অনুশীলন সম্পর্কে

জ্ঞান ও অনুশীলনের মধ্যে, জানা ও করার মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে

জুলাই ১৯৩৭

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কিছু সংখ্যক মতান্ধ কমরেড ছিলেন যারা দীর্ঘদিন যাবৎ চীন বিপ্লবের অভিজ্ঞতা বর্জন করে চলছিলেন। এঁরা এই সত্যকে অস্বীকার করতেন যে, ‘মার্কসবাদ একটা অন্ধ মতবাদ নয় বরং কর্মের পথনির্দেশক’ এবং মার্কসীয় রচনাবলী থেকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে উদ্ধৃতি দিয়ে মানুষকে ভয় দেখাতেন। আবার কিছু অভিজ্ঞতাবাদী কমরেডও ছিলেন যারা দীর্ঘকাল যাবৎ নিজেদের খন্ড খন্ড অভিজ্ঞতার মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ করে রাখতেন এবং বিপ্লবী অনুশীলনের জন্য তত্ত্বের গুরুত্ব বুঝতেন না, বিপ্লবকে সমগ্রভাবে দেখতেন না, এঁরা অধ্যবসায়ের সঙ্গে হলেও কাজ করতেন অন্ধের মতো। এই দুই ধরনের কমরেডদের ভুল চিন্তা, বিশেষ করে মতান্ধদের ভুল চিন্তা ১৯৩১-৩৪ সালে চীনা বিপ্লবের বিপুল ক্ষতিসাধন করে এবং তৎসত্ত্বেও মতান্ধরা নিজেদের মার্কসবাদী পোশাকে সজ্জিত করে বহু সংখ্যক কমরেডকে বিভ্রান্ত করে চলছিলেন। মাও সেতুঙ “অনুশীলন সম্পর্কে” প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন মার্কসবাদী জ্ঞানতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে পার্টিতে মতান্ধতা এবং অভিজ্ঞতাবাদের আত্মমুখী ভুল এবং বিশেষ করে মতান্ধতার ভুল খুলে ধরার জন্য। প্রবন্ধটির নামকরণ “অনুশীলন সম্পর্কে” করা হয়। মতান্ধরা অনুশীলনকে ছোট করে দেখে, ফলে বিপ্লব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ব্যাপারটির সঙ্গে মতান্ধতার আত্মমুখিতা খুলে ধরার ওপর এই প্রবন্ধে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। প্রবন্ধটির ভাবধারা মাও সেতুঙ ইয়েনানে জাপ-বিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক কলেজে প্রদত্ত একটি বক্তৃতায় উপস্থিত করেছিলেন।


মার্কসের পূর্বে বস্তুবাদ, জ্ঞানের সমস্যাকে মানুষের সামাজিক প্রকৃতি এবং তার ঐতিহাসিক বিকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচার করত। সুতরাং তখন বস্তুবাদ সামাজিক অনুশীলনের ওপর জ্ঞানের নির্ভরশীলতা, অর্থাৎ উৎপাদন ও শ্রেণিসংগ্রামের ওপর জ্ঞানের নির্ভরশীলতা উপলব্ধি করতে অক্ষম ছিল।

সর্বোপরি, মার্কসবাদীরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষের কার্যকলাপকে সবচেয়ে মূল বাস্তব কার্যকলাপ বলে এবং তার অন্য সব কার্যকলাপের নির্ণায়ক বলে মনে করে। মানুষের জ্ঞান প্রধানত তার বৈষয়িক উৎপাদনের কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করে। এই কার্যকলাপের মধ্য দিয়েই সে ক্রমে ক্রমে প্রকৃতির ঘটনা, বৈশিষ্ট্য ও নিয়মগুলোকে এবং তার নিজের ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ককে বুঝতে সক্ষম হয়, এবং এই উৎপাদনী কার্যকলাপের মধ্য দিয়েই সে ক্রমশ মানুষের সঙ্গে মানুষের নির্দিষ্ট সম্পর্ককেও বিভিন্ন পরিমাণে বুঝতে সক্ষম হয়। উৎপাদনের কার্যকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে এই জ্ঞানের কিছুই অর্জন করা যায় না। শ্রেণিহীন সমাজে সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তিই সমাজের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে সাধারণ প্রচেষ্টায় যোগ দেয়, নির্দিষ্ট উৎপাদন-সম্পর্কে প্রবেশ করে এবং মানবজাতির বৈষয়িক প্রয়োজন মেটাবার জন্য উৎপাদনকর্মে লিপ্ত হয়। আবার সব শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির সদস্যরা বিভিন্নভাবে নির্দিষ্ট উৎপাদন-সম্পর্কে প্রবেশ করে এবং তাদের বৈষয়িক প্রয়োজন মেটাবার জন্য উৎপাদন-কর্মে লিপ্ত হয়। এটাই হলো মানুষের জ্ঞানের বিকাশের প্রাথমিক উৎস।

মানুষের সামাজিক অনুশীলন উৎপাদন-কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পরন্তু তা আরও অনেক রূপ পরিগ্রহ করে, যেমন শ্রেণিসংগ্রাম, রাজনৈতিক জীবন, বৈজ্ঞানিক ও শৈল্পিক অনুসন্ধিৎসামূলক কর্ম; সংক্ষেপে বলতে গেল, সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজের বাস্তব জীবনের সকল ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে। এইভাবে মানুষ, কেবল তার বৈষয়িক জীবনের মধ্য দিয়েই নয়, তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের (উভয়ই ঘনিষ্ঠভাবে বৈষয়িক জীবনের সঙ্গে জড়িত) মধ্য দিয়েও, বিভিন্ন পরিমাণে, মানুষের সঙ্গে মানুষের বিবিধ প্রকারের সম্পর্ক সম্বন্ধে জানতে পারে। এইসব অন্যান্য ধরনের সামাজিক অনুশীলনের মধ্যে বিশেষ করে সব রকমের শ্রেণিসংগ্রামই, শ্রেণিসংগ্রামের বিভিন্ন রূপ, মানুষের জ্ঞানের বিকাশের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রত্যেকেই কোনো না কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির সদস্য হিসেবে বাস করে, এবং ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রত্যেক ধরনের চিন্তাধারার ওপরই কোনো না কোনো শ্রেণির ছাপ থাকে।

মার্কসবাদীরা মনে করে যে, মানবসমাজে উৎপাদনের কার্যকলাপ নিম্নতর স্তর থেকে উচ্চতর স্তরে ধাপে ধাপে বিকাশ লাভ করে, কাজে কাজেই প্রকৃতি সম্পর্কেই হোক অথবা সমাজ সম্পর্কেই হোক মানুষের জ্ঞানও ধাপে ধাপে নিম্নতর থেকে উচ্চতর স্তরে, অর্থাৎ অগভীর জ্ঞান থেকে গভীর জ্ঞানে, একমুখী জ্ঞান থেকে বহুমুখী জ্ঞানে বিকাশ লাভ করে। ইতিহাসের একটা অত্যন্ত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে সমাজের ইতিহাস সম্পর্কে একটা একতরফা ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়েছিল, কারণ, একদিকে যেমন শোষক শ্রেণিগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট মতামত সর্বদাই সামাজিক ইতিহাসকে বিকৃত করত, তেমনি অন্যদিকে ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদন-ব্যবস্থা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে সীমিত করে রাখত। উৎপাদনের বিরাট শক্তিগুলোর (বৃহৎ শিল্পের) উদ্ভবের সঙ্গে আধুনিক সর্বহারাশ্রেণির আত্মপ্রকাশের পরেই কেবল মানুষ সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে সর্বাঙ্গীন ঐতিহাসিক ধারণা লাভ করতে এবং এই জ্ঞানকে একটি বিজ্ঞানে পরিণত করতে সমর্থ হয়। এই বিজ্ঞানই হলো মার্কসবাদের বিজ্ঞান।

মার্কসবাদীরা মনে করে যে, মানুষের সামাজিক অনুশীলনই বহির্জগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের সত্যতার একমাত্র মাপকাঠি। আসলে যা ঘটে তা এই যে, যখন মানুষ সামাজিক ব্যবহারের প্রক্রিয়ার (বৈষয়িক উৎপাদন, শ্রেণিসংগ্রাম অথবা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার প্রক্রিয়ার) মধ্য দিয়ে তার প্রত্যাশিত ফল লাভ করে, কেবল তখনই মানুষের জ্ঞানের সত্যতা প্রমাণিত হয়। যদি কোনো মানুষ কাজে সাফল্য লাভ করতে চায় অর্থাৎ প্রত্যাশিত ফল পেতে চায়, তাহলে তার নিজের চিন্তাকে অবশ্যই বাস্তবমুখী বহির্জগতের নিয়মের অনুরূপ করে তুলতে হবে; যদি তা অনুরূপ না হয়, তাহলে সে অনুশীলনে ব্যর্থ হবে। ব্যর্থ হয়ে মানুষ ঐ ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, নিজের চিন্তাকে সংশোধন করে ও বহির্জগতের নিয়মের অনুরূপ করে তোলে; এভাবেই মানুষ তার বিফলতাকে সফলতায় পরিবর্তিত করতে পারে; “বিফলতাই সফলতার জননী” এবং “ঠেকে শেখা” বলতে এটাই বোঝায়। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব অনুশীলনকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের জ্ঞানকে তার অনুশীলন থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। যেসব ভ্রান্ত মতবাদ অনুশীলনের গুরুত্বকে অস্বীকার করে অথবা জ্ঞানকে অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব সেইসব মতবাদের বিরোধী। এ সম্পর্কে লেনিন বলেছিলেন, (তত্ত্বগত) জ্ঞানের চেয়ে অনুশীলন উচ্চতর, কারণ তার শুধু যে সর্বজনীনতার গুণই আছে তাই নয়, আছে আশু বাস্তবতার গুণও।”[১] মার্কসবাদী দর্শনে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দুটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আছে। একটা হচ্ছে তার শ্রেণী প্রকৃতি: এটা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যে, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সর্বহারাশ্রেণির সেবায় নিয়োজিত। অপরটা হচ্ছে এর বাস্তব প্রকৃতি: এতে এই মতের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় যে, তত্ত্ব অনুশীলনের ওপর নির্ভরশীল এবং তত্ত্বের ভিত্তি হচ্ছে অনুশীলন আবার তত্ত্ব অনুশীলনের মধ্য দিয়ে কাজ করে। জ্ঞান বা তত্ত্বের সত্যতা আত্মমুখী অনুভূতির দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় সামাজিক প্রয়োগে তার বাস্তব ফলাফলের দ্বারা। সামাজিক প্রয়োগই সত্যের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্বে অনুশীলনের দৃষ্টিভঙ্গিই হলো প্রথম এবং মূল দৃষ্টিভঙ্গি।[২]

কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষের জ্ঞান কিভাবে অনুশীলন থেকে উদ্ভূত হয় এবং আবার অনুশীলনের মধ্য দিয়ে কাজ করে? আমরা যদি জ্ঞানের বিকাশের প্রক্রিয়ার দিকে তাকাই তাহলে এটা পরিষ্কার হবে।

অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় মানুষ প্রথমে শুধুমাত্র বস্তুর বাহ্যরূপ, পৃথক পৃথক দিক, বহিঃসম্বন্ধগুলোকেই দেখতে পায়। যেমন, যাঁরা বাইরে থেকে ইয়েনান পরিদর্শনে আসেন, তাঁদের কথাই ধরা যাক্। প্রথম দু-এক দিন তাঁরা দেখেন ইয়েনানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর; অনেক লোকের সঙ্গে তাঁরা দেখা-সাক্ষাৎ করেন, ভোজসভায়, সান্ধ্য অনুষ্ঠানে, জনসভায় যোগ দেন, নানা ধরনের কথাবার্তা শোনেন এবং বিভিন্ন রকম দলিলপত্র পাঠ করেন। এই সব-কিছুই হলো বস্তুর বাহ্যরূপ, পৃথক পৃথক দিক, বহিঃসম্বন্ধ। এটাকে বলা হয় জ্ঞানপ্রক্রিয়ার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পর্যায়, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভূতি লাভের ও ছাপ পড়ার পর্যায়। অর্থাৎ ইয়েনানে এই বিশেষ বস্তুগুলো পরিদর্শক দলের সদস্যদের ইন্দ্রিয়গুলোর ওপর ক্রিয়া করে, তাঁদের অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে এবং তাঁদের মস্তিষ্কে নানা ছাপ ফেলে ও এইসব ছাপের মধ্যকার বহিঃসম্বন্ধের একটা ভাসাভাসা ছবি এঁকে দেয়; এটাই হলো জ্ঞানের প্রথম পর্যায়। এই পর্যায়ে মানুষ গভীর ধারণা গঠন করতে পারে না, পারে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত টানতে।

সামাজিক অনুশীলন চলার সঙ্গে সঙ্গে, যে বিষয়গুলো মানুষের অনুশীলনের মধ্যে মানুষের ইন্দ্রিয়ানুভূতির ও ছাপগুলোর জন্ম দেয়, সেই বিষয়গুলোর বহুবার পুনরাবৃত্তি ঘটে; তখন মানুষের মস্তিষ্কে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা আকস্মিক পরিবর্তন (অর্থাৎ দ্রুত-অতিক্রমণ) ঘটে এবং ধারণা গঠিত হয়। এই ধারণাগুলো তখন আর বস্তুর বাহ্যরূপ, তাদের পৃথক পৃথক দিক এবং তাদের বহিঃসম্বন্ধ নয়; সেগুলো তখন বস্তুর মর্মকে, সমগ্রতাকে এবং অন্তঃসম্পর্ককে আয়ত্ত করে। ধারণা এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যে শুধুমাত্র পরিমাণগত পার্থক্যই নয়, গুণগত পার্থক্যও থাকে। এইভাবে আরও এগিয়ে গিয়ে বিচার ও অনুমিতির সাহায্যে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভবপর হয়। সান কুও ইয়ান ই-তে (তিন রাজ্যের কাহিনী) উল্লিখিত “ভ্রু কোঁচকালেই মাথায় কৌশল আসে” বলতে অথবা চলতি কথায় “ব্যাপারটা ভেবে দেখি” বলতে মানুষ কর্তৃক মস্তিষ্কের ধারণাগুলোকে বিচার ও অনুমিতি গঠনে ব্যবহার করার প্রচেষ্টাকেই বোঝায়। এটা হলো জ্ঞানপ্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্যায়। যখন পরিদর্শক—দলের সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করার এবং তদুপরি “ঐগুলো ভেবে দেখার কাজটি শেষ করেন, তখনই তাঁরা এই বিচারে এসে পৌঁছতে পারেন যে, “কমিউনিস্ট পার্টির জাপ-বিরোধী জাতীয় যুক্তফ্রন্টের নীতি পূর্ণাঙ্গ, আন্তরিক এবং সাচ্চা”। যদি তাঁরাও দেশকে বাঁচাবার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সাচ্চা হন তবে এই বিচারে পৌঁছানোর পর তাঁরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে, “জাপ-বিরোধী জাতীয় যুক্তফ্রন্ট সাফল্য লাভ করতে পারে”। ধারণা, বিচার এবং অনুমিতির এই পর্যায় হচ্ছে কোনো বস্তুকে জানার সমগ্র প্রক্রিয়ায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়; এই পর্যায় হচ্ছে যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানের পর্যায়। জানার আসল কাজটি হলো ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্য দিয়ে চিন্তায় পৌঁছানো, ধাপে ধাপে বাস্তব বস্তুর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়ে, তার নিয়ম সম্পর্কে এবং একটি প্রক্রিয়া ও আরেকটি প্রক্রিয়ার মধ্যকার অভ্যন্তরীণ সম্বন্ধের বিষয়ে উপলব্ধিতে পৌঁছানো অর্থাৎ যৌক্তিক জ্ঞানে পৌঁছানো। আবার বলা যায়, যৌক্তিক জ্ঞানের সঙ্গে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের তফাৎ এইখানে যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান বস্তুর পৃথক পৃথক দিক, বাহ্যরূপ এবং বহিঃসম্বন্ধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, আর যৌক্তিক জ্ঞান সম্মুখের দিকে একটা বড় ধাপ অগ্রসর হয়ে বস্তুর সমগ্রতা, সারমর্ম ও অভ্যন্তরীণ সম্বন্ধে গিয়ে পৌছায় এবং পারিপার্শ্বিক জগতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করে। সুতরাং যৌক্তিক জ্ঞান পারিপার্শ্বিক জগতের বিকাশকে তার সমগ্রতায়, তার সমস্ত দিকগুলোর অভ্যন্তরীণ সম্বন্ধসমেত আয়ত্ত করতে সক্ষম।

আরো পড়ুন:  জনগণের ভেতরকার দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসা

অনুশীলনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এবং অগভীর থেকে গভীরের দিকে অগ্রসরমান এই জ্ঞানবিকাশের প্রক্রিয়ার দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী তত্ত্ব মার্কসবাদের উদ্ভবের পূর্বে কেউ কখনও উপস্থাপন করেননি। মার্কসীয় বস্তুবাদই সর্বপ্রথম এই সমস্যার সঠিকভাবে সমাধান করে, বস্তুবাদী ও দ্বান্দ্বিক উভয় দিক থেকেই জ্ঞানের ক্রমগভীর গতিকে দেখিয়ে দেয়, এবং দেখিয়ে দেয় যে, সমাজে মানুষ তার উৎপাদন ও শ্রেণিসংগ্রামের জটিল ও নিয়মিতভাবে পুনরাবর্তনশীল অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান থেকে যৌক্তিক জ্ঞানের দিকে এগিয়ে যায়। লেনিন বলেছিলেন, পদার্থের বিমূর্তকরণ, প্রকৃতির নিয়মের বিমূর্তকরণ, মূল্যের বিমূর্তকরণ প্রভৃতি, সংক্ষেপে সকল বিজ্ঞানসম্মত (সঠিক, গুরুত্বপূর্ণ, ভ্রমশূন্য) বিমূর্তকরণ প্রকৃতিকে আরও গভীরভাবে, সঠিকভাবে এবং পূর্ণভাবে প্রতিফলিত করে।[৩] মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতে জ্ঞানের প্রক্রিয়ার দুটো পর্যায়ের প্রত্যেকটিরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, নিম্ন পর্যায়ে জ্ঞান আত্মপ্রকাশ করে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান রূপে, আর উচ্চতর পর্যায়ে তা আত্মপ্রকাশ করে যৌক্তিক জ্ঞান রূপে; কিন্তু উভয় পর্যায়ই হলো জ্ঞান লাভের একই প্রক্রিয়ার অংশ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান এবং যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞান গুণগতভাবে পৃথক; কিন্তু পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; অনুশীলনের ভিত্তিতে তারা একীভূত। আমাদের অনুশীলন প্রমাণ করে যে, যা অনুভব করা যায় তা তৎক্ষণাৎ হৃদয়ঙ্গম করা যায় না; এবং যা হৃদয়ঙ্গম করা হয়েছে কেবল তা-ই অধিকতর গভীরভাবে অনুভব করা যায়। ইন্দ্রিয়ানুভূতি শুধুমাত্র বস্তুর বাহ্যরূপের সমস্যারই সমাধান করে; আর একমাত্র তত্ত্বই পারে মর্মগত সমস্যার সমাধান করতে। এই উভয় সমস্যার সমাধানকে অনুশীলন থেকে একটুও আলাদা করা যায় না। কেউ কোনো বস্তুকে জানতে চাইলে তার সংস্পর্শে আসা, অর্থাৎ সে বস্তুর পরিবেশে বাস করা (অনুশীলন করা) ছাড়া, সে ব্যক্তির আর কোনো উপায় নেই। সামন্তবাদী সমাজে পুঁজিবাদী সমাজের নিয়মগুলোকে আগে থেকে জানা অসম্ভব ছিল, কারণ তখনও পুঁজিবাদের আবির্ভাব ঘটেনি এবং তার প্রাসঙ্গিক অনুশীলনও ছিল না। একমাত্র পুঁজিবাদী সমাজ থেকেই মার্কসবাদের জন্ম সম্ভব ছিল। অবাধ পুঁজিবাদের যুগে মার্কসের পক্ষে সাম্রাজ্যবাদী যুগের বিশেষ কতকগুলো নিয়ম আগে থেকে বাস্তবভাবে জানা অসম্ভব ছিল, কারণ সাম্রাজ্যবাদ, অর্থাৎ পুঁজিবাদের সর্বশেষ পর্যায়, তখনও পর্যন্ত দেখা দেয়নি এবং তার প্রাসঙ্গিক অনুশীলনও ছিল না। একমাত্র লেনিন ও স্তালিনই পেরেছিলেন সেই দাযিত্ব গ্রহণ করতে। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন ও স্তালিনের প্রতিভার কথা বাদ দিলেও, তাঁরা যে তাঁদের তত্ত্বগুলো প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন তার কারণ প্রধানত এই ছিল যে, তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের সময়কার শ্রেণিসংগ্রামের এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুশীলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন; এই শর্তের অভাব থাকলে কোনো প্রতিভাশালী ব্যক্তির পক্ষেও সাফল্য লাভ করা সম্ভব হত না। প্রাচীনকালে যখন প্রযুক্তিবিদ্যা ছিল অনুন্নত, তখন—“পন্ডিত ব্যক্তি ঘরে বসেই বিশাল বিশ্বের সব কিছু ব্যাপার জানতে পারেন”—এই কথা ছিল একেবারেই ফাঁকা বুলি। উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার বর্তমান যুগে যদিও এই কথাটা সঙ্গত হতে পারে, তবু এই বিরাট বিশ্বব্যাপী যাঁরা অনুশীলনে নিয়োজিত কেবল তাঁরাই হচ্ছেন খাঁটি নিজস্ব জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি। এইসব ব্যক্তি যখন তাঁদের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে “জ্ঞান” লাভ করেন আর তাঁদের সেই জ্ঞান যখন রচনা ও প্রযুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে “পন্ডিত ব্যক্তির” কাছে পৌঁছায়, কেবল তখনই তিনি পরোক্ষভাবে “বিশাল বিশ্বের সব কিছু ব্যাপার জানতে পারেন”। আপনি যদি কোনো একটি বস্তু অথবা বস্তুশ্রেণিকে প্রত্যক্ষভাবে জানতে চান, তবে বাস্তবকে পরিবর্তন করার, সেই বস্তু অথবা বস্তুশ্রেণিকে পরিবর্তন করার বাস্তব সংগ্রামে আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে, কারণ কেবল এভাবেই আপনি সেই বস্তু বা বস্তুশ্রেণির বাহ্যরূপের সংস্পর্শে আসতে পারেন; এবং বাস্তবকে পরিবর্তন করার বাস্তব সংগ্রামে ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই কেবল আপনি সেই বস্তু অথবা বস্তুশ্রেণির মমর্কে অনাবৃত করতে ও হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। আসলে প্রত্যেক মানুষই জ্ঞানলাভের জন্য এই পথেই চলে, যদিও কিছু লোক ঘটনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করে বিপরীত তর্ক করে। দুনিয়ায় সবচেয়ে উপহাস্যাস্পদ ব্যক্তি হচ্ছে সেই “সবজান্তা”, যে জনশ্রুতি থেকে ভাসাভাসা জ্ঞান সংগ্রহ করে নিজকে “দুনিয়ার এক নম্বর জ্ঞানী” বলে জাহির করে। এতে শুধু এটাই প্রমাণিত হয় যে, নিজের সম্পর্কে তার যথাযথ ধারণা নেই। জ্ঞান হচ্ছে বিজ্ঞানের ব্যাপার, এ ব্যাপারে কোনোরকম কপটতা কিংবা অহমিকার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে না; যা দরকার তা ঠিক এর বিপরীত—অর্থাৎ সততা ও বিনয়। যদি আপনি জ্ঞানার্জন করতে চান তাহলে বাস্তবকে পরিবর্তন করার অনুশীলনে আপনাকে অবশ্যই অংশগ্রহণ করতে হবে। যদি আপনি নাশপাতির স্বাদ জানতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই নাশপাতি খেয়ে তার বাস্তব রূপের পরিবর্তন করতে হবে। যদি আপনি পরমাণুর গঠন ও গুণাগুণ সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে পরমাণুর অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য পদার্থবিজ্ঞানের ও রসায়নের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেই হবে। যদি আপনি বিপ্লবের তত্ত্ব ও পদ্ধতি জানতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করতে হবে। সমস্ত প্রকৃত জ্ঞানের উৎস হচ্ছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। কিন্তু একজনের পক্ষে সবকিছুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করা সম্ভব নয়; বাস্তবিকপক্ষে, আমাদের জ্ঞানের অধিকাংশই আসে পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে, যেমন, প্রাচীনকালের ও বিদেশের সকল জ্ঞান। আমাদের পূর্বপুরুষ এবং বিদেশীদের কাছে এই জ্ঞান প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয়। তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সময়ে এই জ্ঞান যদি লেনিনের উল্লিখিত “বিজ্ঞানসম্মত বিমূর্তকরণের” শর্ত পূরণ এবং বিষয়মুখী বাস্তবকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিফলিত করে থাকে তাহলে এই জ্ঞান নির্ভরযোগ্য; অন্যথায় নয়। সুতরাং একজন মানুষের জ্ঞান কেবল দুটি অংশ নিয়ে গঠিত, একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আসে, আরেকটি পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। অধিকন্তু, যেটা আমার কাছে পরোক্ষ অভিজ্ঞতা, অন্য লোকের কাছে সেটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। অতএব, সমগ্রভাবে বিচার করলে, যে কোনো ধরনের জ্ঞানকেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। মানুষের দৈহিক ইন্দ্রিয়গুলোর দ্বারা বিষয়মুখী বহির্জগৎকে অনুভব করার মধ্য দিয়েই সকল জ্ঞানের উৎপত্তি। যে ব্যক্তি এরূপ ইন্দ্রিয়-অনুভূতিকে অস্বীকার করে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে, অথবা বাস্তবকে পরিবর্তন করার অনুশীলনে ব্যক্তিগত অংশগ্রহণকে অস্বীকার করে, সে বস্তুবাদী নয়। এই কারণেই, “সবজান্তা” ব্যক্তি উপহাস্যাস্পদ। একটা পুরোনো চীনা প্রবাদ আছে: “বাঘের গুহায় না ঢুকে কি বাঘের বাচ্চা ধরা যায়?” কথাটা মানুষের অনুশীলনের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনই সত্য জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রেও। অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন জ্ঞান অসম্ভব।

বাস্তবকে পরিবর্তন করার অনুশীলনের ভিত্তিতে উদ্ভূত জ্ঞানের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ক্রিয়াকে—জ্ঞানের ক্রমগভীর ক্রিয়াকে—স্পষ্ট করে বোঝাবার জন্য আরো কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো।

পুঁজিবাদী সমাজ সম্পর্কে জ্ঞানের ক্ষেত্রে, সর্বহারাশ্রেণি তার অনুশীলনের প্রথম যুগে অর্থাৎ মেশিনভাঙ্গা ও স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামের যুগে, কেবল জ্ঞানের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পর্যায়ে ছিল; সেই যুগে সে শুধুমাত্র পুঁজিবাদের বাহ্যরূপের কয়েকটি দিক ও বহিঃসম্বন্ধ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। সর্বহারাশ্রেণি তখনও ছিল “নিজের মধ্যেই শ্রেণি”। কিন্তু সর্বাহারা শ্রেণি যখন তার অনুশীলনের দ্বিতীয় যুগে, অর্থাৎ সচেতন এবং সংগঠিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের যুগে পৌঁছায়, তখন সে পুঁজিবাদী সমাজের সারমর্মকে, সামাজিক শ্রেণিগুলোর মধ্যকার শোষণের সম্পর্ককে এবং সর্বহারা শ্রেণির নিজ ঐতিহাসিক কর্তব্যকে বুঝতে পারে। এবং তার এই বুঝতে পারার কারণ ছিল তার নিজের অনুশীলন এবং দীর্ঘ সংগ্রামে তার অভিজ্ঞতা—সর্বহারা শ্রেণির শিক্ষার জন্য মার্কসবাদী তত্ত্বের সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মার্কস ও এঙ্গেলস বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে এই অভিজ্ঞতার সারসংকলন করেছিলেন। আর তখনই সর্বহারা শ্রেণি “নিজের জন্য-শ্রেণি”তে পরিণত হলো।

সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে চীনা জনগণের জ্ঞানের ব্যাপারেও একই কথা। প্রথম পর্যায় ছিল ভাসাভাসা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের পর্যায়; যার প্রতিফলন দেখা যায় থাইপিং স্বর্গীয় রাজ্যের আন্দোলনে এবং ইহোথুয়ান আন্দোলন প্রভৃতিতে নির্বিচারে বিদেশী-বিরোধী সংগ্রামগুলোর ক্ষেত্রে। কেবল দ্বিতীয় পর্যায়েই চীনা জনগণ যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানের পর্যায়ে পৌঁছে, সাম্রাজ্যবাদের ভিতরের ও বাইরের দ্বন্দ্বগুলোকে দেখে এবং সাম্রাজ্যবাদ যে ব্যাপক চীনা জনগণকে নিপীড়ন ও শোষণ করার জন্য চীনের মুৎসুদ্দি ও সামন্ত শ্রেণিগুলোর সঙ্গে হাত মেলায়, এই সার সত্যকে দেখে। ১৯১৯ সালের ৪ঠা মে আন্দোলনের কাছাকাছি সময়ে এই জ্ঞানের শুরু হয়েছিল।

এর পর, যুদ্ধের কথা বিবেচনা করা যাক। যারা যুদ্ধ পরিচালনা করে তাদের যদি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা না থাকে, তাহলে গোড়ার দিকে তারা একটি নির্দিষ্ট যুদ্ধ (যেমন আমাদের বিগত দশ বছরের ভূমি-বিপ্লবের যুদ্ধ) পরিচালনা করার সুগভীর নিয়মগুলো উপলব্ধি করতে পারবে না। গোড়ার দিকে তাদের কেবল বেশ কিছু লড়াই লড়ার অভিজ্ঞতা হবে এবং তার চেয়েও যা বেশি, অনেক পরাজয় বরণ করতে হবে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা (জেতা লড়াইগুলোর অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ করে হারা লড়াইগুলোর অভিজ্ঞতা) দ্বারাই তারা গোটা যুদ্ধের অন্তর্নিহিত সূত্র অর্থাৎ ঐ নির্দিষ্ট যুদ্ধের নিয়মগুলো হৃদয়ঙ্গম করতে, রণনীতি ও রণকৌশল বুঝতে সক্ষম হবে এবং ফলে আস্থার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। যদি, এ রকম মুহূর্তে অনভিজ্ঞ ব্যক্তির হাতে পরিচালনার ভার তুলে দেওয়া হয়, তবে তাকেও যুদ্ধের সঠিক নিয়মাবলী হৃদয়ঙ্গম করতে পারার আগে অনেক পরাজয় সইতে হবে (অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে)।

“আমি নিশ্চিত নই যে, এটা আমি পারব।”—যখন একজন কমরেড একটি ন্যস্ত কাজ গ্রহণ করতে ইতস্তত করে তখন প্রায়শ এই মন্তব্য আমরা শুনতে পাই। নিজের সম্পর্কে তার এই অনিশ্চয়তা কেন? কারণ, ন্যস্ত কাজটির বিষয়বস্তু ও পরিবেশ সম্পর্কে তার কোনো যথাযথ ধারণা নেই, অথবা ঐ ধরনের কাজের সে অতি অল্পই সংস্পর্শে এসেছে বা একেবারেই আসেনি; এবং সেজন্য ঐ কাজের নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মগুলো তার আয়ত্তের বাইরে। কাজটির প্রকৃতি ও পরিবেশ পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ করার পর সে নিজের সম্পর্কে অধিক নিশ্চিত বোধ করবে এবং স্বেচ্ছায় কাজটি করবে। যদি সে ঐ কাজে কিছুটা সময় ব্যয় করে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করে, যদি সে এমন লোক হয় যে, খোলা মন নিয়ে কোনো বিষয়কে দেখতে আগ্রহী এবং সমস্যাকে আত্মগতভাবে, একতরফাভাবে এবং ভাসাভাসাভাবে বিচার না করে, তাহলে কাজটিকে কিভাবে করতে হবে সে বিষয়ে সে নিজেই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবে এবং আরও বেশি সাহসের সঙ্গে কাজটি করবে। যারা আত্মগত, একতরফা এবং ভাসাভাসাভাবে সমস্যাকে দেখে, শুধু তারাই কোনো জায়গায় আসামাত্র পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা না করে, ব্যাপারটাকে সামগ্রিকভাবে (তার ইতিহাস ও সমগ্র বর্তমান অবস্থাকে) বিবেচনা না করে এবং তার সারমর্ম (তার প্রকৃতি এবং একটির সঙ্গে অন্য ব্যাপারের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক) উপলব্ধি না করেই আত্মতৃপ্তির সঙ্গে হুকুম জারি করতে থাকে। এ ধরনের লোক হোঁচট খেয়ে ধরাশায়ী হতে বাধ্য।

আরো পড়ুন:  জ্ঞানতত্ত্ব হচ্ছে জ্ঞানলাভের মর্ম, নিয়মাবলী ও রূপ সম্পর্কে শিক্ষা

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বহির্জগতের বস্তুর সঙ্গে সংস্পর্শ হলো জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় প্রথম ধাপ; এটা ইন্দ্রিয়ানুভূতির পর্যায়ের অন্তর্গত। দ্বিতীয় ধাপটি হলো ইন্দ্রিয়ানুভূতি-লব্ধ তথ্যগুলোকে সাজিয়ে ও পুনর্গঠন করে সেগুলোর সমন্বয় সাধন করা; এটা ধারণা, বিচার-বিবেচনা এবং অনুমিতির পর্যায়ের অন্তর্গত। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্যগুলো যখন খুব সমৃদ্ধ (অংশমাত্র নয়) ও বাস্তব-অনুগামী (মোহময় নয়) হয়, একমাত্র তখনই সেগুলো সঠিক ধারণা ও তত্ত্ব গঠনের ভিত্তি হতে পারে।

এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমটি আগেই বলা হয়েছে, তবু এখানে আবার বলা উচিত। সেটি হলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের উপর যুক্তিসহ জ্ঞানের নির্ভরশীলতা। যিনি মনে করেন যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান থেকে যুক্তিসহ জ্ঞানের উদ্ভূত হওয়ার প্রয়োজন নেই, তিনি একজন ভাববাদী। দর্শনের ইতিহাসে “যুক্তিবাদী” গোষ্ঠী রয়েছে যারা কেবল যুক্তির বাস্তবতাকেই স্বীকার করে, অভিজ্ঞতার বাস্তবতাকে নয়। তাদের বিশ্বাস; একমাত্র যুক্তিই নির্ভরযোগ্য আর ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা নির্ভরযোগ্য নয়। এই গোষ্ঠী বিষয়কে উল্টো করে দেখার ভুল করে থাকে। যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞান কেবল এই কারণেই নির্ভরযোগ্য যে, তার উৎস নিহিত রয়েছে ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যে। অন্যথায় তা হত উৎসহীন জলধারা বা শিকড়হীন গাছের মত, মনগড়া, আত্মজাত এবং অনির্ভরযোগ্য। জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়ায় ক্রম অনুযায়ী সর্বপ্রথম আসে ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা; আমরা জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় সামাজিক ব্যবহারের তাৎপর্যের ওপর বিশেষ জোর দেই কেবল এই কারণে যে, একমাত্র সামাজিক ব্যবহারই মানুষের জ্ঞানের জন্ম দিতে পারে এবং মানুষকে বাস্তব বহির্জগৎ থেকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা আহরণে চালিত করতে পারে। যে লোক তার চোখ কান বন্ধ রাখে এবং সম্পূর্ণভাবে নিজেকে বাস্তব বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে, তার জন্য জ্ঞান বলে কিছু থাকতে পারে না। অভিজ্ঞতা থেকেই জ্ঞানের সূচনা—এই হলো জানতত্ত্বের বস্তুবাদ।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো এই যে, জ্ঞানকে গভীরতর করা দরকার, জ্ঞানের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পর্যায়কে যুক্তিসিদ্ধ পর্যায়ে উন্নীত করা প্রয়োজন—এটাই হলো জ্ঞানতত্ত্বের দ্বন্দ্ববাদ[৪]। জ্ঞান নিম্নতর, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পর্যায়ে থেমে থাকতে পারে এবং শুধু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানই নির্ভরযোগ্য, আর যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞান নির্ভরযোগ্য নয়—এভাবে চিন্তা করলে “অভিজ্ঞতাবাদের” ঐতিহাসিক ভুলের পুনরাবৃত্তি করা হবে। এই মতবাদের ভুল হলো এটা না বোঝা যে, ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যগুলো বাস্তব বহির্জগতের কতকগুলো সত্যকে প্রতিফলিত করলেও (আমি এখানে সেই ভাববাদী অভিজ্ঞতাবাদের কথা বলছি না, যা অভিজ্ঞতাকে তথাকথিত অন্তর্দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে) সেগুলো নিছক একপেশে ও ভাসাভাসা, সেগুলো বিষয়কে অসম্পূর্ণভাবে প্রতিফলিত করে এবং বিষয়ের সারমর্মকে প্রতিফলিত করে না। কোনো বিষয়কে সম্পূর্ণরূপে তার সমগ্রতায় প্রতিফলিত করতে হলে, বিষয়ের মর্মবস্তুকে ও তার অন্তর্নিহিত নিয়মগুলোকে প্রতিফলিত করতে হলে প্রয়োজন চিন্তার মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির সমৃদ্ধ তথ্যগুলোকে পুনর্গঠন করা—গাদ পরিত্যাগ করে সারবস্তু বেছে নেওয়া, মিথ্যাকে বাদ দিয়ে সত্যকে গ্রহণ করা, এক বিষয় থেকে শুরু করে অন্য বিষয়ে যাওয়া, এবং বাইরে থেকে শুরু করে ভিতরে যাওয়া, ধারণা ও তত্ত্বের একটা প্রণালী গঠনের জন্য প্রয়োজন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান থেকে যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানে একটা দ্রুত-অতিক্রমণ। এইরূপ পুনর্গঠিত জ্ঞান অধিকতর ফাঁকা বা অনির্ভরযোগ্য নয়; বরং বিপরীতভাবে, জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় অনুশীলনের ভিত্তিতে যা কিছু বিজ্ঞানসম্মতভাবে পুনর্গঠিত হয়, তা-ই, লেনিনের ভাষায়, আরও গভীররূপে, আরও সঠিকরূপে এবং আরও পরিপূর্ণরূপে বাস্তব বিষয়গুলোকে প্রতিফলিত করে। বিপরীত পক্ষে, অমার্জিত “ব্যবহারিক ব্যক্তিরা” অভিজ্ঞতাকে মর্যাদা দেয় কিন্তু তত্ত্বকে অবজ্ঞা করে; সেজন্য তারা একটা সমগ্র বাস্তব প্রক্রিয়া সম্বন্ধে ব্যাপক ধারণা করতে পারে না, তাদের স্পষ্ট দিশা ও দূরদৃষ্টি নেই, তারা কখনও কখনও দু-একটা সাফল্য ও সত্যের আভাস লাভেই আত্মতুষ্ট। এ ধরনের লোকেরা যদি বিপ্লব পরিচালনা করে, তারা তাকে কানাগলিতে নিক্ষেপ করবে।

যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞান নির্ভর করে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের ওপর এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানকে উন্নীত করতে হয় যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানে- এটাই হচ্ছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব। দর্শনশাস্ত্রে “যুক্তিবাদ” বা “অভিজ্ঞতাবাদ” কোনোটাই জ্ঞানের ঐতিহাসিক বা দ্বান্দ্বিক প্রকৃতিকে বোঝে না। যদিও মতবাদ দুটির প্রত্যেকটির মধ্যেই সত্যের এক একটি দিক আছে (এখানে আমি বস্তুবাদী যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের কথাই বলছি, ভাববাদী যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের কথা বলছি না), তবু উভয় মতবাদই সামগ্রিকভাবে জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে ভ্রান্ত। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য থেকে যুক্তিসিদ্ধ পর্যায়ে জ্ঞানের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী গতিটা জ্ঞানের একটা ছোটখাটো প্রক্রিয়ার (যেমন, কোনো একটিমাত্র বস্তু বা কাজ জানার) বেলায় যেমন সত্য, তেমনি জ্ঞানের একটা বৃহৎ প্রক্রিয়ার (যেমন, একটা গোটা সমাজকে বা একটা বিপ্লবকে জানার) বেলায়ও সত্য।

কিন্তু জ্ঞানের ক্রিয়ার এখানেই শেষ নয়। যদি জ্ঞানের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ক্রিয়া যুক্তিসহ জ্ঞানে এসে থামত, তাহলে কেবল অর্ধেক সমস্যারই সমাধান হত; এবং যে অর্ধাংশটি মার্কসবাদী দর্শনের দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় কেবল সেটুকুরই সমাধান হত। মার্কসবাদী দর্শনের মতানুসারে বাস্তব জগতের নিয়মাবলী বোঝা এবং এইভাবে তাকে ব্যাখ্যা করতে পারাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নয়, বরং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো এই জ্ঞানের প্রয়োগ দ্বারা জগৎকে সক্রিয়ভাবে বদলে দেওয়ার সমস্যা। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ এবং এর গুরুত্ব পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পায় লেনিনের এই বক্তব্যে : “বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া কোনো বিপ্লবী আন্দোলন হতে পারে না।”[৫] কিন্তু মার্কসবাদ তত্ত্বের গুরুত্বের ওপর জোর দেয় একথা ঠিক এবং শুধুমাত্র এই কারণেই দেয় যে, তত্ত্ব কর্মের পথনির্দেশ করতে পারে। আমাদের কাছে যদি একটা নির্ভুল তত্ত্ব থাকে, কিন্তু যদি তা নিয়ে আমরা শুধু বকবকই করি, তাকে খোপের মধ্যে তুলে রেখে দেই এবং কাজে না লাগাই, তাহলে সে তত্ত্বটি যত ভালই হোক না কেন, তার কোনো তাৎপর্যই থাকে না। অনুশীলন থেকে জ্ঞানের শুরু হয়, এবং অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত তাত্ত্বিক জ্ঞানকে আবার অবশ্যই অনুশীলনে ফিরে আসতে হবে। জ্ঞানের সক্রিয় ভূমিকা যে কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান থেকে যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানে সক্রিয়ভাবে দ্রুত-অতিক্রমণের মধ্যেই ব্যক্ত হয় তা নয়, বরং আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞান থেকে বিপ্লবী অনুশীলনে দ্রুত-অতিক্রমণের মধ্যেও তা অভিব্যক্ত হয়। যে জ্ঞান জগতের নিয়মকে আয়ত্ত করে, তাকে অবশ্যই আবার জগৎকে পরিবর্তন করার অনুশীলনে নিয়োজিত করতে হবে, তাকে নতুন করে প্রয়োগ করতে হবে উৎপাদনের অনুশীলনে, বিপ্লবী শ্রেণিসংগ্রাম ও জাতীয় সংগ্রামের অনুশীলনে এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুশীলনে। এটা হচ্ছে তত্ত্বকে পরীক্ষা ও বিকশিত করার প্রক্রিয়া, জ্ঞানের সমগ্র প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা। তত্ত্ব বাস্তব সত্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি-না—এই সমস্যার পুরোপুরি সমাধান পূর্বোক্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য থেকে যুক্তিসিদ্ধ পর্যায়ে জ্ঞানের ক্রিয়ার মধ্যে হয় না এবং হতেও পারে না। সমস্যাটির পুরোপুরি সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানকে আবার সামাজিক অনুশীলনের দিকে চালিত করা, তত্ত্বকে অনুশীলনে প্রয়োগ করা এবং এতে প্রত্যাশিত উদ্দেশ্য সাধিত হয় কি-না তা দেখা। প্রকৃতিবিজ্ঞানের অনেক তত্ত্বকেই কেবল এইজন্য সত্য বলে গণ্য করা হয় না যে, প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা যখন তত্ত্বগুলো উদ্ভাবন করেছিলেন তখন এগুলোকে সত্য বলে গণ্য করা হত; বরং এই জন্য যে, পরবর্তী বৈজ্ঞানিক অনুশীলনেও ঐগুলো সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে কেবল এই জন্য সত্য বলে গণ্য করা হয় না যে, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন এবং স্তালিন যখন বিজ্ঞানসম্মতভাবে ঐ মতবাদ উদ্ভাবন করেছিলেন তখন সেটা সত্য বলে গণ্য করা হত; বরং এইজন্যও যে, পরবর্তী বিপ্লবী শ্রেণিসংগ্রাম ও জাতীয় সংগ্রামের অনুশীলনে ঐ মতবাদ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ একটি সর্বজনীন সত্য, কারণ কেউই নিজের অনুশীলনে এর আওতা থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। মানুষের জ্ঞানের ইতিহাস আমাদের বলে দেয় যে, বহু তত্ত্বের সত্যতাই অসম্পূর্ণ এবং এই অসম্পূর্ণতা অনুশীলনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শোধরানো যায়। বহু তত্ত্বই ভুল এবং অনুশীলনের পরীক্ষার মধ্য দিয়েই সেসব তত্ত্বের ভুলগুলো শোধরানো যায়। সেজন্যই অনুশীলন হলো সত্যের মাপকাঠি এবং সেইজন্যই “জীবনের ও অনুশীলনের দৃষ্টিকোণই জ্ঞানতত্ত্বের প্রথম ও মৌলিক দৃষ্টিকোণ হওয়া উচিত”[৬]। স্তালিন ঠিকই বলেছেন, “বিপ্লবী অনুশীলনের সঙ্গে যুক্ত না হলে তত্ত্ব হয়ে পড়ে উদ্দেশ্যহীন, ঠিক যেমন বিপ্লবী তত্ত্বের দ্বারা তার পথ আলোকিত না হলে অনুশীলন অন্ধকারে পথ হাতড়ায়।”[৭]

এ-পর্যন্ত এসেই কি জ্ঞানের ক্রিয়া শেষ হয়ে যায়? আমাদের উত্তর: হ্যা, এবং সেই সঙ্গে না-ও বটে। বিকাশের কোনো একটি পর্যায়ে কোনো একটি বাস্তব প্রক্রিয়াকে (প্রাকৃতিক হোক বা সামাজিক হোক) পরিবর্তন করার অনুশীলনে যখন সমাজের মানুষ নিজেদের নিয়োজিত করে, তখন তারা তাদের মস্তিষ্কে বাস্তব প্রক্রিয়ার প্রতিফলন ও তাদের সজ্ঞান কর্মতৎপর ভূমিকা পালনের ফলে তাদের জ্ঞানকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পর্যায় থেকে যুক্তিসিদ্ধ পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং ঐ বাস্তব প্রক্রিয়ার নিয়মাবলীর সঙ্গে সাধারণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ চিন্তাধারা, তত্ত্ব, পরিকল্পনা বা কর্মসূচী সৃষ্টি করতে পারে। তারপর তারা ঐ চিন্তাধারা, তত্ত্ব, পরিকল্পনা বা কর্মসূচীগুলোকে ঐ একই বাস্তব প্রক্রিয়ার অনুশীলনে প্রয়োগ করে। এবং যদি তারা প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারে অর্থাৎ যদি ঐ একই প্রক্রিয়ার অনুশীলনে তারা ঐ পূর্ব-নিরূপিত চিন্তাধারা, তত্ত্ব, পরিকল্পনা বা কর্মসূচীগুলোকে বাস্তবে রূপায়িত করতে অথবা মোটামুটিভাবে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারে, তাহলে ঐ নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে জ্ঞানের ক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে বলে গণ্য করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্রকৃতিকে বদলানোর প্রক্রিয়ায় একটি ইঞ্জিনিয়ারিং পরিকল্পনার বাস্তবে রূপায়ণ, একটা বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের সত্য প্রতিপাদন, একটা যন্ত্রের উৎপাদন বা কোনো ফসল কাটা; অথবা সমাজকে বদলানোর প্রক্রিয়ায় একটি ধর্মঘটের সাফল্য, একটি যুদ্ধে জয়লাভ বা একটি শিক্ষা পরিকল্পনার রূপায়ণ—এ সব কিছুকেই প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জন বলে গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে বলতে গেলে, প্রকৃতিকে বদলানোর অনুশীলনেই হোক অথবা সমাজকে বদলানোর অনুশীলনেই হোক, মানুষের পূর্ব-নিরূপিত চিন্তাধারা, তত্ত্ব, পরিকল্পনা বা কর্মসূচী কদাচিৎ কোনো পরিবর্তন ছাড়া বাস্তবে রূপায়িত হয়। এর কারণ, যারা বাস্তবকে পরিবর্তনে নিয়োজিত থাকে তারা সাধারণত বহু রকমের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকে। তারা শুধুমাত্র প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদ্যাসংক্রান্ত পরিস্থিতির দ্বারাই সীমাবদ্ধ নয়, পরন্তু বাস্তব প্রক্রিয়ার বিকাশ এবং তার প্রকাশের মাত্রার দ্বারাও সীমাবদ্ধ (বাস্তব প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক ও তার মর্ম তখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রকাশ হয়নি)। এ অবস্থায়, অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় অভাবিতপূর্ব পরিস্থিতির আবিষ্কারের ফলে চিন্তাধারা, তত্ত্ব, পরিকল্পনা বা কর্মসূচী প্রায়ই আংশিকভাবে, এবং কখনও কখনও পুরোপুরিও, পরিবর্তন করা হয়। অর্থাৎ এমনও হয় যে, মূল চিন্তাধারা, তত্ত্ব, পরিকল্পনা ও কর্মসূচীগুলো বাস্তবের সঙ্গে আংশিকভাবে বা পুরোপুরিভাবে সঙ্গতি সাধন করতে পারে না এবং সেগুলো আংশিকভাবে বা পুরোপুরিই ভুল হয়। বহু ক্ষেত্রে, বার বার ব্যর্থতার পরেই কেবল জ্ঞানের ক্ষেত্রে ভুলগুলো সংশোধন করা যায় এবং বাস্তব প্রক্রিয়ার নিয়মের সঙ্গে সঙ্গতি সাধন করা যায়, এবং ফলস্বরূপ, আত্মমুখী বস্তুকে বিষয়মুখী বস্তুতে রূপান্তরিত করতে পারা যায়, বা অন্য কথায়, অনুশীলনে প্রত্যাশিত ফল অর্জন করা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ ব্যাপার যখন ঘটে তখন বিকাশের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে একটা নির্দিষ্ট বাস্তব প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের ক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে বলে ধরা যায়।

আরো পড়ুন:  সারবস্তু ও রূপ প্রসঙ্গে

তবে, প্রক্রিয়ার ক্রমাগ্রগতির দিক থেকে বলতে গেলে, মানুষের জ্ঞানের ক্রিয়া সম্পূর্ণ হয় না। প্রকৃতির ক্ষেত্রেই হোক বা সমাজের ক্ষেত্রেই হোক, প্রত্যেক প্রক্রিয়াই তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের কারণেই অগ্রসর হয় ও বিকাশ লাভ করে এবং মানুষের জ্ঞানের ক্রিয়ারও সেই সঙ্গে অগ্রসর হওয়া ও বিকাশ লাভ করা উচিত। সামাজিক ক্রিয়াদির বেলায়, ওপরে যেমন বলা হয়েছে—সত্যিকারের বিপ্লবী নেতাদের শুধুমাত্র নিজেদের চিন্তাধারা, তত্ত্ব, পরিকল্পনা বা কর্মসূচীগুলোতে ভুল আবিষ্কৃত হলে সেগুলো সংশোধনে পারদর্শী হলেই চলবে না, উপরন্তু যখন কোনো একটি বাস্তব প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই অগ্রসর হয়ে গেছে এবং বিকাশের এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে পরিবর্তিত হয়ে গেছে—তখন সেই সঙ্গে তাদের নিজেদের ও সমস্ত সহ-বিপ্লবীদের আত্মমুখী জ্ঞানকে অগ্রসর ও পরিবর্তন করতেও পারদর্শী হতে হবে। অর্থাৎ তাদেরকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে প্রস্তাবিত নতুন বিপ্লবী কর্তব্য ও নতুন কর্মসূচীগুলো পরিস্থিতির নতুন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। বিপ্লবের সময় অতি দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন ঘটে; বিপ্লবীদের জ্ঞান যদি পরিবর্তিত অবস্থানুযায়ী দ্রুত পরিবর্তিত না হয়, তাহলে তারা বিপ্লবকে বিজয়ের দিকে পরিচালনা করতে সক্ষম হবে না।

অবশ্য, প্রায়ই দেখা যায়, চিন্তা বাস্তবের পিছনে পড়ে আছে, এর কারণ মানুষের জ্ঞান বহু রকম সামাজিক অবস্থার দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। বিপ্লবী বাহিনীর মধ্যে আমরা গোঁড়াদের বিরোধী, তাদের চিন্তা পরিবর্তনশীল বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে না এবং ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই লোকেরা এটা দেখতে পায় না যে, দ্বন্দ্বসমূহের সংগ্রাম ইতিমধ্যেই বাস্তব প্রক্রিয়াকে ঠেলে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে, আর তাদের জ্ঞান পুরোনো পর্যায়েই থেমে আছে। সব গোঁড়াপন্থীর চিন্তাধারার এটাই হচ্ছে বৈশিষ্ট্য। তাদের চিন্তাধারা সামাজিক অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা এগিয়ে গিয়ে সমাজের রথকে পথ দেখাতে পারে না; তারা শুধু পিছিয়ে পড়ে ঘ্যান ঘ্যান করে যে, রথ খুব দ্রুত যাচ্ছে এবং তাকে পিছনে টেনে রাখতে বা বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা করে।

“বাম” বাগাড়ম্বরেরও আমরা বিরোধী। “বামপন্থীদের” চিন্তাধারা বাস্তব প্রক্রিয়ার বিকাশের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়কে ছাড়িয়ে যায়; তাদের কেউ কেউ নিজেদের অলীক কল্পনাকেই সত্য বলে মনে করে, আবার কেউ কেউ যে-আদর্শ কেবল ভবিষ্যতেই বাস্তবায়িত করা সম্ভব, বর্তমানেই তার বাস্তবায়নের জন্য গলদঘর্ম হয়। এরা জনগণের অধিকাংশের বর্তমান অনুশীলন থেকে এবং বর্তমান বাস্তবতা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং কার্যকলাপে হঠকারী-হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ভাববাদ এবং যান্ত্রিক বস্তুবাদ, সুবিধাবাদ এবং হঠকারিতা—এ সবেরই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আত্মগত এবং বাস্তব অবস্থার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, অনুশীলন ও জ্ঞানের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা। বিজ্ঞানসম্মত সামাজিক অনুশীলনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী জ্ঞানতত্ত্ব এই সব ভ্রান্ত মতাদর্শের দৃঢ় বিরোধিতা না করে পারে না। মার্কসবাদীরা মনে করে যে, বিশ্বের অনাপেক্ষিক ও সাধারণ বিকাশের প্রক্রিয়ায়, প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার বিকাশ হচ্ছে আপেক্ষিক, এবং সেজন্য অনাপেক্ষিক সত্যের অন্তহীন প্রবাহের বিকাশের কোনো একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের একটা বিশেষ প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান কেবল আপেক্ষিক সত্য মাত্র। অসংখ্য আপেক্ষিক সত্যের মোট যোগফলই অনাপেক্ষিক সত্য[৮]। বাস্তব প্রক্রিয়ায় বিকাশ দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামে পরিপূর্ণ, মানুষের জ্ঞানের ক্রিয়ার বিকাশও তাই। বাস্তব জগতের সকল দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া আগে বা পরে মানুষের জ্ঞানের মধ্যে প্রতিফলিত হতে পারে। সামাজিক অনুশীলনে উদ্ভব, বিকাশ এবং বিলয়ের প্রক্রিয়া যেমন অনন্ত, তেমনি মানুষের জ্ঞানেও উদ্ভব, বিকাশ এবং বিলয়ের প্রক্রিয়া অনন্ত। মানুষের অনুশীলন—যা নির্দিষ্ট চিন্তাধারা, তত্ত্ব, পরিকল্পনা বা কর্মসূচী অনুযায়ী বস্তুগত বাস্তবতাকে পরিবর্তন করে—যতই অগ্রসর হতে থাকে, বস্তুগত বাস্তবতা সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানও ততই আনুপাতিকভাবে গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। বস্তুগত বাস্তবের জগতে যেমন পরিবর্তনের ক্রিয়ার কখনও শেষ হয় না, তেমনি অনুশীলনের মাধ্যমে সত্য সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানার্জনেরও শেষ নেই। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কোনোভাবেই সত্যকে নিঃশেষিত করেনি, বরং অনুশীলনের ধারায় সত্য সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের পথ বিরামহীনভাবে খুলে দেয়। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে আত্মগত ও বস্তুগত তত্ত্ব ও অনুশীলনের, জানা ও করার মূর্ত ও ঐতিহাসিক ঐক্য, এবং “বাম” হোক বা দক্ষিণ হোক যা মূর্ত ইতিহাস থেকে বিচ্যুত তেমন সকল ভ্রান্ত মতাদর্শের আমরা বিরোধী।

সমাজ বিকাশের বর্তমান যুগে দুনিয়াকে সঠিকভাবে জানার এবং পরিবর্তন করার দায়িত্ব ইতিহাস সর্বহারা শ্রেণি এবং তার পার্টির কাঁধে ন্যস্ত করেছে। এই প্রক্রিয়া, অর্থাৎ বিশ্বকে পরিবর্তন করার অনুশীলন যা বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান অনুযায়ী নির্ধারিত হয়েছে—ইতিমধ্যেই দুনিয়ায় এবং চীন দেশে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে পৌঁছে গেছে; এটা মানব ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব বিরাট মুহূর্ত, অর্থাৎ দুনিয়া থেকে এবং চীন থেকে অন্ধকারকে সম্পূর্ণরূপে নির্বাসিত করার এবং দুনিয়াকে একটি অভূতপূর্ব আলোকিত দুনিয়ায় পরিবর্তন করার মুহূর্ত। দুনিয়াকে পরিবর্তন করার জন্য সর্বহারা শ্রেণি ও বিপ্লবী জনগণের সংগ্রামে নিম্নলিখিত কর্তব্যগুলোর পরিপূরণ অন্তর্ভুক্ত: বস্তুগত জগতের পরিবর্তন সাধন এবং সেই সঙ্গে নিজেদের আত্মমুখী জগতের পরিবর্তন সাধন—নিজেদের জ্ঞানার্জন-ক্ষমতার পরিবর্তন সাধন এবং আত্মমুখী ও বাস্তবমুখী জগতের পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন সাধন। এই রূপ পরিবর্তন ইতিমধ্যেই পৃথিবীর এক অংশে অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নে এসে গেছে। সেখানে জনগণ পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়াটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চীনের ও বাকি দুনিয়ার জনগণ এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে বা করবে। এবং যে বাস্তবমুখী জগতের পরিবর্তন করতে হবে তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ঐ সমস্ত পরিবর্তনের বিরোধীরাও, যাদেরকে নিজেদের পরিবর্তনের জন্য স্বেচ্ছামূলক সচেতন পরিবর্তনের পর্যায়ে প্রবেশ করার আগে বাধ্যতামূলক একটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। যেদিন সমগ্র মানবজাতি স্বেচ্ছায় এবং সচেতনভাবে নিজেকে এবং জগৎকে পরিবর্তন করবে, সেদিনই শুরু হবে বিশ্ব-কমিউনিজমের যুগ।

অনুশীলনের মাধ্যমে সত্যকে আবিষ্কার করুন, এবং আবার অনুশীলনের মাধ্যমেই সত্যকে যাচাই এবং বিকশিত করুন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান থেকে শুরু করুন এবং তাকে সক্রিয়ভাবে যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানে উন্নীত করুন; তারপর যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞান থেকে শুরু করুন এবং আত্মগত ও বাস্তব এই উভয় জগৎকে পরিবর্তন করার জন্য সক্রিয়ভাবে বিপ্লবী অনুশীলন পরিচালনা করুন। অনুশীলন, জ্ঞান, আবার অনুশীলন এবং আবার জ্ঞান; এই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে অন্তহীন চক্রাবর্তে, এবং প্রত্যেকটি চক্রাবর্তের সাথে সাথে অনুশীলন ও জ্ঞানের অন্তর্বস্তুটি উচ্চতর স্তরে উত্তীর্ণ হয়। এই হলো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সমগ্র জ্ঞানতত্ত্ব, এই হলো জানা এবং করার ঐক্যের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী তত্ত্ব।[৯]

টীকা

১. হেগেলের “যুক্তিবিদ্যার বিজ্ঞান”-এর তৃতীয় খণ্ডের তৃতীয় প্রবন্ধ “ধারণা” সম্পর্কে লেনিনের নোট থেকে উদ্ধৃত; ভি. আই. লেনিন, “হেগেলের ‘যুক্তিবিদ্যার বিজ্ঞান’-এর সংক্ষিপ্ত সার” (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর, ১৯১৪) দ্রষ্টব্য।

২. কার্ল মার্কস, “ফয়েরবাক সম্পর্কে থিসিস” (বসন্তকাল, ১৮৪৫) এবং ভি. আই. লেনিন, “বস্তুবাদ এবং এমপিরিয়োক্রিটিসিজম” (১৯০৮ সালের দ্বিতীয়ার্ধে), দ্বিতীয় অধ্যায়, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

৩. হেগেলের “যুক্তিবিদ্যার বিজ্ঞান”-এর তৃতীয় খণ্ড “আত্মগত যুক্তি বা ধারণার মতবাদ” সম্পর্কে লেনিনের নোট থেকে উদ্ধৃত; ভি. আই. লেনিন, “হেগেলের ‘যুক্তিবিদ্যার বিজ্ঞান’-এর সংক্ষিপ্ত সার” দ্রষ্টব্য।

৪. হেগেলের “যুক্তিবিদ্যার বিজ্ঞান”-এর তৃতীয় খণ্ডের তৃতীয় প্রবন্ধ “ধারণা” সম্পর্কে লেনিনের নোট: “বুঝতে হলে, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বুঝতে, অধ্যয়ন করতে শুরু করতে হবে এবং অভিজ্ঞতা থেকে সর্বজনীনতায় উন্নীত হতে হবে।” “ হেগেলের ‘যুক্তিবিদ্যার বিজ্ঞান’-এর সংক্ষিপ্ত সার” দ্রষ্টব্য।

৫. ভি. আই. লেনিন, “কী করতে হবে?” (শরৎকাল, ১৯০১-ফেব্রুয়ারি, ১৯০২) প্রথম অধ্যায়, চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

৬. ভি. আই. লেনিন, “বস্তুবাদ এবং এমপিরিয়োক্রিটিসিজম”, দ্বিতীয় অধ্যায় ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

৭. জে. ভি. স্তালিন, “লেনিনবাদের ভিত্তি”, (এপ্রিল-মে, ১৯২৪) তৃতীয় অংশ “তত্ত্ব”।

৮. ভি. আই. লেনিন, “বস্তুবাদ এবং এমপিরিয়োক্রিটিসিজম, দ্বিতীয় অধ্যায়, পঞ্চম পরিচ্ছেদ। লেনিনের মূল লেখার অনুবাদ হলো: “মানবজাতির চিন্তাধারা তার নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী আমাদের জন্য আপেক্ষিক সত্যসমূহের মোট যোগফল দিয়ে গঠিত অনাপেক্ষিক সত্য যোগাতে পারে এবং আসলেও তাই যোগাচ্ছে।” “লেনিনের রচনাবলীর” দ্বিতীয় খন্ড, ১৩৪ পৃষ্ঠা, গণপ্রকাশনালয়, ১৯৭২ সালের সংস্করণ দ্রষ্টব্য।

৯. প্রবন্ধটি আবুল কাসেম ফজলুল হক অনূদিত ও সম্পাদিত মাও সেতুঙ নির্বাচিত রচনাবলী প্রথম খণ্ড, চলন্তিকা বইঘর, ঢাকা, অক্টোবর ১৯৯২, ২৯৩-৩০৪ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরে ডট কমে প্রকাশ করা হলো। প্রকাশ করার সময় কিছু বানান পরিবর্তন করা হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!