অস্তিত্ববাদ (ইংরেজি: Existentialism) আধুনিক দর্শনের একটি চিন্তাধারা। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর যুগে জার্মানি এবং ফরাসি দেশে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের বিপর্যস্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই চিন্তার উদ্ভব এবং বিস্তার দেখা যায়। অস্তিত্ববাদী দর্শনের মূল প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ এবং বিশেষ করে ব্যক্তির অস্তিত্ব। কিন্তু এই প্রশ্নের আলোচনাকারীদের মধ্যে মতামতেরও পার্থক্য আছে।
ইউরোপ এবং আমেরিকার কয়েকজন খ্যাতনামা লেখকের সৃজনশীল গল্প, উপন্যাস, কবিতায় অস্তিত্ববাদী মতের প্রকাশ ঘটেছে। এঁদের রচনায় প্রচার এবং পরিচয়ের মাধ্যমে অস্তিত্ববাদী দর্শন আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কিছুটা প্রসার লাভ করেছে; এই সমস্ত লেখকের মধ্যে কার্ল জাসপার্স (১৮৮৩-১৯৬৯), মার্টিন হাইডেগার (১৮৮৯-১০৭৬), আলবেয়ার ক্যামু (১৯১৩-১৯৬২), জাঁ পল সার্ত্রে (১৯০৫-১৯৮০), ফ্রাঞ্জ কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪) বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।
অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারাকে বুঝার জন্য উনিশ শতকের ইউরোপে উদ্ভুত ‘জীবনের দর্শন’ নামক তত্ত্বটির পরিচয় থাকা আবশ্যক। বস্তুত ‘জীবনের দর্শন’ই অস্তিত্ববাদের উৎস এবং পটভূমি। উনিশ শতকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, বিশেষ করে জীববিদ্যায় এবং মনোবিজ্ঞানে যে বিস্ময়কর আবিস্কারসমূহ সংঘটিত হয়, তাতে জীবন ও জগতের এতদিনকার সহজ এবং যান্ত্রিক ব্যাখ্যা অকেজো হয়ে দাঁড়ায়। জীবন ও জগৎ বস্তু বটে কিন্তু সে বস্তু সহজ নয়, সে বস্তু জটিল। তার যান্ত্রিক ব্যাখ্যা মানুষের মনের বহু প্রশ্নের জবাব দানেই অক্ষম। এতদিনকার ভাববাদী কিংবা অষ্টাদশ শতকের যান্ত্রিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যার বিফলতার প্রতিক্রিয়ায় একদল চিন্তাবিদের কাছে জীবন এক অজ্ঞেয় রহস্যের আধার বলে প্রতীয়মান হতে থাকে।
জীবন হচ্ছে এক অসীম শক্তির উৎস; এ না বস্তু; না চেতনা। এর গতি আছে, এর প্রকাশ আছে। কিন্তু সে গতি বা প্রকাশ আমাদের বুদ্ধির আয়ত্তযোগ্য নয়। একে মানুষ কেবল তার সহজাত সজ্ঞা, ইনট্যুইশন বা সম্মোহিত অনুভূতির মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারে। আর যেহেতু সজ্ঞা বা সম্মোহিত অবস্থা নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার তাই জীবনের উপলব্ধি ব্যক্তিগত ছাড়া সমষ্টিগত জ্ঞানের ব্যাপার হতে পারে না। জীবনের কোনো বিজ্ঞান তৈরি করা সম্ভব নয়, জীবন কেবল অনুভূতি বা উপলব্ধির বিষয়। জীবনের এরূপ ব্যাখ্যাই শোপেনহাওয়ার (১৭৭৮-১৮৬০) এবং হেনরী বার্গসঁ (১৮৫৯-১৯৪১) প্রমুখ দার্শনিকের তত্ত্বে দেখা যায়।
ডেনমার্কের আত্মবিমোহিত বুদ্ধিজীবী সোরেন কিয়ের্কেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫)-এর রচনায়ও এই ‘জীবনদর্শনের’ সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিয়ের্কেগার্ডকে অস্তিত্ববাদের সাক্ষাৎ পূর্বসূরি বলে মনে করা হয়। কিয়ের্কেগার্ড দর্শনের ক্ষেত্রে চরম ভাববাদ কিংবা ধর্মের ক্ষেত্রে খ্রিষ্টীয় যাজকদের ব্যাখ্যা কোনোটাকেই স্বীকার করতে পারেন নি। নিজের জীবনে কিয়ের্কেগার্ড ছিলেন অস্বাভাবিকরূপে আত্মকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিবাদী। এই জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর চিন্তা ও রচনায়। তাঁর মতে এই জগতে ব্যক্তির অস্তিত্বই হচ্ছে কেন্দ্র-কথা। ব্যক্তি তার সংকটরূপে প্রতিভাসিত। সর্বক্ষণ সে সংকটের মুখোমুখি। হয় তাকে এ পথ গ্রহণ করতে হয়, নয় ওপথ; হয় তাকে এটা করতে হবে, নয় ওটা। সংকটের মোকাবেলাতেই ব্যক্তি তার অস্তিত্বের পরিচয় দিতে পারে এবং তাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। কিয়ের্কেগার্ডের মতে সামগ্রিকভাবে দেখলে মানুষের জীবনের দুটি সংকট প্রধান। হয় সে পরিবেশকে গ্রহণ করে নিজের অস্তিত্বকে লুপ্ত করে দেবে জীবনের ভোগে-দুর্ভোগে, আনন্দ-কষ্টে নিমজ্জিত হবে; নয়তো সে পরিবেশকে উপেক্ষা করে বিধাতার কিট আত্মসমর্পণ করে সেই উপেক্ষার শক্তিতে আর আত্মসমর্পণের স্বাধীনতায় নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করবে। কিয়ের্কেগার্ড তাঁর একখানি গ্রন্থের নামকরণই করেছিরেন ‘হয়/নয়’ রূপে।
অস্তিত্ববাদের মতে দর্শনের করণীয় হচ্ছে নৈর্বক্তিক এবং আত্মগতকে অবিভাজ্য এবং সামগ্রিক সত্তা হিসাবে ব্যাখ্যা করা। নৈর্বক্তিক এবং আত্মগত, জ্ঞান এবং জ্ঞাতার অবিচ্ছেদ্য সত্তাই হচ্ছে অস্তিত্ব। এ অস্তিত্বকে ব্যক্তি উপলব্ধি করতে পারে অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বের সংকট সীমায় দাঁড়িয়ে। মৃত্যু, যন্ত্রণা, পাপবোধ, অসন্তোষের মধ্যেই ব্যক্তি সেই সংকট সীমায় উপনীত হতে পারে। বুদ্ধি বা যুক্তির মাধ্যমে এ অস্তিত্বকে জানা সম্ভব নয়।
অস্তিত্ববাদের প্রাথমিক প্রবক্তা কিয়ের্কেগার্ডের সিদ্ধান্তে ধর্মীয় ভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু অস্তত্ববাদীগণ সাধারণত নাস্তিক বলে মনে করা হয়। এঁদের ভাবধারার মধ্যে নিটশের দর্শনের প্রভাব দেখা যায়। নিটশে ‘ঈশ্বর’কে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন। সার্ত্রের বক্তব্য হচ্ছে ঈশ্বরকে অস্বীকার করেই ব্যক্তিকে বাঁচতে হবে। আর ঈশ্বরই হচ্ছে ব্যক্তি জীবনে সমস্ত বন্ধনের মূল। সেই ঈশ্বরই যখন অস্বীকৃত, ব্যক্তি তখন অবাধ-স্বাধীন। তার নিজের কাছে ছাড়া অপর কারুর কাছে তার কোনো জবাবদিহি করার নেই। অপর কারুর কাছে দায়িত্ব বা কর্তব্যে সে দায়ী নয়। সবার বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ। সব কিছুকে, সব আইন-কানুন, ভালো-মন্দ, নিয়ম-নীতি, প্রেম-ভালবাসা, স্নেহ-মমতা, দান-গ্রহণ সব কিছুকে অস্বীকার করার চেষ্টায় এবং সে চেষ্টার সফলতার মধ্যে ব্যক্তির অস্তিত্ব নিহিত। সেই চেষ্টতেই ব্যক্তির অস্তিত্বের উপলব্ধি।
জগৎ আর ব্যক্তি পরস্পর-বিরুদ্ধ শক্তি। এ জগতে ব্যক্তি বহিরাগত। অস্তিত্ববাদী সাহিত্যিকদের মধ্যে সমধিক পরিচিত আলবেয়ার ক্যামু তাঁর এক উপন্যাসের নাম দিয়েছিলেন ‘বহিরাগত’ বা ‘আউটসাইডার’। তাঁর অপর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্লেগ’ উপন্যাসেও পরিবেশের সমস্ত ঘটনা, দুর্ঘটনা, ভয়, আতঙ্ক, মৃত্যু, প্রেমিকার আহবান সব কিছুর প্রতি অত্যদ্ভুত এক নির্লিপ্ততা সহকারে দৈনন্দিন দায়িত্ব পালনের আকর্ষণীয় চিত্র নায়কের চরিত্রে অঙ্কিত হতে দেখা যায়। আলবেয়ার ক্যামুর আর একখানি উপন্যাস ‘মিথ অব সিসিফাস’-এর প্রতিপাদ্য ছিল: আত্মহত্যার যদি কোনো যুক্তি না থাকে, বেঁচে থাকারও কোনো যুক্তি নেই। অতএব যুক্তিগতভাবে ব্যক্তি যখন আত্মহত্যা করতে পারে না কিংবা বাঁচতেও পারে না, তখন ‘কেবল বাঁচার জন্য বাঁচা’ ব্যতীত ব্যক্তির জন্য আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
আধুনিক পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত সমাজ-ব্যবস্থা, পুঁজিবাদের চরম উন্নতি ঘটে ঊনবিংশ শতকে। তার বিকাশের সমস্ত গোড়া থেকেই শুরু হয় তার তীব্র ক্ষয়ের যুগ। এখন সেখানে সম্ভাবনা কেবলমাত্র ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংঘর্ষ নয়, কেবলমাত্র শ্রেণীর হাতে শ্রেণীর শোষণ নয়। এখন মানুষের জীবনের প্রতি মুহুর্তের আশঙ্কা জাতিতে জাতিতে বৈরীর, ধ্বংসযজ্ঞের, মিথ্যার বেসাতির এবং যে মানুষ এই আশ্চর্য মানব সভ্যতা সৃষ্টি করেছে সেই মানুষের হাতে তার নিশ্চিহ্ন বিলোপের সম্ভাবনা এক অযৌক্তিক অসঙ্গত এবং ভীতিজনক অবস্থা। এরই প্রকাশ হিসাবে প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। মানুষের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, ন্যায়-নীতি, শৃঙ্খলা ভেঙে গেছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যস্ত অবস্থায় যে-বুদ্ধিজীবী মানুষের জন্য মুক্তির এবং অগ্রসরের আর কোনো পথ আবিস্কার করতে অক্ষম তার পক্ষে নৈরাজ্যিক মনোভাব নিয়ে চরম বিপর্যয়ে চিন্তাবিদ মাত্রই অস্তিত্ববাদী হয় নি। পৃথিবীর মানুষ প্রতিষ্ঠিত সমাজ-ব্যবস্থার বিপর্যয়কে মানুষের জন্য চরম বলে স্বীকার করে নি; সংঘবদ্ধ চেষ্টায় সে এমন এক নতুন সঙ্গত সমাজ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে যেখানে ব্যক্তি, সমষ্টির মধ্যেই নিজের অস্তিত্বের সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারবে। সে হিসাবে অস্তিত্ববাদ সাধারণ চিন্তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। অস্তিত্ববাদ এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর বিপর্যস্ত মনের প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে চরম আত্মরতিমূলক প্রতিক্রিয়া।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৬৩-১৬৫।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।