আরব অঞ্চলের ধারাবাহিক স্থবিরতা সম্পর্কে মহামতি ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের টিকা

ইসলাম ধর্মের প্রাধান্যকারী অঞ্চলের, প্রধানত আরব অঞ্চলের ধারাবাহিক স্থবিরতা (ইংরেজি: Continuous stagnation of Islamic society) সম্পর্কে মহামতি ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস (২৮ নভেম্বর, ১৮২০ – ৫ আগস্ট ১৮৯৫) অতি ক্ষুদ্র একটি মন্তব্য করেছেন। তাঁর সেই মন্তব্যটি আছে ‘গোড়ার খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধটিতে যা আমাদেরকে এক দার্শনিকসুলভ বিশ্লেষণ দেয়।

ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তার ‘গোড়ার খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধটি শুরু করেছেন সেই ধর্মের সংগে সমাজতন্ত্রের সাদৃশ্যের বা মিলের দিকটি উল্লেখ করে। তিনি লিখেছেন যে গোড়ার দিকের খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসের বিভিন্ন লক্ষণীয় উপাদানের সাথে আধুনিক শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের উপাদানগুলো প্রায় একই। আধুনিক শ্রমিকশ্রেণির মতে খ্রিস্টধর্ম গোড়ায় ছিলো উৎপীড়িত মানুষের একটা আন্দোলন। দাস আর মুক্তি পাওয়া দাস, সর্ব অধিকারবঞ্চিত গরিব মানুষ, রোম কর্তৃক পদানত কিংবা ছত্রভঙ্গ জাতিগুলির ধর্ম হিসেবে গোড়ায় খ্রিস্টধর্ম দেখা দিয়েছিল। এঙ্গেলস লিখেছেন,

“খ্রিস্টধর্ম এবং শ্রমিকদের সমাজতন্ত্র উভয়েই প্রচার করে দাসত্ববন্ধন আর দুর্দশা থেকে আগামি মুক্তির কথা; খ্রিস্টধর্ম এই মুক্তিকে দেখায় পরলোকের জীবনে, মৃত্যুর পরে, স্বর্গে; সমাজতন্ত্র এটাকে দেখায় ইহলোকে, সমাজের রূপান্তরের মধ্যে।”

এঙ্গেলস আরো মন্তব্য করেছেন যে ‘খ্রিস্টধর্ম এবং শ্রমিকদের সমাজতন্ত্র’ দুইই নির্যাতিত ও নিগৃহীত; এই দুইটির অনুগামীরাই অবজ্ঞার পাত্র। এবং রাষ্ট্রের ও সমাজব্যবস্থার এবং ধর্মের, পরিবারের বা মানবজাতির শত্রু হিসেবে যতই এই দুটিকে অভিযুক্ত করা হোক না কেন; যাবতীয় নির্যাতন সত্ত্বেও দুইই জয়যুক্ত হয়ে, দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে চলে। খ্রিস্টধর্ম দেখা দেবার তিনশ বছর পরে সেটা হয়েছিল রোম বিশ্ব সাম্রাজ্যের স্বীকৃত রাষ্ট্রধর্ম, আর মোটে ষাট বছরে সমাজতন্ত্র জিতে নিয়েছে এমন অবস্থান যাতে এর বিজয় একেবারেই নিশ্চিত হয়ে গেছে।

এরপর এঙ্গেলস মধ্যযুগের কৃষক বিদ্রোহগুলো সম্পর্কে বলছেন যে, মধ্যযুগের উৎপীড়িত কৃষকদের এবং বিশেষত শহুরে প্লেবিয়ানদের প্রথম বিদ্রোহগুলি যে ধর্মীয় মুখোস পরেছিল তা ছিল অনিবার্য এবং সেটাকে মনে হয়েছিল বিস্তৃততর হতে থাকা অধঃপতন থেকে গোড়ার দিককার খ্রিস্টধর্মের পুনস্থাপনা বলে।

আরো পড়ুন:  একেশ্বরবাদের হচ্ছে সর্বশক্তিমান, সর্ব-বিষয়ে হস্তক্ষেপকারী স্রষ্টা একমাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস

এরপর এঙ্গেলস টিকা আকারে মুসলিম দুনিয়ায়, বিশেষত আফ্রিকার ধর্মীয় অভ্যুত্থানগুলি সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, সেটিকে বিবেচনা করা যেতে পারে এক দার্শনিকের সত্যদৃষ্টি সম্পর্কে। বিশ এবং একুশ শতকেও ইসলামি দেশগুলোর শাসকশ্রেণি এবং ইসলামপন্থি দলগুলি যে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের এবং মুনাফা আর পুঁজির সাথে মিলেমিশে গরিব জনগণকে শোষণে অতীতের ন্যায় ব্যস্ত আছে তার উৎসমুখ সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যাবে এঙ্গেলসের সেই টিকা এবং মন্তব্যে। তিনি লিখেছেন,

“ইসলাম এমন ধর্ম যা মানানসই প্রাচ্যবাসীদের পক্ষে, বিশেষত আরবদের পক্ষে। অর্থাৎ একদিকে বাণিজ্যে আর শিল্পে ব্যাপৃত শহরবাসী এবং অন্যদিকে যাযাবর বেদুইনদের পক্ষে। তবে সেখানে রয়েছে মাঝে মাঝে সংঘটিত সংঘর্ষের বীজ। শহরবাসীরা হয়ে ওঠে ধনী, বিলাসী, ‘বিধিবিধান’ মেনে চলায় তাদের ঢিলেমি আসে। বেদুইনরা গরিব, তাই তারা নৈতিক চরিত্রে ঢিলেমি বরদাস্ত করে না, তারা ওইসব বিত্তসম্পদ আর ভোগসুখ সম্বন্ধে ভাবে ঈর্ষা আর লোলুপতার সংগে। তখন কাফেরদের শাস্তি দেবার জন্য, আচারপালন আর সাচ্চা ধর্মবিশ্বাস পুনঃস্থাপনের জন্য এবং খেসারত হিসেবে কাফেরদের ধন-দৌলত জব্দ করার জন্যে তারা মিলিত হয় একজন পয়গম্বর, একজন মাহদি’র অধীনে। স্বভাবতই, একশ বছরের মধ্যে তারা এসে যায় সেই অবস্থায় যেখানে ছিল কাফেররা: ধর্মমতের নতুন বিশোধন আবশ্যক হয়ে পড়ে, দেখা দেয় এক নতুন মাহদি, আর ব্যাপারটা আবার শুরু হয় গোড়া থেকে। স্পেনে আফ্রিকার আলেমোরাভিদ আর আলমোহাদদের দেশজয় অভিযান থেকে ইংরেজদের সাফল্যের সংগে শায়েস্তাকারী খার্তুমের মাহদি অবধি তাই ঘটেছিলো। পারস্য এবং অন্যান্য মুসলিম দেশে অভ্যুত্থানগুলির বেলায়ও ব্যাপারটা ঘটেছিল একই কিংবা অনুরূপ ধরনে। এই সমস্ত আন্দোলনের ছিলো ধর্মীয় ভেক। কিন্তু সেগুলির উৎস হলো আর্থনীতিক কারণ; অথচ সেগুলি জয়যুক্ত হবার পরেও তারা পুরনো আর্থনীতিক পরিবেশটাকে চলতে দেয় অক্ষত অবস্থায়। এইভাবে পুরনো পরিস্থিতি থেকে যায় অপরিবর্তিত, আর সংঘর্ষ ঘটতে থাকে মাঝে মাঝে। তার বিপরীতে, খ্রিস্টানি পশ্চিমে জন অভ্যুত্থানগুলিতে ধর্মীয় ছদ্মবেশটা হলো অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে এমন আর্থনীতিক ব্যবস্থার উপর আক্রমণের একটা ধ্বজা আর মুখোশ মাত্র। ঐ আর্থনীতিক ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করা হয় শেষ পর্যন্ত, দেখা দেয় নতুন ব্যবস্থা, সমাজ এগিয়ে চলে।”

আর এইখানেই জড়িয়ে আছে আরব ও আফ্রিকার ইসলামি অভ্যুত্থানগুলির সমাজপরিবর্তনে ভূমিকা না রাখার কারণ। ইসলামি অভ্যুত্থানগুলিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটির উপর আক্রমণ করা হয় না। ফলে ইসলামি শাসকগোষ্ঠী অতীতের ন্যায় আজো পুঁজি, মুনাফা, শোষণ, সাম্রাজ্যবাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র। আর মুসলমান গরিব জনগণ তাদের শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুরোনো বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।

আরো পড়ুন:  পোপতন্ত্র কাকে বলে?

তথ্যসূত্র:

১. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, গোড়ার খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস প্রসঙ্গে, ধর্ম প্রসঙ্গে, কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিঃ, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০০৪ পৃষ্ঠা ২৩৯।

রচনাকাল ২৮ জুন ২০১৪

1 thought on “আরব অঞ্চলের ধারাবাহিক স্থবিরতা সম্পর্কে মহামতি ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের টিকা”

Leave a Comment

error: Content is protected !!