তোরসা নদী বা তোরষা নদী বা তোর্ষা নদী বা তোর্সা নদী বা চুম্বি নদী বা আমোছু নদী (ইংরেজি: Torsa River) বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলার এবং পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৯৫ কিলোমিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটিতে জোয়ার ভাঁটার প্রভাব থাকে না। তোরসা নদী মূলত রায়ডাক ও দুধকুমার নদীর উপনদী যা চলার পথে দুধকুমার নাম ধারণ করেছে।
প্রবাহ: দক্ষিণ তিব্বতের ৭০৬৫ মিটার উঁচু চুম্বি উপত্যকা থেকে তােরসা নদী উৎপত্তি হয়েছে। সেখান থেকে নদীটি তিব্বত, ভুটান, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ২৯৫ কিমি পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশের রংপুর জেলার নাগেশ্বরীর কাছে যমুনায় মিশেছে। নদীটির ৯৯ কিমি গতিপথ জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। ৬৪০৭ বর্গকিমি ব্যাপী তােরসা অববাহিকায় ৩৭ শতাংশ এলাকা পশ্চিমবঙ্গের দুই জেলায় বিস্তৃত। বর্ষাকালে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে তােরসা নদীতে সর্বোচ্চ ৫.৮১ লক্ষ কিউসেক জল বয়ে যায় আর ভেসে-আসা বাৎসরিক পলির পরিমাণ ২৯ লক্ষ টন।
জলপাইগুড়ি জেলার হাসিমারাতে তােরসা নদী দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব বাহিনী শাখাটির নাম শিলতােরসা, পরে এই নদীটি আবার মূল নদীতে মিশে গেছে। মাদারিহাট রেলব্রিজের কাছে ছােটো তােরসা নামে একটি নদী তােরসায় মিশেছে। ছােটো তােরসার শাখা বুড়িরেসা ফালাকাটার কাছে জলঢাকায় মিশেছে। কোচবিহার শহরের কাছে তােরসা থেকে জন্ম নিয়েছে ধরলা নদী— পরে ওই নদীটি জলঢাকায় মিশেছে। গত দুই শতাব্দীতে কোচবিহারে তােরসা বারে বারে গতিপথ বদলেছে। ১৮৮৭ সালের ভাঙনে ঐতিহাসিক রাজবাড়িটি বিপন্ন হলে নদীর গতিপথকে আবার মরা তােরসার খাতে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু নদী আর সেখানে থেমে থাকেনি।
তোরসা নদী উত্তরবঙ্গের একটি প্রধান নদী। নদীতে সারা বছর পানি প্রবাহ থাকে, তবে বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। বর্ষায় নদীতে স্রোতধারা বৃদ্ধি পেলে তীরবর্তী এলাকা যেমন বন্যাকবলিত হয়, তেমনি ভাঙনের আলামত পরিদৃষ্ট হয়। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কিছুটা কমে যায়। পলির প্রবাহে এ নদীর তলদেশ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে এবং প্রবাহের মাত্রাও অতীতের তুলনায় হ্রাস পাচ্ছে।
এই নদীর তীরে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলা শহর এবং ভুটানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ফুন্টসলিং অবস্থিত। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারা এই নদীর তীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। এছাড়া ভুটানগেট, সোমবারে বাজার, খাট্টিমারি বাজারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ অবস্থিত। এই নদী অববাহিকায় সেচের জন্য কোনো জল সংরক্ষণ করা হয় না। এই নদীতে কোনো রেগুলেটর নেই বা কোনো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নেই। এই নদীর উপর ভারতের জাতীয় মহাসড়ক ৩১৭-এর জন্য ১টি ব্রিজ, পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক মহাসড়ক ১৭-এর জন্য তোর্সা ব্রিজ ছাড়াও বাঘমারা শুখান দিঘিতে আরো একটি ব্রিজ আছে।
আলোকচিত্রের ইতিহাস: পশ্চিমবঙ্গের বাঘমারা শুখান দিঘি এলাকা থেকে তোলা তোরসা নদী ও তোরসা সেতুর প্রবাহপথের এই আলোকচিত্রটি গ্রহণ করেছেন বাপন দাস অক্টোবর ২০২০ তারিখে।
তথ্যসূত্র
১. কল্যাণ রুদ্র, বাংলার নদীকথা, সাহিত্য সংসদ, প্রথম প্রকাশ দ্বিতীয় মুদ্রণ, জানুয়ারি ২০১০, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।