স্নায়ুযুদ্ধের কতিপয় বৈশিষ্ট্য (ইংরেজি: Characteristics of the Cold War) হচ্ছে সোভিয়েত মার্কিন প্রভাবিত বিশ্ব ব্যবস্থার স্বরূপ। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধের পরে গোটা সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতরে যে ছদ্ম-যুদ্ধ চলে তাই স্নায়ুযুদ্ধ নামে পুঁজিবাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের নিকট পরিচিতি পায়। এই স্নায়ু যুদ্ধের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
স্নায়ুযুদ্ধের মূল কথা
প্রথমত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই এই ব্যঙ্গ-লড়াইয়ের মূলকথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই দুইটি রাষ্ট্রই ছিলো সবচেয়ে শক্তিশালী এবং তারা সাম্রাজ্যবাদী প্রচারমাধ্যমে Super-power বা মহাশক্তি হিসেবে পরিচিত হয়। তাদের ভেতর যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয় তা বিশ্ব রাজনীতিকে দ্বিমেরুতে বিভক্ত করে যা Bipolar politics বা দ্বিমেরু রাজনীতি নামেও পরিচিতি পায়।
বিশ্ব দ্বিমেরুকেন্দ্রিকতা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করতে এবং সেসব দেশের সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়, সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি দ্বিমেরু বিশ্বে রূপ নিয়েছিল। আকাঙ্ক্ষাগুলিকে মেরুকৃত করা হয়েছিল এবং দুটি ব্লক দেশগুলির একে অপরের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল। এই প্রভাব বৃদ্ধির আগ্রহটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউএসএসআর দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, যুক্তরাজ্য শক্তি হারাতে থাকে এবং উপনিবেশসমূহের মুক্তি প্রক্রিয়াটি যুক্তরাজ্যের প্রভাব হ্রাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলির তদারকি করতে শুরু করেছিল। এই শক্তিগুলির প্রত্যেকটি তাদের নেতৃত্বের একটি স্থির পুনঃনিশ্চয়তা চেয়েছিল, তারা ক্রমাগত আদর্শিক, সামরিক পুনর্নির্মাণ ছাড়াও অন্যান্য জাতির সাথে নিজেকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। এইভাবে তারা বিশ্বে ভারসাম্য চেয়েছিল।
ইউরোপীয় গণ কুসংস্কার
স্নায়ু যুদ্ধে উভয় পক্ষই তাদের নীতিকে রাজনৈতিক মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং সাম্যবাদের নামে ইউরোপে প্রচারণা চালায়। ফলস্বরূপ, সোভিয়েতরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অকমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চেয়েছিল।
ফলে ইউরোপীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তিরা কমিউনিজমের ভূতের ভয়ে মার্কিন পতাকাতলে স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা বিলুপ্ত করে দেয়। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতা ও উদারনীতিবাদের নামে স্নায়ু যুদ্ধ পরিচালনা করে। তার ফলে ঠাণ্ডা লড়াই অনেক পরিমাণে রাজনৈতিক মতবাদের লড়াইয়ের রূপ ধারণ করে এবং উভয় পক্ষই প্রচারকার্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে বাধ্য হয়।
পারমানবিক ও অন্যান্য অস্ত্র
স্নায়ুযুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইউএসএসআরকে তদারক করার জন্য ইউরোপের মিত্র দেশগুলিতে মার্কিন পরমাণু অস্ত্র স্থাপন করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর শত্রুদের এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে বিরত করা। উভয় রাষ্ট্রই জানত যে তারা পারমাণবিক বোমাটি চালুর বোতামের সাহায্যে পুরো শহরগুলিকে ধ্বংস করতে পারে, যেমন হিরোশিমা এবং নাগাসাকির সাথে হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে যে মনস্তাত্ত্বিক আঘাত মানবজাতি পেয়েছিল তা মুহূর্তেই আবার আস্তে পারে।[২]
তবে এই শীতল লড়াইয়ের দুই পক্ষই যথাসম্ভব সামরিক প্রস্তুতি বাড়ানো সত্ত্বেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বিরত থাকে। এই লড়াইকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চলে দুই পক্ষের বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হলেও উভয় পক্ষই যুদ্ধকে সেই অঞ্চলে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য চেষ্টা করে।
ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রকৃতির মধ্যে বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন এসেছে এবং সমস্ত স্তরে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো সমান ভাবে গুরুত্ব পায় নি। সেসব সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকে স্নায়ু যুদ্ধের কারণ ও তার ইতিহাস আলোচনা করা প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র:
১. গৌরীপদ ভট্টাচার্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ ডিসেম্বর ১৯৯১, পৃষ্ঠা ২৩৫।
২. লেখক নামহীন, “Top 10 Characteristics of the Cold War“, তারিখহীন, https://www.lifepersona.com/top-10-characteristics-of-the-cold-war
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।