উত্তরবঙ্গের নদী বা উত্তরবাংলার নদী (ইংরেজি: Rivers of North Bengal) হচ্ছে হিমালয়ের ঢালে সৃষ্টি হওয়া বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় হাজারখানেক নদনদীর এক বিশাল সমাহার। গঙ্গা নদী মালদহ-মুর্শিদাবাদের সীমান্ত ধরে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত উত্তরবঙ্গের ছয়টি জেলার ২১,৭৬৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে পাঁচটি নদী-অববাহিকা। এই নদীগুলি হলো তিস্তা, জলঢাকা, তোরসা, রায়ডাক ও মহানন্দা। মহানন্দা ছাড়া বাকি চারটি নদী ব্রহ্মপুত্র বা যমুনার উপনদী, মহানন্দা হলো গঙ্গার উপনদী।
উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষণীয়। উত্তরে আকাশছোঁয়া হিমালয় আর দক্ষিণে সমভূমি এলাকা নিয়ে উত্তরবঙ্গ। হিমালয়ের পাদদেশে রয়েছে ৭২৫৪ বর্গ কিমি বিস্তৃত ডুয়ার্সের সমভূমি। আরও দক্ষিণে ১২,১৭০ বর্গ কিমি বিস্তৃত পলিগঠিত সমভূমি। উত্তরবঙ্গের পাঁচটি নদী-অববাহিকায় বিস্তৃতি হলো:
নদী | অববাহিকার মোট বিস্তৃতি (বর্গ কিমি) | পশ্চিমবঙ্গে বিস্তৃতি (বর্গ কিমি) |
তিস্তা | ১২১৫৯ | ৩২২৫ |
জলঢাকা | ৫০২০ | ৩৭৫৩ |
তোরসা | ৬৪০৭ | ২৩৬৭ |
রায়ডাক | ৫৫০২ | ৮০৭ |
মহানন্দা | ২৫০৪৩ | ৬৩৪০ |
এই নদীগুলির অববাহিকায় পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়, এছাড়া আছে হিমালয়ের বরফগলা জল। প্লাইস্টোসিন যুগের পর থেকেই হিমালয়ের হিমবাহগুলি ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফেলে রেখে গেছে প্রচুর পরিমাণে পাথর, কাঁকর ও বালি— যার নাম মোরেন। পরে এইসব মোরেনের সঙ্গে মিশে গেছে হিমালয়ের ঢাল ধসে নেমে-আসা পাথরের স্তুপ। হিমালয়ের নদীগুলি এইসব কাকর-বালি বয়ে এনে গঠন করেছে ডুয়ার্সের সমভূমি। হিমালয়ের দক্ষিণ ঢালে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারে বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩,২০০ মিলিমিটারের বেশি। এই বৃষ্টিপাতের ৯৪ শতাংশ ঘটে বর্ষার তিন-চার মাসে। তখন বিপুল জলস্রোত প্রথমে হিমালয়ের ঢাল, পরে ডুয়ার্সের সমভূমি দিয়ে নেমে আসে— বয়ে আনে প্রচুর পরিমাণে কাকর, বালি ও পাথর। বন্যা তাই উত্তরবঙ্গের সহজাত সমস্যা। নদীখাত ক্রমশ পলি-বালিতে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বলেই বন্যার সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে উত্তরবঙ্গের নদীগুলির গতিপথ অনেক বদলে গেছে। আগে তিস্তা ছিল গঙ্গার উপনদী। সেই সময় তিস্তা, করতোয়া, আত্রেয়ী ও পুনর্ভবা নামে তিনটি শাখানদীর খাত ধরে গঙ্গায় মিশত, তাই তিস্তার অন্য নাম ত্রিস্রোতা। ১৭৮৭ সালের বন্যার সময় তিস্তা গতিপথ বদলে পূর্ব দিকে যমুনায় মিশে যায়। একথা বলা হয়েছে যে, হার্স্ট [E.C. Hirst] (১৯১৫), মর্গান ও ম্যাকিনটায়ারের [J.P.Morgan & McIntrire] (১৯৫৯) মতো বিশেষজ্ঞরা মনে করতেন, বাংলাদেশে যে খাত ধরে যমুনা এখন বয়ে চলেছে সেই অঞ্চলটি উপরের পলির চাপে ধীরে ধীরে বসে যাচ্ছে, ফলে উত্তরবঙ্গের নদীগুলি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে।
উত্তরবঙ্গের নদীগুলি হিমালয়ের ঢালে সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড় পেরিয়ে ৬৬ মিটার সমোচ্চরেখা বরাবর সমভূমিতে নেমে আসার পর নদীগুলির ঢাল কমে গেছে, তখন তারা বড়ো পাথর, কাকর, বালি বহন করতে পারে না। শুখা মরসুমে অনেক নদী হেঁটে পার হওয়া যায় আবার বর্ষায় জল সেই সব নদীরই দু-কূল ছাপিয়ে ওঠে। প্রায়ই দু-পাশের গ্রাম ভেসে যায়। তখন পাড় ভেঙে নদী তার গতিপথ বদলে নিতে চায়— পাথর দিয়ে বেঁধে উদ্দাম নদীকে থামানো যায় না।
উত্তরবঙ্গের নদীগুলির গতিপথের একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, জলঢাকা থেকে মহানন্দা পর্যন্ত সব নদীগুলির একটি মানচিত্র অঙ্কন করলে দেখা যায়, ৩০০ মিটার থেকে ৯০ মিটার সমোচ্চ রেখাদ্বয়ের মধ্যে নদীগুলি পরস্পরের কাছে এসে পরে আবার ক্রমশ পূর্ব-পশ্চিমে ছড়িয়ে গেছে। ভূপ্রকৃতি ও শিলাস্তরের অভ্যন্তরীণ গঠন নদীর চলার পথকে প্রভাবিত করে। উত্তরবঙ্গের নদীগুলির উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত চলার পথ নানা ভাবে প্রভাবিত হয়েছে। হিমালয়ের সংকীর্ণ উপত্যকা ধরে প্রবাহিত হওয়ার সময় নদীখাতে নীচের দিকে ক্ষয় হয়, পার্শ্বক্ষয় কম হয়। কিন্তু সমভূমিতে নেমে আসার পর নদীর চরিত্র আমূল বদলে যায়। তখন পার্শ্বক্ষয় বেশি হয়, কমে যায় নীচের দিকের ক্ষয়। এই সময় নদীখাত অগভীর ও প্রশস্ত হয়ে যায়— জলস্রোত একাধিক শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। নদীখাত অগভীর ও পলিতে রুদ্ধ হয়ে গেলে নদী পাড় ভেঙে নতুন পথ করে নেয়। উত্তরবঙ্গের নদীগুলি সমভূমি পেরিয়ে বরেন্দ্রভূমির উপর দিয়ে বয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজশাহি, নবাবগঞ্জ এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জুড়ে আছে বরেন্দ্রভূমি— যা কচ্ছপের পিঠের মতো উঁচু। বরেন্দ্রভূমির জন্যই উত্তরবঙ্গের নদীগুলি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। মহানন্দা ও তার শাখা ফুলহার গঙ্গায় মিশেছে আর তিস্তা থেকে সংকোশ পর্যন্ত সব নদী যমুনায় মিশেছে। এই লেখার সংগে যুক্ত মানচিত্রে তাই দেখা যায়। সামগ্রিক ভাবে দেখলে মনে হয়, নদীগুলি একবার অন্তর্মুখী হয়ে পরে আবার বহির্মুখী হয়েছে।
বৃহত্তর দিনাজপুর মহানন্দা, নাগর, কুলিক, টাঙ্গন ও পুনর্ভবা নদী প্রবাহের অন্তর্গত। এই চারটি নদীপ্রবাহকে ঘিরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ৫টি জেলা গঠন করা হয়েছে। আমরা রোদ্দুরে ডট কম এই পাঁচটি নদী প্রবাহের বিস্তারিত বিবরণ দিতে বদ্ধ পরিকর।
তথ্যসূত্র
১. কল্যাণ রুদ্র, বাংলার নদীকথা, সাহিত্য সংসদ, প্রথম প্রকাশ দ্বিতীয় মুদ্রণ, জানুয়ারি ২০১০, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৭২-৭৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।