ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচিত ‘এ্যান্টি-ডুরিং’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

যে রচনাটি আমরা এই সঙ্গে প্রকাশ করছি তা আমার কোনো ‘অন্তর্বেগের’ ব্যাপার নয়। বরঞ্চ বিষয়টি এর বিপরীত।

তিন বছর আগের কথা। তিন বছর আগে হের ডুরিং যখন আচম্বিতে নিজেকে শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ এবং সমাজতন্ত্রের এক সংস্কারক হিসাবে জনসমক্ষে পেশ করলেন তখন জার্মানি থেকে সুহৃদগণ আমাকে বারবার বলতে লাগলেন, আমি যেন সোশ্যাল ডিমোক্রাটিক পার্টির তৎকালীন কেন্দ্রীয় মুখপত্র ‘ভোকসট্যাট’-এ হের ডুরিং-এর এই নব সমাজবাদীতত্ত্বের একটি সমালোচনা পেশ করি। সোশ্যাল ডিমোক্রাটিক পার্টির তখন শৈশবকাল। তায় পার্টি সম্প্রতি সংগঠনের মধ্যে একটা ঐক্য অর্জন করেছে। এ সময়ে পার্টির মধ্যে সংকীর্ণ দলগত বিভেদ এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার যেন কোনো উপলক্ষ্য উদ্ভূত হতে না পারে তার জন্য এ কাজকে তারা একেবারেই অত্যাবশ্যক বলে মনে করেছিলেন। জার্মানির অবস্থা আমার চেয়ে তারাই অধিকতর উত্তমরূপে জানতেন। কাজেই কর্তব্যবোধ থেকেই তাদের অভিমত গ্রহণ করা ছিল আমার জন্য অপরিহার্য। তাছাড়া এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে, সমাজতান্ত্রিক সংবাদপত্র মহলের একটা অংশ এই নতুন বিশ্বাসীকে তার সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে বিশেষ অনুরাগের সঙ্গেই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু নব-বিশ্বাসীর দৃশ্য সদিচ্ছার গ্রহণে সীমাবদ্ধ ছিল না। নবাগতের সদিচ্ছার সংগে তাঁর নবতত্ত্ব এবং অদৃশ্য আরো কিছুকে তাদের গ্রহণ করতে হলো। শ্রমিকদের মধ্যে তত্ত্বকে জনপ্রিয় করে প্রচার করার লোকেরও অভাব দেখা গেল না। এবং পরিশেষে এও দেখা গেল যে, হের ডুরিং এবং তার ক্ষুদ্র উপদলটি প্রচারের সকল মাধ্যম এবং কূটকৌশলকে ব্যবহার করে ‘ভোকসট্যাট’কে এই বিরাট শক্তিধর হিসাবে আবির্ভূত তত্ত্ব সম্পর্কে নির্দিষ্ট একটা ভূমিকা গ্রহণে বাধ্য করার উপক্রম করল।

তথাপি অন্যান্য কাজকে বাদ দিয়ে এই বিস্বাদ আপেলটাতে দাত লাগাব বলে মনস্থির করতে আমার একটা বছর লেগে গেল। এ এমন ধরনের আপেল যার গায়ে একবার দাঁত বসালে তাকে পুরো ভক্ষণ করা ব্যতীত কারুর উপায় থাকে না। ব্যাপারটা কষ্টকর। কারণ এটা কেবল যে বিস্বাদ, তাই নয়। আকারে এটা বিরাটও বটে। এই নব বিশ্বাসী তার নব সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বকে একটা নতুন দার্শনিক ব্যবস্থার বাস্তব পরিণাম ফল হিসাবে পেশ করেছেন। এ কারণে এ তত্ত্বকে এই দার্শনিক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত করে বিচার করা আবশ্যক হলো। এবং এ কাজ করতে গিয়ে এই দর্শনটিকেই বিশ্লেষণ করা ব্যতীত উপায় রইল না। হের ডুরিং-এর দর্শন বিরাট দর্শন। সূর্যের নিচে অবস্থিত পৃথিবীর কোনো কিছুই তিনি বাদ রাখেন নি। কাজেই তাকে অনুসরণ করে আমাকে প্রবেশ করতে হলো তাঁর সেই বিরাট রাজ্যে। ‘ভোকসট্যাট’-এর উত্তরসূরি হিসাবে ‘ভরওয়ারটস’-এ ১৮৭৭-এর গোড়া থেকে আমার যে প্রবন্ধগুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তার মূলে ছিল এই ঘটনা। সেই প্রবন্ধগুলিকেই বর্তমানে সংকলিত আকারে পেশ করা হলো।

কাজেই আমার কাজটার ধরণই এমন ছিল যাতে আমাকে হের ডুরিং-এর মূলকে অনেকখানি অতিক্রম করে যেতে হয়েছে; আলোচনার এমন দৈর্ঘ্যের আর দুটি কৈফিয়ৎ আছে। প্রথমত এই আলোচনাতে আমাকে যে বিচিত্র বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে হয়েছে তাতে আমার একটি সুযোগ ঘটেছে, যে সব প্রশ্ন বৈজ্ঞানিক সত্য এবং বাস্তব জীবনের প্রয়োজনের দিক থেকে আমাদের আলোড়িত করছে তার উপর আমার অভিমতসমূহকে নির্দিষ্টভাবে উপস্থিত করার। প্রত্যেকটি অধ্যায়তেই এটি করা হয়েছে এবং যদিও আমার এ রচনার উদ্দেশ্য হের ভুরিং-এর বিশ্বদর্শনের বিপরীতে আর একটি বিশ্বদর্শন উপস্থিত করা আদৌ নয়, তবু আশা করি যে সমস্ত মতামত আমি পেশ করেছি পাঠক তাদের মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত ঐক্যসূত্রকে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। আমার কাজটি যে একেবারে নিস্ফল হয়নি তার কিছু পরিচয় আমি ইতিমধ্যেই লাভ করেছি।

অপরদিকে সমসাময়িক জার্মানিতে ‘বিশ্বদর্শন স্রষ্টা’ হের ডুরিং কোনো বিচ্ছিন্ন একক ব্যাপার নন। কিছুকাল যাবৎ আমরা দেখছি জার্মানিতে মহাজগৎ দর্শন, প্রকৃতি দর্শন, রাজনীতি দর্শন, অর্থনীতি দর্শন ইত্যাকার নামে ডজনকে ডজন ব্যবস্থা রাতারাতি জঞ্জালের মধ্যে ছত্রাকের ন্যায় জন্ম লাভ করছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, দর্শনের একেবারে নগণ্য ডিগ্রিধারী থেকে ছাত্র পর্যন্ত কেউই এক একটা ‘বিশ্বদর্শন’-এর চেয়ে কম কিছুতে তৃপ্ত নয়। এ ঠিক আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের সমঅধিকারের ন্যায়। নাগরিকমাত্র মনে করে, রাষ্ট্রের যত বিষয়ে তার ভোটদানের অধিকার আছে তত বিষয়ের শেষ বিচারেরও তার ক্ষমতা আছে। কিংবা অর্থনীতিতে ক্রেতার বোধের ন্যায়। ক্রেতা মনে করে, যত দ্রব্যাদি সে নিজের অস্তিত্বের জন্য ক্রয় করে তার প্রত্যেকটিতে সে একজন বিশেষজ্ঞ। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এই মনোভাবই বিরাজ করছে। স্বাধীনতা বলতে মনে করা হচ্ছে, যে বিষয় যে পাঠ করেনি সে বিষয়েই তার লেখার অধিকার আছে এবং সে যা লিখছে সেটাই একমাত্র সঠিক বৈজ্ঞানিক সত্য। আজকের জার্মানির সর্বক্ষেত্রে যে বাহাদুরী-সর্বস্ব নিম-বিজ্ঞানের দৌরাত্ম চলছে তার উত্তম দৃষ্টান্ত হের ডুরিং। এ চরিত্র সব কিছুকে তার অর্থহীন শব্দের আড়ম্বরে ডুবিয়ে দিচ্ছে। কাব্য, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাসতত্ত্ব – সর্বত্রই অর্থহীন শব্দের হুঙ্কার। শ্রেণীকক্ষের বক্তৃতাতে কিংবা রাজনীতির মঞ্চে – সবখানেই অর্থহীন শব্দ। অর্থহীন শব্দের এই তত্ত্বসমূহ প্রত্যেকে নিজের জন্য অপর সকল জাতির সাধারণ অর্থহীনতার তুলনায় গভীরতায় অত্যুৎকর্ষের দাবি করে। জার্মান বুদ্ধিশিল্পের ব্যাপক উৎপাদনের সব চেয়ে বিশিষ্ট পণ্য হচ্ছে এই অর্থহীন শব্দের তত্ত্ব। এ পণ্য দামে অবশ্যই সস্তা, কিন্তু মানে খাটো। আর সকল জার্মান পণ্যের মতোই এর চরিত্র। দুঃখের বিষয় ফিলাডেলফিয়ার শিল্প প্রদর্শনীতে জার্মানির উৎপাদিত অপর সকল পণ্য প্রদর্শিত হলেও তার বুদ্ধিশিল্পের এই দ্রব্যটি প্রদর্শিত হয়নি।[১] হের ডুরিং-এর এই মহৎ দৃষ্টান্তের পরে জার্মান সমাজতন্ত্রেও সম্প্রতি এই অর্থহীন তত্ত্বের ঢেউ লেগেছে এবং এর ফলশ্রুতিতে এমন সব চরিত্রের উদ্ভব ঘটেছে যারা বিজ্ঞানের একটি কথাকেও না জেনে নিজেদের বৈজ্ঞানিক বলে দাবি করতে আদৌ কুষ্ঠিত হচ্ছে না। এটাকে আমরা বলতে পারি এক বালসুলভ রোগ বিশেষ। এ রোগ সোশ্যাল ডিমোক্রাসির সঙ্গে জার্মান তরুণদের সদ্যপরিচয়ের লক্ষণ যেমন, তেমনি তা থেকে এ অবিচ্ছেদ্যও বটে। জার্মান শ্রমিক শ্রেণী তাদের উল্লেখযোগ্য সুস্থ চরিত্র দ্বারা নিঃসন্দেহে এ রোগকে যে পরাভূত করতে সক্ষম হবেন, সে বিশ্বাস আমার আছে।

হের ডুরিংকে অনুসরণ করে আমাকে যে এমন রাজ্যে প্রবেশ করতে হয়েছে যে-রাজ্যে আমি নিজেকে শিক্ষানবিশের অধিক বলে দাবি করতে পারিনে, সে অপরাধ আমার নয়। এসব ক্ষেত্রে আমি আমার প্রতিপক্ষের ভিত্তিহীন কিংবা বিকৃত দাবির বিপরীতে সঠিক এবং তর্কাতীত তথ্যকে উপস্থিত করার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছি। আইনতত্ত্ব এবং কয়েকটি বিষয়ে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমনটি আমাকে করতে হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তত্ত্বগত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ব্যাপারে কিছু সাধারণ অভিমত ব্যক্ত করেছি। এমন ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে যারা অধিগত তাদেরও নিজেদের ক্ষেত্রকে অতিক্রম করে পাশ্ববর্তী এলাকাতে পদচারণা করতে হয়। আর এ পদচারণায় কোনো বিশেষজ্ঞই আমাদের মতো অপর দশজনার ন্যায় শিক্ষানবিশ ব্যতীত অধিক কিছু দাবি করতে পারেন না। হের ভারচাও এই অভিমতটিই প্রকাশ করেছেন। তাই এ ক্ষেত্রে আমার প্রকাশে যদি কিছু বেঠিকতা বা অপরিচ্ছন্নতা ঘটে থাকে তবে তাকে আমি ক্ষমার্হ বলে মনে করব।

আমার এই মুখবন্ধটি সমাপ্ত করার মুহূর্তে আমি জনৈক প্রকাশকের একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পেলাম। তাতে ‘যৌক্তিক পদার্থবিদ্যা এবং রসায়ন শাস্ত্রের নতুন মৌলিক বিধানাবলী’ শিরোনামে হের ডুরিং-এর একটি নতুন ‘প্রামাণ্য’ গ্রন্থের প্রকাশনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পদার্থবিদ্যা এবং রসায়ন শাস্ত্রে আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সত্তেও আমার বিশ্বাস আমার ডুরিং সাহেবকে জানি এবং তাঁর এই নবসৃষ্টির সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় ব্যতিরেকেই আমি আগাম এ কথা বলতে পারি, এই সৃষ্টিতে ঘোষিত পদার্থ এবং রসায়নের নব বিধানগুলি তাদের সামান্যতা এবং বেঠিকতা অর্থনীতি আর বিশ্ব ব্যবস্থা প্রভৃতির ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে হের ডুরিং-আবিষ্কৃত অপর বিধানাবলীর একই কাতারভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখবে। আমার বর্তমান গ্রন্থে হের ডুরিং-এর ইতিপূর্বকার আবিষ্কারগুলিরই আলোচনা করা হয়েছে। আর একটি কথাও বলা যায়। হের ডুরিং ‘রিগেমিটার’ নামে একটি মাপ-যন্ত্র তৈরি করেছেন একেবারে নিম্ন তাপকে পরিমাপের জন্য। এ মাপ-যন্ত্রটি নিরর্থক নয়। এ মাপ-যন্ত্র উচ্চ এবং নিম্ন তাপ পরিমাপে সক্ষম না হোক, এ যে হের ডুরিং-এর নিজের অজ্ঞ ঔদ্ধত্যের পরিমাপক হিসাবে কাজ করতে সক্ষম হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

লন্ডন ১১ জুন, ১৮৭৮[২]

টিকা:

১. ১৮৭৬ সালে ফিলাডেলফিয়াতে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক শিল্পমেলা অনুষ্ঠিত হয়। জার্মানি উক্ত শিল্প মেলায় অংশ গ্রহণ করেছিল। — অনুবাদক
২. সরদার ফজলুল করিম অনূদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ, অক্টোবর ১৯৯৭, এঙ্গেলস-এর এ্যান্টি-ডুরিং গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৪-৬ থেকে নেয়া হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!