পরিবারের ধারণা প্রাচীন। আমরা পরিবারে বড় হয়ে উঠি এবং আমরা সবাই পরিবারের কথা ভালোভাবেই জানি। পরিবারের ধারণা অত্যন্ত সরল। স্বামী-স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একত্রে গৃহে বসবাস করাই পরিবার। এটি একটি অর্থনৈতিক একক এবং ছেলে-মেয়েদের স্নেহ-মমতা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করে। আপাতদৃষ্টিতে সরল মনে হলেও, পরিবার সামাজিক জটিল প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান এবং একে সংজ্ঞায়িত করা সহজসাধ্য নয়। এর অন্যতম কারণ হলো সময় ও স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারের ধরনের বৈচিত্র্যময় পরিবর্তন। পাশ্চাত্যদেশগুলোর পরিবারে সাম্প্রতিক পরিবর্তন এ সমস্যাটিকে ক্রমশ জটিলতর করে তুলছে।
পরিবারের সনাতন সংজ্ঞা
পরিবার শব্দটি কোথা থেকে এসেছে? ইউরোপীয় ধারণাটিই হচ্ছে সাম্প্রতিক। ল্যাটিন শব্দ ‘Famulus’ এর অর্থ হচ্ছে চাকর । প্রাচীন রোমানরা ‘Famila’ শব্দটি ব্যবহার করতো দাসসহ গৃহ-সম্পত্তি বোঝাতে। প্রাচীন গ্রীক শব্দ ‘Oikos’ এর অর্থ পরিবারকে নির্দেশ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি সম্পত্তিকে বোঝায়। ইউরোপে অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত পরিবার শব্দটি ব্যবহার হলে তা বোঝাত অভিজাত বংশ বা গৃহস্থালীকে।
পরিবারের সনাতন সংজ্ঞা প্রদান করেছিলেন পিটার মার্ডক Murdock. তাঁর মতে,
‘পরিবার হচ্ছে একটি সামাজিক গোষ্ঠী যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাধারণ আবাসস্থল, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং প্রজনন। এর অন্তর্গত থাকে বিপরীত লিঙ্গের প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি অন্তত: যাদের দু’জন সামাজিকভাবে স্বীকৃত যৌন-সম্পর্ক বজায় রাখে এবং যৌনসম্পর্কযুক্ত নারী-পুরুষের নিজস্ব বা দত্তক নেওয়া এক বা একাধিক সন্তান থাকে।’
পরিবারের সাম্প্রতিক সংজ্ঞ
কলিনস এর সমাজবিজ্ঞানের অভিধান অনুসারে পরিবার বলতে বোঝায়,
“আত্মীয়তার সম্পর্কে বা একই ধরনের ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ একটি জনসমষ্টিকে যেখানে প্রাপ্ত বয়স্করা তাদের নিজেদের ও পোষ্য ছেলে-মেয়েদের লালন-পালন করে থাকে।”
পিটার মার্ডক Peter Murdock ২৫০ টি সমাজের উপাত্ত থেকে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন পরিবার একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান। একেবারে আদিম সমাজ থেকে প্রতিটি সমাজে পরিবারের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। তবে পরিবার বলতে তিনি বুঝিয়েছেন অনুপরিবার। কেননা অনুপরিবার থেকে পরিবারের অন্য রূপ তৈরি হয়েছে।
মার্ডকের দু’টি বক্তব্যই যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি করেছে। বিশেষ করে তাঁর দেওয়া পরিবারের সংজ্ঞা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। দু’টি উদাহরণের সাহায্যে পরিবারের সংজ্ঞা প্রদানের সমস্যাকে তুলে ধরা যায়।
নৃবিজ্ঞানী ক্যাথলিন গাফ Kathleen Gough [দক্ষিণ ভারতের] কেরালার নায়ারদের পরিবার প্রথার যে বিবরণ তুলে ধরেছেন তা পরিবারের সরল ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই নায়ার মেয়েদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়ে যেত। বিয়ের পর স্বামীর সাথে স্ত্রীর কোনো যোগাযোগ থাকত না। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর একমাত্র কর্তব্য ছিল তাঁর শ্রাদ্ধে অংশগ্রহণ করা। যৌবন-প্রাপ্তির পর নায়ার নারীরা সাময়িক স্বামী গ্রহণ করতে পারত যা স্থায়ী হত সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত। নায়ার পরিবার ছিল মাতৃসূত্রীয়। এক্ষেত্রে বিয়ে পরিবার গঠনে কোনো ভূমিকা রাখত না। গৃহস্থালী ভাই-বোন এবং বোনদের কন্যাদের নিয়ে গড়ে উঠত। স্বামীদের সন্তানের প্রতি কোনো কর্তব্য ছিল না। এ সম্পর্ক যে কেউ যেকোনো সময়ে ভেঙ্গে দিতে পারত। এটি স্থায়ী কোনো সম্পর্ক ছিল না। স্বামী-স্ত্রী কোনো অর্থনৈতিক একক তৈরী করত না।
মার্ডকের সংজ্ঞায় পরিবার অন্তত একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ নিয়ে গঠিত। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ, মধ্য-আমেরিকা, গায়ানা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক কালো পরিবারে গড়ে উঠে একজন নারী ও তার সন্তানদের নিয়ে এবং অনেক সময়ে তার মাকে নিয়ে। এ ধরনের পরিবারকে বলা হয় মাতৃ-কেন্দ্রিক পরিবার Matrifocal Family। পরিবার সর্বজনীন কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। মার্ডকের মতের পক্ষে যুক্তিগুলো নিচে তুলে ধরা হল।
১. নারীপ্রধান পরিবার সংখ্যাগত দিক থেকে কোনো সমাজেই খুব বেশি নয়। কোথাও এটি পরিবারের আদর্শ রূপ নয়।
২. নারী-কেন্দ্রিক পরিবার সাধারণত ভগ্ন অনু পরিবার। অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদ বা বিচ্ছেদের কারণে নারী-কেন্দ্রিক পরিবার তৈরী হয়।
৩. অনুপরিবার কৃষ্ণবর্ণদের মধ্যেও আদর্শ হিসাবে পরিগণিত।
৪. নারী-প্রধান পরিবার সামাজিক বিশৃংখলতাজনিত কারণে সৃষ্ট এবং এটি অনু পরিবারের বিকল্প নয়। মার্ডকের বিপক্ষের যুক্তিগুলো কম শক্তিশালী নয় ?
৫. নায়ারদের পরিবারকে যদি পরিবার না ধরা হয় তবে পরিবার যে সর্বজনীন তা বলা যাবে না। অন্যদিকে এটি যদি পরিবার হয় তবে অনুপরিবার যে সর্বজনীন তা বলা যাবে না।
৬. বহুবিবাহ পরিবার কোনো সমাজে খুব ব্যাপক নয়, এটি যদি পরিবারের একটি রূপ হিসাবে গৃহীত হয়, তবে নারী প্রধান পরিবারকে পরিবারের একটি স্বতন্ত্র রূপ হিসাবে চিহ্নিত না করার কোন কারণ নেই।
৭. কৃষ্ণবর্ণদের মধ্যে নারী-প্রধান বা নারী-কেন্দ্রিক পরিবার পরিবারের একটি রূপ হিসাবে গৃহীত হয়েছে। পরিবারের সদস্যরাও মনে করে এটি পরিবারের একটি রূপ।
৮. নারী-কেন্দ্রিক পরিবারকে ভগ্ন অনুপরিবার হিসাবে দেখা উচিৎ নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজে গবেষণা থেকে দেখা যায় নারী-কেন্দ্রিক পরিবার খুব সুগঠিত একটি সামাজিক গোষ্ঠী যা দারিদ্র্যের পরিসরে গড়ে উঠে। দারিদ্র্যের সাথে অভিযোজনার জন্য এই ধরনের পরিবার সবচেয়ে উপযোগী। একজন পুরষের উপর নির্ভর না করে, এটি নির্ভর করে আত্মীয় এবং একাধিক পুরুষের উপর যা পরিবারটিকে প্রয়োজনীয় সম্পদ সংগ্রহ করার সুযোগ দেয়।
৯. নারী-কেন্দ্রিক পরিবারে পুরুষ প্রধানের অভাবে সন্তানদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১০. উত্তর-আধুনিকতা ও নারীবাদী আন্দোলন থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মানব সমাজের কোনো প্রতিষ্ঠানকে সর্বজনীন বলা কঠিন।
স্থান এবং কালের ভেদে প্রতিষ্ঠানের নানা বৈচিত্র্য রয়েছে। কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন অধিকাংশ সমাজবিজ্ঞানী সমাজে সদস্য হিসাবে এর প্রবল ভাবাদর্শকে প্রতিফলিত করেন। পরিবার বা অনুপরিবার মধ্য শ্রেণীর আদর্শ প্রতিষ্ঠান। এর প্রতি তাদের থাকে গভীর অনুরাগ যা তাদের সমাজ চিন্তায় প্রতিফলিত হয়। যে কোনো অবস্থায় পরিবারকে তারা সমর্থন করে যান।তাদের গবেষণা বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করেনা, প্রতিফলিত করে তাদের ভাবাদর্শকে।
সাধারণভাবে পরিবার বলতে যা বোঝায় তা ধারণাটি অত্যন্ত সরল। স্বামী-স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে একত্রে গৃহে বসবাস করাই হচ্ছে পরিবার। এটি একটি অর্থনৈতিক একক যা সামাজিক জটিল প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমাজবিজ্ঞানে পরিবারের ধারণা কিছুটা ভিন্ন। তবে সময় ও স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারের ধরনের বৈচিত্র্যময় পরিবর্তনের কারণে একে সংজ্ঞায়িত করা সহজসাধ্য নয়।
পরিবারের সনাতন সংজ্ঞায় মার্ডক পরিবার বলতে বুঝিয়েছেন এমন একটি সামাজিক গোষ্ঠী যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাধারণ আবাসস্থল, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং প্রজনন। তিনি মনে করেন পরিবারের মধ্যে থাকে বিপরীত লিঙ্গের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি অন্তত: যাদের দু’জন সামাজিকভাবে স্বীকৃত যৌন সম্পর্ক বজায় রাখে এবং যৌন সম্পর্কযুক্ত নারীপুরুষের নিজস্ব বা দত্তক নেওয়া এক বা একাধিক সন্তান থাকে।
পরিবারের সাম্প্রতিক সংজ্ঞায় পরিবার হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক বা একই ধরনের ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ একটি জনসমষ্টি যেখানে প্রাপ্তবয়স্করা তাদের নিজেদের ও পোষ্য ছেলেমেয়েদের লালন পালন করে থাকে।
পিটার মার্ডক তাঁর গবেষণায় পরিবারকে দেখিয়েছেন একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে । তাঁর মতে আদিমকাল থেকে প্রতিটি সমাজেই পরিবার লক্ষ্যণীয়। তিনি পরিবার বলতে বুঝিয়েছেন অনুপরিবারকে, কেননা এটি থেকেই পরিবারের অন্য রূপ তৈরি হয়েছে। তবে মার্ডকের দু’টি বক্তব্যই যথেষ্ট বিতর্কের সূচনা করেছে।
নৃবিজ্ঞানী কাথলিন গাফ দক্ষিণ ভারতের কেরালার নায়ারদের পরিবার প্রথার যে উদাহরণ তুলে ধরেছেন তা পরিবারের সংজ্ঞা প্রদানের সমস্যাকে স্পষ্টতই তুলে ধরে। পরিবার সর্বজনীন কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। মার্ডক এ মতের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করলেও, উত্তর-আধুনিকতা ও নারীবাদী আন্দোলন থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মানব সমাজের কোন প্রতিষ্ঠানকে সর্বজনীন বলা কঠিন।
[বি. দ্র: নিবন্ধে ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া। আলোকচিত্রীর নাম: Demmarcos ]
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।