মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে?

মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে? সেগুলো কি আকাশ থেকে পড়ে? –না। সেগুলো কি মনের মধ্যে সহজাত? –তা নয়। মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কেবলমাত্র সামাজিক অনুশীলন থেকেই আসে; সমাজের উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণিসংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা – এই তিনটি অনুশীলন থেকেই সেগুলো আসে। মানুষের সামাজিক সত্তা তার চিন্তাধারাকে নির্ধারণ করে। অগ্রগামী শ্রেণির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমূলক নির্ভুল চিন্তাধারাকে জনসাধারণ একবার আয়ত্ত করে নিতে পারলেই এই চিন্তাধারা বস্তুগত শক্তিতে পরিণত হয়, যা সমাজকে পুনর্গঠন করে এবং দুনিয়াকে রূপান্তরিত করে। মানুষ তাদের সামাজিক অনুশীলনে বিভিন্ন ধরনের সংগ্রামে লিপ্ত হয় এবং প্রভূত অভিজ্ঞতা অর্জন করে – সফলতার অভিজ্ঞতা এবং বিফলতার অভিজ্ঞতা, উভয়ই। বাস্তবমুখী বহির্জগতের অসংখ্য ঘটনা মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের –চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বকের মাধ্যমে তার মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়। প্রারম্ভে জ্ঞান হচ্ছে ইন্দ্রিয়-জ্ঞান। যখন এই ধরনের ইন্দ্রিয়-জ্ঞান যথেষ্ট পরিমাণে সঞ্চিত হয় তখন একটা দ্রুত অতিক্রমণ ঘটে আর তা ধারনাত্মক জ্ঞানে পরিবর্তিত হয়­–এটাই হচ্ছে চিন্তাধারা। এটা হচ্ছে জ্ঞানের একটা প্রক্রিয়া। এটাই হচ্ছে জ্ঞানের গোটা প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায়, অর্থাৎ বাস্তব পদার্থ থেকে আত্মমুখী চেতনায়, সত্তা থেকে চিন্তাধারায় চালিত হবার পর্যায়। এই পর্যায়ে চেতনা বা চিন্তাধারা (তত্ত্ব, কর্মনীতি, পরিকল্পনা, পদ্ধতিসহ) বাস্তবমুখী বহির্জগতের নিয়মগুলোকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে কি না তা এখনো প্রমাণিত হয়নি, সেগুলো নির্ভুল বা ভুল তা নির্ধারণ করা এখনো সম্ভব নয়। তারপর আসে জ্ঞানের প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্যায়, অর্থাৎ চেতনা থেকে বস্তুতে, চিন্তাধারা থেকে সত্তায় চালিত হবার পর্যায়; এই পর্যায়ে, প্রথম পর্যায়ের অর্জিত জ্ঞানকে সামাজিক অনুশীলনে প্রয়োগ করা হয় এবং তত্ত্ব, কর্মনীতি, পরিকল্পনা, পদ্ধতি ইত্যাদি প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করে কি না তা নির্ণয় করা যায়। সাধারণভাবে বলতে গেলে, যা সফল হয় তা নির্ভুল, আর যা ব্যর্থ হয় তা ভুল; বিশেষ করে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংগ্রামে এটা সত্য। সামাজিক সংগ্রামে অগ্রগামী শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী শক্তিগুলো কখনো কখনো পরাজিত হয়; তাদের পরাজয়ের কারণ এ নয় যে তাদের চিন্তাধারা ভুল, বরং তার কারণ এই যে সংগ্রামরত শক্তিগুলোর পারস্পরিক ভারসাম্যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো যতটা শক্তিশালী, অগ্রগামী শক্তিগুলো আপাতত ততটা শক্তিশালী নয়; তাই তারা সাময়িকভাবে পরাজিত হয়, কিন্তু একদিন না একদিন তারা জয়ী হতে বাধ্য। অনুশীলনের পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানের আর একটা দ্রুত-অতিক্রমণ ঘটে। এই দ্রুত-অতিক্রমণের গুরুত্ব পূর্বেরটির চেয়ে বেশি। কারণ, কেবলমাত্র এই দ্রুত-অতিক্রমণই জ্ঞানের প্রথম দ্রুত-অতিক্রমণের ভ্রান্তি অথবা অভ্রান্তিকে, অর্থাৎ বাস্তবমুখী বহির্জগতের প্রতিফলনের প্রক্রিয়ায় অর্জিত চিন্তাধারা, তত্ত্ব, কর্মনীতি, পরিকল্পনা, ও পদ্ধতি ইত্যাদির ভ্রান্তি অথবা অভ্রান্তিকে­­–প্রমাণ করতে পারে। সত্যকে যাচাই করার এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সর্বহারাশ্রেণির পক্ষে দুনিয়াকে জানার উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধুমাত্র দুনিয়াকে রূপান্তরিত করা, এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।

আরো পড়ুন:  সাধারণীকরণ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অন্বেষার প্রয়োজনীয় স্তর
মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে?

একটা নির্ভুল জ্ঞান প্রায়শই বস্তু থেকে চেতনায় এবং চেতনা থেকে বস্তুতে, অর্থাৎ অনুশীলন থেকে জ্ঞানে এবং জ্ঞান থেকে অনুশীলনে অনেকবার পুনরাবৃত্তির পরেই কেবল আয়ত্ত করা যায়। এটাই হচ্ছে মার্কসবাদের জ্ঞানতত্ত্ব, অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব। আমাদের কমরেডদের মধ্যে অনেকেই এখনও এই জ্ঞানতত্ত্বকে বুঝেন না। তাদের চিন্তাধারা, মতামত, কর্মনীতি, পদ্ধতি, পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত, অনর্গল বক্তৃতা এবং দীর্ঘ প্রবন্ধগুলি কোথা থেকে আসে একথা জিজ্ঞাসা করলে তারা এই প্রশ্ন অদ্ভুত বলে মনে করেন এবং উত্তর দিতে পারেন না। বস্তু যে চেতনায় এবং চেতনা যে বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে এই রূপ দ্রুত-অতিক্রমণের ঘটনা দৈনন্দিন জীবনে প্রায়ই দেখা গেলেও তারা বুঝতে অক্ষম। সুতরাং, আমাদের ক্যাডারদেরকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্বে শিক্ষিত করে তোলা প্রয়োজন, যাতে তারা নির্ভুলভাবে চিন্তা করতে পারেন, অনুসন্ধান ও পর্যালোচনায় নিপুণ হতে পারেন, অভিজ্ঞতার সার-সংক্ষেপ করতে পারেন, দুঃখকষ্ট অতিক্রম করতে পারেন, কম ভুল করতে পারেন, কাজ ভালভাবে করতে পারেন, কঠোরভাবে সংগ্রাম করতে পারেন, এক মহান শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠন করতে পারেন, বিশ্বের নিপীড়িত ও শোষিত ব্যাপক জনগণকে সাহায্য করতে পারেন এবং এইভাবে আমাদের উপর অর্পিত মহান আন্তর্জাতিকতাবাদি কর্তব্য সম্পাদন করতে পারেন।

বি. দ্র. এই প্রবন্ধটি “গ্রামের বর্তমান কাজের কতগুলি সমস্যা সম্পর্কে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রিয় কমিটির (খসড়া) সিধান্তে”র একটি অনুচ্ছেদ। এই খসড়া সিদ্ধান্ত কমরেড মাও সেতুঙের পরিচালনায় রচিত হয়েছিল। এই অনুচ্ছেদটি কমরেড মাও সেতুং নিজেই লিখেছিলেন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!