নিজনি-নভগরোড গুবের্নিয়ার কানাভিনোর সংবাদদাতার একটি প্রতিবেদন ১৪ এপ্রিলে আমাদের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, ওই প্রতিবেদনে এই মর্মে খবর বেরিয়েছে যে “ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বেতন পরিশোধ করা হবে শ্রমিকদের এমন একটি মিলিশিয়া বাস্তবে সেখানকার সমস্ত ফ্যাক্টরিতে চালু হয়েছে”।
আমাদের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, কানাভিনো জেলায় ষোলটি ফ্যাক্টরি আছে এবং প্রায় ত্রিশ হাজার শ্রমিক সেখানে কাজ করেন, রেলওয়ে কর্মচারিদের এই হিসেবের মধ্যে ধরা হয়নি। শ্রমিকদের দিয়ে গঠিত মিলিশিয়া সংগঠনের বেতন পুঁজিপতিরা পরিশোধ করবেন বিধায় ওই এলাকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠানগুলি এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
শ্রমিকদের মিলিশিয়ায় সংগঠিত করার ব্যয় পুঁজিপতিদের দ্বারা পরিশোধিত হবে, এটা এমন একটি পদক্ষেপ যার প্রচণ্ড গুরুত্ব রয়েছে—এটা অতিশয়োক্তি করা হবে না যে, এটা একটি বিশাল এবং চূড়ান্ত পদক্ষেপ, বাস্তবসম্মত ও নীতিগত উভয় দিক থেকে। বিপ্লব নিরাপদ হতে পারে না, এর অর্জন নিশ্চিত হতে পারে না, এর আরও বিকাশ অসম্ভব, যতক্ষণ এই ধরনের পদক্ষেপ সাধারণ না হচ্ছে, যতক্ষণ সারা দেশে এটা সম্পন্ন করা না হচ্ছে।
বুর্জোয়া ও জমিদার প্রজাতন্ত্রীরা, যারা জনগণকে শাসন করা অসম্ভব দেখার পর কোনো পথ না পেয়ে গতিপথ পরিবর্তন করে প্রজাতন্ত্রী হয়েছেন, তারা এমন একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন যেটা যতদূর সম্ভব রাজতান্ত্রিক হবে; ফ্রান্সে যেমনটা আছে তার মতো একটা কিছু, সেড্রিন যাকে বলেছেন প্রজাতন্ত্রী ছাড়া প্রজাতন্ত্র ।
বর্তমান সময়ে জমিদার ও পুঁজিপতিরা যখন বিপ্লবী জনগণের শক্তি অনুধাবন করেছেন, তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পুরনো জমানার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সুরক্ষা দেওয়া, অত্যাচারের পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলি রক্ষা করা: পুলিশ, আমলাতন্ত্র এবং স্থায়ী সেনাবাহিনী। তারা “বেসামরিক মিলিশিয়া” বাহিনীকে ছোট করে পুরনো ধরনের প্রতিষ্ঠানের পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন, অর্থাৎ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র জনশক্তির একটি স্থায়ী ছোট বাহিনী এবং যতটা সম্ভব বুর্জোয়াদের ঘনিষ্ঠ এবং বুর্জোয়াদের মধ্যেকার তাদের থেকে আসা মানুষদের নিয়ন্ত্রাধীন।
সোশ্যাল-ডেমোক্রাটদের সর্বনিম্ন কর্মসূচিতে স্থায়ী সেনাবাহিনীকে জনগণের সর্বজনীন সশস্ত্রকরণ দ্বারা প্রতিস্থাপনের দাবি করা হয়েছে। ইউরোপের অধিকাংশ সরকারি সোশ্যাল-ডেমোক্রাটরা এবং আমাদের নিজেদের মেনশেভিক অধিকাংশ নেতারা, যাই হোক, পার্টি কর্মসূচি “ভুলে গেছেন” অথবা তাকে একপাশে সরিয়ে রেখেছেন, আন্তর্জাতিকতাবাদের জায়গায় উগ্র জাতীয়তাবাদ (“প্রতিরক্ষাবাদ”), বিপ্লবী রণকৌশলের জায়গায় সংস্কারবাদ ধরেছেন।
এখনও এবং সব সময়ে, বর্তমান বিপ্লবী মুহূর্তে, জনগণের সর্বজনীন সশস্ত্রকরণের কাজ সবচেয়ে জরুরি এবং অত্যাবশ্যক। এটার ওপর জোর দেওয়া যে, যখন আমাদের একটি বিপ্লবী সেনাবাহিনী আছে, তখন প্রলেতারিয়েতের সশস্ত্রকরণের কোনো প্রইয়োজন নেই, অথবা সবাইকে দেবার মতো “যথেষ্ট” অস্ত্র আমাদের থাকতে হবে, এসব কথা স্রেফ প্রতারণা ও চালাকি। কাজটা এখনই একটি সর্বজনীন মিলিশিয়া গঠন দিয়ে শুরু করতে হবে, যাতে করে প্রত্যেকে অস্ত্রের ব্যবহার শিখতে পারে এমনকি যদিও সবাইকে দেওয়ার মতো অস্ত্র “যথেষ্ট নয়”, কেননা এটা আদৌ আবশ্যক নয় যে প্রত্যেককে সশস্ত্র করার জন্য জনগণের কাছে যথেষ্ট অস্ত্র থাকতে হবে। জনগণকে শিখতে হবে, একজন থেকে সবাইকে, কীভাবে অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়, তাদের একজন থেকে সবাইকে মিলিশিয়ায় থাকতে হবে যে মিলিশিয়া পুলিশ এবং স্থায়ী সেনাবাহিনীকে প্রতিস্থাপন করবে।
শ্রমিকশ্রেণি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী চায় না; তারা যেটা চায় তা হলো সমগ্র জনগণ নিয়ে গঠিত একটি একক মিলিশিয়া যার মধ্যে শ্রমিক ও সৈনিকরা একীভূত হবে।
এটা করতে ব্যর্থ হলে, নির্যাতনের হাতিয়ারগুলি বলবৎ থেকে যাবে, আজ যারা গুচকোভ এবং তার বন্ধুদের, প্রতি-বিপ্লবী জেনারেলদের সেবা করতে প্রস্তুত, আগামীকাল ডিমিট্রিভকে অথবা সিংহাসনের দাবিদারকে এবং গণভোটের রাজতন্ত্রের ঠিকাদারকে।
পুঁজিপতিদের এখন দরকার একটি প্রজাতন্ত্র, কারণ অন্যথায় তারা জনগণকে “সামাল দিতে” পারছে না। কিন্তু তাদের দরকার একটি “সংসদীয়” প্রজাতন্ত্র, অর্থাৎ এমন একটি প্রজাতন্ত্র যেখানে গণতন্ত্র নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, ওইসব ব্যক্তিদের সংসদে পাঠানোর অধিকার পর্যন্ত, যেমনটা মার্কস যথাযোগ্যভাবে মন্তব্য করেছেন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে এবং জনগণকে নিপীড়ন করে।
সমকালীন সোশ্যাল-ডেমোক্রাটদের সুবিধাবাদীরা, যারা মার্কসের জায়গায় সেইডম্যানকে বসিয়েছেন, তারা মুখস্থ রেখেছেন যে সংসদীয় ব্যবস্থাকে “কাজে লাগাতে হবে” (এটা পুরোপুরিই সঠিক), বুর্জোয়া সংসদবাদ থেকে প্রলেতারীয় গণতন্ত্রকে পার্থক্য করে এটা সম্পর্কে যা শিখিয়েছেন সেটা ভুলে গেছেন।
সাধারণ মানুষকে গণতন্ত্রের পদ্ধতি শেখানোর জন্য জনগণের একটি প্রজাতন্ত্র প্রয়োজন। আমাদের গণতান্ত্রিক লাইন বরাবর শুধুমাত্র প্রতিনিধিত্বের দরকার নেই, বরং আমরা জনগণের নিজেদের দ্বারা নিচ থেকে সমগ্র রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণ চাই, প্রশাসনে তাদের সক্রিয় ভূমিকা চাই। জনগণের সর্বজনীন অস্ত্র সজ্জিতকরণ দিয়ে, একটি প্রকৃত সর্বজনীন মিলিশিয়া দিয়ে পুলিশ, আমলাতন্ত্র ও স্থায়ী সেনাবাহিনী শোষণের পুরনো এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিস্থাপন করতে হবে, রাজতন্ত্র পুনর্বহালের বিরুদ্ধে দেশে একটি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এটাই একমাত্র পথ এবং এর ফলে সমাজতন্ত্রের দিকে দৃঢ়তার সঙ্গে, সুশৃঙ্খলভাবে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, উপর থেকে এটি চালু না করে, বরং রাষ্ট্র পরিচালনার কলাকৌশল শিখতে, সমগ্র রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করা শিখতে প্রলেতারিয়েতের ব্যাপক অংশকে জাগরিত করে।
জনগণের উপরে দাঁড়ানো পুলিশের মাধ্যমে, আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে যে আমলাতন্ত্র বুর্জোয়াদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত চাকর, এবং জমিদার ও পুঁজিপতিদের আদেশের অধীন স্থায়ী সেনাবাহিনীর মাধ্যমে জনগণের সেবা দেওয়া—এই হলো বুর্জোয়া সংসদীয় প্রজাতন্ত্রের আদর্শ, এরাই পুঁজির শাসন চিরস্থায়ী করে এদের দিন শেষ।
পুরুষ ও নারীদের নিয়ে গঠিত একটি সর্বজনীন জনগণের মিলিশিয়ার মাধ্যমে, একটি মিলিশিয়া যারা আমলাতন্ত্রের আংশিক প্রতিস্থাপনে সক্ষম—এই বাহিনী, নির্বাচিত সমস্ত সরকারি কর্মকর্তারা যারা প্রত্যাহারযোগ্য, প্রভুর মতো বেতন নয়, বুর্জোয়া মানদণ্ডে নয় বরং প্রলেতারিয়েতের মজুরি অনুযায়ী যাদের কাজের বেতন এই মূলনীতির সঙ্গে সমন্বিত করে জনগণের সেবা দেওয়া—এটাই হলো শ্রমিকশ্রেণীর আদর্শ।
এই আদর্শ আমাদের কর্মসূচির শুধুমাত্র একটি অংশই হয়নি, পশ্চিমের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এটি শুধুমাত্র একটা স্থান জয় করেনি, দৃষ্টান্তস্বরূপ, প্যারিস কমিউনের অভিজ্ঞতা; মার্কস কর্তৃক একে শুধুমাত্র মূল্যায়ন করা, জোর দেওয়া, ব্যাখ্যা করা এবং অনুমোদন করা হয়নি, বরং ১৯০৫ এবং ১৯১৭ বর্ষগুলিতে রুশ শ্রমিকদের দ্বারা বাস্তবিকই একে অনুশীলন করা হয়েছে।
শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলি, গুরুত্বের দিক থেকে, যে ধরনের সরকার তারা সৃষ্টি করবে সেই দিক থেকে এটা হচ্ছে নির্ভুলভাবে এমন ধরনের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যেখানে গণতন্ত্র নিপীড়নের পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলি নির্মূল করে দেয়, এবং একটি সর্বজনীন মিলিশিয়া গঠনের পথ গ্রহণ করে।
কিন্তু কীভাবে মিলিশিয়া সর্বজনীন হতে পারে যখন প্রলেতারিয়েত ও আধাপ্রলেতারিয়েতকে ফ্যাক্টরিগুলিতে গরুখেদানোর মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, জমিদার ও পুঁজিপতিদের জন্য অসহনীয় পরিশ্রম করিয়ে বিধ্বস্ত করা হয়?
এখানে মাত্র একটাই পথ আছে: শ্রমিকদের মিলিশিয়ার পেছনে সমস্ত ব্যয় পুঁজিপতিদের দ্বারা পরিশোধিত হতে হবে।
জনগণের সেবায় শ্রমিকরা যত ঘন্টা এবং যত দিন ব্যয় করবে তার পারিশ্রমিক পুঁজিপতিদের কর্তৃক পরিশোধিত হতে হবে।
শ্রমজীবী জনগণের নিজেদের দ্বারা এই নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি গৃহীত হতে হবে।
নিঝনি-নভগরোদের শ্রমিকদের দৃষ্টান্তটা গোটা রাশিয়ার জন্য একটি মডেল হতে হবে।
কমরেড শ্রমিক ভাইয়েরা, কৃষক এবং বাকি জনগণকে পুলিশ ও সাবেক আমলাতন্ত্রের জায়গায় একটি সর্বজনীন মিলিশিয়ার আবশ্যকতা দেখার মতো যোগ্য করে তুলুন! এই ধরনের মিলিশিয়া, একমাত্র এই ধরনের মিলিশিয়া চালু করুন! শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলির মাধ্যমে, কৃষক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলির মাধ্যমে, শ্রমিক শ্রেণির হাতে রয়েছে ওইসব স্ব-শাসিত স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে এটা চালু করুন। কোনো অবস্থাতেই একটি বুর্জোয়া মিলিশিয়ায় সন্তুষ্ট হবেন না। পুরুষের সম মর্যাদায় নারীদেরও জনগণের সেবায় টেনে আনুন। মিলিশিয়ায় থেকে শ্রমিকরা যত দিন জনগণের সেবায় নিবেদন করছে তার পারিশ্রমিক পুঁজিপতিরা পরিশোধ করছে কিনা সেটা দেখুন!
বাস্তবে অনুশীলন করে গণতন্ত্রের পদ্ধতিগুলি শিখে নিন, ঠিক এখনই, আপনার নিজের জন্য, নিচ থেকে উপর পর্যন্ত সরকারে কার্যকর, দৃঢ়সংকল্প ও সর্বজনীন অংশগ্রহণের জন্য জনসাধারণকে জাগরিত করুন—এটাই এবং একমাত্র এটাই বিপ্লবের পূর্ণ বিজয়ের এবং এর অবিচল, সংকল্পাবদ্ধ এবং সুশৃঙ্খল অগ্রগমনের নিশ্চয়তা দেবে।[১]
তথ্যসূত্র ও টিকা:
১. ভি. আই. লেনিন, কালেক্টেড ওয়ার্কস, খণ্ড ২৪, পৃঃ ১৭৯-১৮২, তৃতীয় মুদ্রণ ১৯৭৭, মস্কো, ১৮ এপ্রিল, ১৯১৭ প্রাভদা ৩৫ নং. সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। রোদ্দুরেতে প্রকাশিত বাংলা অনুবাদটি শেখর রহিম কর্তৃক অনূদিত লেনিনের নির্বাচিত রচনাসংগ্রহ-৪ শ্রাবণ, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ২০১৬, পৃষ্ঠা ১৩০-১৩৩ থেকে নেয়া।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।