ সংরক্ষণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ইউরােপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যেকার সহযােগিতা প্রসারের জন্য নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

তথ্যসূত্র:

১. কনস্তানতিন স্পিদচেঙ্কো, অনুবাদ: দ্বিজেন শর্মা: বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূগোল, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, বাংলা অনুবাদ ১৯৮২, পৃ: ১৮-২০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!