পরিবার হচ্ছে প্রাচীন প্রতিষ্ঠা: গুরুত্ব ও শ্রেণীবিভাগ

পরিবার আমাদের অত্যন্ত পরিচিত প্রতিষ্ঠান। আমাদের কাছে মনে হয়, আমাদের চেনা পরিবারই হচ্ছে একমাত্র রূপ এবং অন্য কোনো ধরনের পরিবারগুলো থেকে ব্যতিক্রম। সমাজবিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন বিভিন্ন সমাজে পরিবারের বিভিন্ন রূপ রয়েছে। সমাজের দ্রুত পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবারের রূপেরও পরিবর্তন ঘটেছে।  সাধারণত: গঠনের দিক থেকে পরিবারের চারটি রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। 

পিতা বা মাতাভিত্তিক পরিবার

এই ধরনের পরিবারগুলো গড়ে ওঠে বিবাহ-বিচ্ছেদ বা বিচ্ছেদ জনিত কারণে শুধু পিতা বা শুধু মাতাকে কেন্দ্র করে। এমন ধরন অনেক দেশে ক্রমশ: গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের ছিল ১০.১ শতাংশ। ১৯৮৬ সালে তা বেড়ে গিয়েছিল ২৪ শতাংশে। 

একক বা নিউক্লিয়ার পরিবার Nuclear Family

গিডেন্স (১৯৯৩)-এর মতে দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারী নিজেদের বা পোষ্যগ্রহণকৃত সন্তান নিয়ে কোনো গৃহস্থালীতে একত্রে বসবাস করলে ঐ পরিবারকে বলে একক পরিবার। 

বর্ধিত পরিবার Extended Family

বর্ধিত পরিবারের দু’টি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রথমত: এটি একটি নিউক্লিয়ার যেখানে নিকট আত্মীয় কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তাদের পূর্ণ পরিবারের সঙ্গ ছাড়াই বসবাস করে। 

দ্বিতীয়ত: বর্ধিত পরিবারে কতগুলি নিউক্লিয়ার পরিবারের সমষ্টিকে বুঝিয়ে থাকে যেখানে রক্ত সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিবর্গ একই গৃহস্থালীতে বসবাস করে অথবা তারা একে অপরের খুবই ঘনিষ্ঠ (গিডেন্স, ১৯৯৩)। ‘যৌথ পরিবার’ Joint Family প্রত্যয়টিও এই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

পশ্চিমা পরিবারগুলো নিয়ে গবেষণা করেন এমন সমাজবিজ্ঞানীরা সাধারণত: যৌথ পরিবারের Joint Family প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন না। এটি বর্ধিত পরিবারের Extended Family আওতায় পড়ে যায়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর আনুমানিক অর্ধেক পরিবার ব্যবস্থার রূপ ছিল যৌথ পরিবারগুলোতে। কিন্তু ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যৌথ পরিবার না থাকায় সমাজবিজ্ঞানে প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয় না। দক্ষিণ এশিয়ার নৃবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা এখনও যৌথ পরিবারের প্রত্যয়টি ব্যবহার করে থাকেন। করাচীতে কুমবা নামে যৌথ পরিবারে সাধারণত: একটি পাঁচ বা ছয়তলা বাড়িতে বাস করে। বাবা-মা বাস করেন নিচের তলায়। প্রতিটি সন্তান বিয়ের পরে এক এক তলায় বাস করতে শুরু করে। বয়:ক্রম অনুসারে প্রতিটি সন্তানের বাসস্থান নির্ধারিত হয়ে যায়। যত তরুণ তত উপরে তার বাস। পরিবারের সমস্ত সম্পত্তি থাকে বাবার হাতে। প্রত্যেক সন্তান তার আয় বাবা-মায়ের কাছে প্রদান করে। সংসারের সমস্ত ব্যায় হয় বাবার মাধ্যমে।   

আত্মপরিচিতিমূলক বনাম প্রজননমূলক পরিবার 

পরিবারের আর একটি সাধারণ শ্রেণীবিভাগ করা যায়। যেমন, পরিচিতিমূলক পরিবার Family of Orientation এবং প্রজননমূলক পরিবার Family of Procreation পরিচিতিমূলক বর্ধিত বা যৌথ হলে অহং Ego পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজন-এর সমষ্টিকে বোঝায়। বর্ধিত বা যৌথ পরিবারের ক্ষেত্রে প্রজননমূলক পরিবারকে অহং এর নিজ পরিবার- স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত করা যায়। 

একস্ত্রী এবং বহুস্ত্রী পরিবার

পরিবারকে বিয়ের ভিত্তিতেও শ্রেণীকরণ করা যায়। অনেক সমাজে একের বেশি বিয়ে অনুমোদন করে না। এই ধরনের ব্যবস্থা একস্ত্রী পরিবারে Monogamous Family অন্তভুক্ত। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতাত্বিক মানচিত্রের ৮৫৪ টি সমাজের উপাত্ত থেকে দেখা যায় বিশ্বের ১৬ শতাংশ পরিবারই হচ্ছে একস্ত্রী পরিবার। 

একই উপাত্ত থেকে দেখা যায় সমাজে ৪৪ শতাংশই হচ্ছে বহুস্ত্রী পরিবার। আফ্রিকার অধিকাংশ পরিবারই বহুস্ত্রী। পৃথিবীর ৩৯ শতাংশ সমাজে বহুস্ত্রী পরিবারের নিয়মিত নয়। কোনো ব্যক্তি একের অধিক মহিলাকে তত্ত্বগতভাবে বিয়ে করতে পারে। 

পিতৃতান্ত্রিক পরিবার

কর্তৃত্বের ভিত্তিতে পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপ হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারগুলোতে Patriarchial Family। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ অথবা স্বামী পরিবারের কর্তৃত্বের একচেটিয়া অধিকারী হয়ে থাকে। প্রাচীন গ্রীস, রোম, ঊনবিংশ শতাব্দীর চীন এবং জাপানে এ ধরনের পরিবার লক্ষ্য করা যায়। 

নারীবাদিরা পিতৃতন্ত্র শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। তাদের মতে পিতৃতন্ত্র বলতে বোঝায় পরিবারে এবং সমাজে পুরুষের যে ব্যাপক আধিপত্য রয়েছে তাকে। 

যৌক্তিকভাবে পিতৃতন্ত্রের বিপরীত হওয়া উচিৎ মাতৃতন্ত্র। কিন্তু পৃথিবীতে মাতৃতন্ত্রের কোন নজীর এখনও পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে যেসব ভাবনা ও তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। অনেক সময় মাতৃসূত্রীয় Matrilineal পরিবারকে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে অভিহিত করা হয়। তবে এটি সঠিক নয়। 

বাসস্থান এবং পরিবার 

বাসস্থানের ভিত্তিতে পরিবারকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় যার মধ্যে তিনটি রূপই বেশি দেখা যায়। মাতৃবাসের ক্ষেত্রে Matrilocal Residenc বিয়ের পর নবদম্পতি স্ত্রীর পরিবারে বাস করে। পিতৃবাসের ক্ষেত্রে Patrilocal Residence বিবাহিত দম্পতি স্বামীর পিতার বাড়িতে বসবাস করে। নয়াবাসের ক্ষেত্রে Neolocal Residence নব দম্পতি নতুন বাসস্থানে বসবাস করতে শুরু করে। 

বংশধারা decent অনুযায়ী পরিবার 

বংশধারা decent অনুযায়ী পরিবারকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হচ্ছে পিতৃসূত্রীয় Patrilineal এবং দ্বিতীয়টি মাতৃসূত্রীয় Matrilineal. পিতৃসূত্রীয় পরিবারে মানুষ বংশ চিহ্নিত করে পিতার দিক থেকে। পিতার সম্পত্তি ও মর্যাদার অধিকারী হয় বৈধ পুত্র সন্তান।

মাতৃসূত্রীয় পরিবারে বংশ চিহ্নিত করা হয় অতীতের কোন নারী থেকে এবং কোন ব্যক্তি তার মায়ের গোত্রের সদস্য হিসাবে  বিবেচিত হয়। সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় নারীরা তাদের মায়ের দিক থেকে। তবে অনেক সমাজে দ্বিমুখী বংশধারা Bineal Descent প্রচলিত যেখানে বাবা এবং মায়ের বংশ উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর একটি উদাহরণ।

সাম্প্রতিক প্রবণতা

সাম্প্রতিককালে সামাজিক পরিবর্তনের ফলে পরিবারের নতুন নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে বা সনাতন পরিবারের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। রোনা র‌্যাপোপো  Rhona Rapoport দেখিয়েছেন এসব নতুন ধরনের পরিবারের মধ্যে রয়েছে দ্বৈতকর্মী ভিত্তিক Dual Worker Family যেখানে স্বামী ও স্ত্রী দু’জনে কাজ করে। পরিবারের আরেকটি রূপ হচ্ছে পুনর্গঠিত পরিবার  Reconstituted Family যা বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং পুনরায় বিয়ের পরে তৈরি হয়। 

এছাড়াও নানা ধরনের বিকল্প পরিবারের ধারণা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দ্বৈত একক পরিবারে Binuclear Family [বিবাহ বিচ্ছেদের পরে সন্তানের সঙ্গে যে দু’টি পরিবারের সম্পর্ক স্থাপিত হয়], সৎ পরিবারে  Step Family [যে পরিবারে স্বামী এবং স্ত্রীর দু’জনেরই আগের বিয়ের সন্তান থাকে], কমুটার পরিবারে  Commuter Family [স্বামী এবং স্ত্রী ভিন্ন স্থানে কাজ করার জন্য ভিন্ন স্থানে বাস করে এবং সপ্তাহের বিশেষ সময়ে মিলিত হয়] মুক্ত পরিবারে Open Family [মুক্তবিয়ে ভিত্তিক] প্রভৃতি রয়েছে। 

সারাংশ

সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন বিভিন্ন সমাজে পরিবারের বিভিন্ন রূপ রয়েছে। সমাজের দ্রুত পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবারের রূপেরও পরিবর্তন ঘটেছে। তবে সাধারণ গঠনের দিক থেকে পরিবারের চারটি রূপ রয়েছে। এগুলো হলও পিতা বা মাতাভিত্তিক, একক, বর্ধিত ও যৌথ পরিবার। 

বিবাহ-বিচ্ছেদ বা বিচ্ছেদজনিত কারণে শুধু পিতা বা শুধু মাতাকে কেন্দ্র করে সন্তান পিতা বা মাতাভিত্তিক পরিবারের গঠন করে। অনেক দেশেই এই ধরনের পরিবারগুলো ক্রমশ: গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারী নিজেদের বা পোষ্য সন্তান নিয়ে কোন গৃহস্থালীতে একত্রে বাস করলে ঐ পরিবারকে বলে একক পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

[বি. দ্র: নিবন্ধে ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া। আলোকচিত্রীর নাম: Demmarcos ]

আরো পড়ুন:  শর্তহীন বিধান হচ্ছে বিশেষ করে দার্শনিক কান্টের নীতি-শাস্ত্রে ব্যবহৃত একটি কথা

Leave a Comment

error: Content is protected !!