সুবিধাবাদী সিপিবির কসাইতোষণ এবং ক্ষুদে-বুর্জোয়া নির্বোধদের সিপিবিতোষণ

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবি হচ্ছে সুবিধাবাদী-সংশোধনবাদীদের এমন এক সংগঠন যারা সামন্তবাদ পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ আর সম্প্রসারণবাদের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নিজেদের পরজীবীতা আর মেরুদণ্ডহীনতাকে বাগাড়ম্বর দিয়ে আড়াল করে বুর্জোয়া, ক্ষুদে-বুর্জোয়াদের সব ধরনের পশ্চাৎপদতাগুলোতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখে নয়া-উপনিবেশবাদের উচ্ছিষ্ট ভোগ করে। নানা ধরনের ভাববাদ ও অন্ধতায় ডুবে থাকা সিপিবি নিজেদের উপরে আস্থাহীন, জনগণের শক্তিতে অবিশ্বাসী, কর্মীদের সম্মুখে বুলিবাগিশ, ঊর্ধ্বতনদের কাছে ভূতলশায়ী, উভয়পক্ষের কাছেই স্বার্থপর এবং সে স্বার্থপরতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, রক্ষণশীলদের কাছে বিপ্লবী এবং বিপ্লবীদের কাছে রক্ষণশীল, নিজেদের সাইনবোর্ডধারী আদর্শের কাছে বিশ্বাসঘাতক, রাষ্ট্রশক্তির কাছে অনুগত, শ্রমিক-কৃষকের কাছে ভণ্ড-প্রতারক, সকল বিষয়েই মামুলি আবার মামুলিপনার ক্ষেত্রে অনন্য, মগজে নিশ্চল এবং সকল কর্মে প্রথাগত, বিশ্বঝঞ্ঝায় আতংকিত, ন্যায়যুদ্ধে পলায়নপর, বিশ্বইতিহাসে ভূমিকাহীন, এক কথায় চক্ষু কর্ণ দন্তহীন এক জন্মদণ্ডিত বৃদ্ধ।

এদের অতীত কর্মের ধারাবাহিকতার ফলেই এই আধমরা সংগঠনটি ভারতের কর্পোরেটোক্রেসির প্রতিনিধি, সাম্রাজ্যবাদের সেবক, প্রতিদিন হাজার হাজার কৃষক শ্রমিকের রক্তপানকারী কসাই নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে স্বাগত জানিয়েছে।[১] উল্লেখ্য কসাই নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে তাঁর দুদিনের ভ্রমণ শুরু করেছে ৬ জুন, ২০১৫ তারিখে। একটি কমিউনিস্ট নামধারী পার্টি কী পরিমাণ দেউলিয়া এবং জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলে সাম্প্রদায়িকতা আর ৪০০০ মানুষ হত্যায় ইন্ধনদাতা এক মোদিকে তারা বাংলাদেশে স্বাগত জানাতে পারে।

আপনাদের মনে থাকার কথা গত ২০১৫ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে সিতারাম ইয়েচুরি নামে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সেক্রেটারি বাংলাদেশ ভ্রমণ করে গেছিল। মূলত মোদির আগমনের আগে মাঠ তৈরি করতে সে বাংলাদেশে এসেছিলো। সে নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সে সার্টিফিকেট দিয়েছিলো যে নরেন মোদী খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কাজ করছে। ইয়ে চোর বলে,

“মানুষের মঙ্গলের জন্য যেকোন প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের সফরকে স্বাগত জানাই। কেননা আমাদের সংগ্রাম তো খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য। তাদের জন্য যারাই কাজ করবেন আমরা তাকে স্বাগত জানাব।”[২]

ইয়েচোর বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশকে মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে সবক দিলেও শ্রেণিসংগ্রাম, সমাজতন্ত্র, শ্রমিক ও কৃষক, শ্রেণি রাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো কথাই বলেনি। সুধাকর রেড্ডি, সিতারাম ইয়েচোর মূলত কংগ্রেসপন্থি নেতা যাদের সারাটা জীবন গেছে কেন্দ্রের ক্ষমতায় কংগ্রেসকে টিকিয়ে রাখতে। ২০১৯ সালে ভারতের নির্বাচনের পূর্বে এই গাড়লটা নিজের ধ্বংস দেখতে পায়নি, সে তখনো কল্পনামৈথুন করছে, যে ২০১৯ সালে “কেন্দ্রে কংগ্রেস বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করার মতো অবস্থায় পৌঁছালে বামরা সমর্থন জানাতে দ্বিধা করবে না।”[৩] নির্বাচনের ফল বেরোলে দেখা গেল, চোরার পার্টি মাত্র ৩টা আসনে জিতেছে।

আরো পড়ুন:  শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে

জ্যোতি বসু, প্রকাশ কারাত, সুধাকর রেড্ডি বা সীতারাম ইয়ে চোরার মতো পাঁড়-সংশোধনবাদি ও কংগ্রেসের পদলেহনকারি পার্টিতে থাকলে ওই পার্টি দ্বারা বিপ্লব করা যায় না, যতোই বিপ্লবের অনুরাগিগণ পার্টিতে যাক না কেন।

সিপিবি সম্পর্কে আরো বলা যায় দেশের ভেতরে তাদের সমস্ত কাজই আওয়ামি লিগের পিছে গিয়া ফুরাইল; আর দেশের বাইরে ‘তাদের কাজ থেকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, এদের মিত্র শাসক গোষ্ঠী, সামন্ত-বুর্জোয়া শ্রেণি, এবং এমন কি হাল আমলে এনজিওরা পর্যন্ত উপকৃত হয়ে আসছে।’ এই ইতিহাস কিন্তু বাংলাদেশের শুরু থেকেই, যেমন মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর দৈনিক বাংলায় এক সাক্ষাতকারে ভারতীয় বন্ধুত্বের স্বরূপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ফলশ্রুতিতে ছাত্র ইউনিয়ন পরদিন পত্রিকাটির সামনে বিক্ষোভ দেখায় এবং সেই চাপে পত্রিকাটি ২৬ জানুয়ারি দুঃখ প্রকাশ করে সাক্ষাতকারটি প্রকাশের জন্য। ১৯৭২ সালে ২২ এপ্রিল লেনিনের ১০২তম জন্মদিন পালন অনুষ্ঠানে সিপিবির কুচক্রী নেতা মনি সিংহ বলেছিলেন,

“মহান লেনিনের আদর্শ অনুসরণ করেই মুজিব সরকার বাংলাদেশের উন্নয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।”[৪]

সিপিবিকে যারা সমর্থন করেন, হয়তো এসব সমর্থক মনেও করেন সিপিবি একদিন এদেশে বিপ্লব ফাটাবে, কিন্তু তারা বিবেচনা করেন না যে তারা এমন এক অন্ধের কাছে হস্তরেখা বিচার করতে দিয়েছেন যারা কোনোদিনই শ্রমিককৃষককে শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেনি। সিপিবি হচ্ছে সেই জন্মপাপে পাপী এক রোবটের ঘোড়া যাকে বাইরে থেকে শক্তি না দিলে সেটি নড়াচড়া করে না। নেহেরু-ইন্দিরারা যেমন লাল ঘোড়া দাবড়াইয়াও সিপিআই-সিপিএমের সমর্থন পায়, সিপিবি তেমনি প্রায় অর্ধলক্ষ কমিউনিস্ট এবং অর্ধ লক্ষ আদিবাসী হত্যাকারী বুর্জোয়া লীগেনপির  পেছনেই থাকে, খাল কেটে কুমির আনায় জিয়াকে সাহায্য করে, ১৯৯১ সালে নৌকা মার্কা লইয়া আওয়ামি লিগের পক্ষেই ভোটে অংশ নেয়। সেই পুরনো কর্মের ধারাবাহিকতায় তারা মোদিকে বাংলাদেশে স্বাগত জানিয়েছে।

আরো পড়ুন:  মালিকেরা শোষকের কদাকার নোংরা চেহারা আড়াল করতে চায়

সিপিবি যতই ইনিয়ে বিনিয়ে শ্রেনিসংগ্রাম বাদ দিয়ে মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদি লাইন নিয়ে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগনকে সজ্জিত করার প্রতারনার লাইন নিয়ে আর যাই হউক, বিপ্লব হয় না। বনেদি বা খানদানী পরিবার থেকে আগত কমিউনিস্ট নেতারা ছিলেন মার্কসবাদ ও প্রলেতারিয়েতবিরোধী এবং এটাই ছিল এদেশে ফ্যাসিবাদের উত্থানের অনেক কারনের একটি। এই কারণেই কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ অভিজাত প্রতিক্রিয়াশীলদের দখলে ছিল। আর এখনকার আধা-ফ্যাসিবাদি সিপিবির দশম কংগ্রেসের দলিলসমূহ থেকে কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছি; এটিই প্রমাণ করে সিপিবি এখনো প্রতিক্রিয়াশীলদের আখড়াঃ

“পার্টিতে সার্বক্ষণিক হিসেবে যারা কাজ করছেন, তাদের সমস্যা বেশ গভীর। সার্বক্ষণিকদের জন্য ফান্ড গঠনে জেলাগুলোর প্রচেষ্টার ঘাটতি আছে। পার্টি ও গণসংগঠনের জন্য পার্টির সকল স্তরে আরো সার্বক্ষণিক প্রয়োজন। সার্বক্ষণিকদের জন্য পার্টির বিশেষ তহবিল গড়ে তুলতে হবে। পরিবারের উপর নির্ভর করে চলতে পারে, এধরনের সার্বক্ষণিক খুঁজে বের করতে হবে।”[৫]  

উপরের উদ্ধৃতিটুকুর সহজ বাংলা হচ্ছে, সিপিবির সার্বক্ষণিকদের অনেক টাকার দরকার; আপনার বাপ যদি কোটিপতি হয় তবে সিপিবি আপনাকে ডাকছে। সিপিবির জন্যে বিপ্লবী জনগণ শুধু ঘৃণাই জমা রাখতে পারে। সিপিবির কর্মী সমর্থক শুভানুধ্যায়ীদের যত দ্রুত বোধোদয় হয় ততই মঙ্গল, তবে সকলের বোধোদয় হবে না এটি আমরা জানি।

তথ্যসূত্র:

১. চন্দন সিদ্ধান্ত, বার্তা প্রেরক, কেন্দ্রীয় দপ্তর বিভাগ, “মোদীর আসন্ন ঢাকা সফর সম্পর্কে সিপিবি”, ৪ জুন ২০১৫, ওয়েবসাইট: সিপিবিবিডি ডট ওরগ, লিংক: http://cpbbd.org/?page=details&serial=73

২. বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ২৯ মে ২০১৫, বাংলানিউজটুয়েন্টিফোর ডট কম, “মোদির সফরকে স্বাগত জানালেন ইয়েচুরি”, লিংক: https://www.banglanews24.com/banglanewsprint/397238

৩. কলকাতা প্রতিনিধি, দৈনিক মানবজমিন, “কংগ্রেস সরকার গঠন করলে বামরা সমর্থন দেবে: সীতারাম ইয়েচুরি”, ১৬ এপ্রিল ২০১৯; লিংক: http://www.m.mzamin.com/article.php?mzamin=168350

৪. আলতাফ পারভেজ উদ্ধৃত, ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী’ ইতিহাসের পুনর্পাঠ; দৈনিক সংবাদ, ২৩ এপ্রিল ১৯৭২।

৫. দশম কংগ্রেসে গৃহীত দলিলসমূহ; সিপিবি, সিসি; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী; নভেম্বর, ২০১২; পৃষ্ঠা- ৭১।

আরো পড়ুন:  প্রধান শত্রু নির্ণয়ের সমস্যা ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি

রচনাকাল ৬ জুন, ২০১৫

Leave a Comment

error: Content is protected !!