সাংস্কৃতিক বিপ্লব ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদের জন্য সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন

সাংস্কৃতিক বিপ্লব (ইংরেজি: Cultural revolution) হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানাসহ পুঁজিবাদী সমাজের নানা চিহ্ন, ধারনা ও স্মারক উচ্ছেদের জন্য সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন। পুঁজিবাদী সমাজ হতে বাহিত এসব প্রতিক্রিয়াশীল চিহ্ন, ধারনা ও স্মারক থেকে হুট করে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। মানব সমাজ দাস, সামন্ত ও পুঁজিবাদকে অতিক্রম করলেও শোষণের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। এই শোষণের ধারা ও পুরনো সমাজের পশ্চাৎপদ চিহ্নগুলো থেকে মুক্তির লক্ষ্যে প্রলেতারিয়েতকে একনায়কত্ব কায়েমের পর চালাতে হয় এক অনিবার্য সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এই বিপ্লবের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সমীরণ মজুমদার লিখেছেন,

“সাংস্কৃতিক বিপ্লব হলো এত দিন ধরে চলে আসা ধ্যান-ধারনা, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্র, কাজ-কর্ম প্রভৃতি যা কিছু সমাজের জঙ্গমত্বের পথে অন্তরায় তার বিরুদ্ধে ঘোষিত এক সামাজিক জনযুদ্ধ। এ হলো মানুষকে এক নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, নতুন সমাজের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবার অভূতপূর্ব মহাযাত্রা।”[১]

সাংস্কৃতিক বিপ্লব হচ্ছে উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদের ভিত্তিতে উত্তরণ পর্বকালীন বাস্তবায়িত সমাজের মানসিক ও ব্যবহারিক জীবনের আমূল পরিবর্তন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সংস্কৃতির জন্ম দেয়া, প্রাচীন পুঁজিবাদী ও সামন্তীয় সংস্কৃতির বিলোপ সাধন করে সমগ্র সমাজে জ্ঞানভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ সৃষ্টি করা। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের তত্ত্ব গড়ে তোলেন ভ্লাদিমির লেনিন তার সমাজতন্ত্র নির্মাণের পরিকল্পনার এক আবশ্যকীয় অঙ্গ হিসেবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ তেমন জোরালোভাবে শুরু না হলেও নানা সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশে সেটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়। এই বিপ্লব সমাজতন্ত্র অভিমুখী জাতিগুলোর প্রগতিশীল জাতীয় ঐতিহ্যের সাথে মিলিয়ে বাস্তবায়িত হয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লব একদিকে অতীতের উত্তরাধিকারের সমালোচনামূলক উপলব্ধি এবং শোষক শ্রেণিগুলোর ভাবাদর্শকে অতিক্রমের প্রক্রিয়া এবং এই বিপ্লব অন্যদিকে এক নতুন সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ার প্রক্রিয়া। এই বিপ্লব প্রলেতারিয়েতের চেতনায় মার্কসবাদী লেনিনবাদী বিশ্ববীক্ষার প্রসার, সামাজিক চেতনার সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন, গুণগতভাবে নতুন প্রলেতারিয় বিপ্লবী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা ও প্রোথিত করে; ‘বুর্জোয়া সংস্কৃতির সংগে, বুর্জোয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সংগে বিজয়ী প্রলেতারীয় বিপ্লবের মিলন’ ঘটায়; বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে পুনঃশিক্ষিত ক’রে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে শ্রমিক ও কৃষকের মাঝখান থেকে নতুন যুগের বুদ্ধিজীবী গড়ে তোলে।[২]

প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েমের সংগে সংগেই রাতারাতি বুর্জোয়া সংস্কৃতি উৎখাত হয়ে যায় না। লেনিন এই ক্ষেত্রে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের মতো আকাশকুসুম কিছু দেখেননি। তিনি পুঁজিবাদী সমাজের ভেতর থেকেই সাম্যবাদ গড়ার পথের নির্দেশক। তিনি লিখেছেন,

“মানবজাতির সমগ্র বিকাশের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সংস্কৃতির যথাযথ জ্ঞান লাভ করেই এবং সে সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজিয়েই কেবল আমরা প্রলেতারীয় সংস্কৃতি গড়তে পারি। … … পুঁজিবাদি সমাজ, জমিদারি সমাজ, আমলাতন্ত্রি সমাজের জোয়ালের নিচে মানব জাতি যে জ্ঞানভাণ্ডার জমিয়েছে, প্রলেতারীয় সংস্কৃতিকে হতে হবে তারই সুনিয়মিত বিকাশ।”[৩]

নভেম্বর বিপ্লবের পরে রাশিয়াতে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটা করে শুরু করা হয়নি, কিন্তু বিপ্লবের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। লেনিন বলেছিলেন যে রাশিয়ায় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগেই এসেছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লব এবং সোভিয়েত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। মুখোমুখি দাঁড়িয়েও রাশিয়ায় যা ঘটতে পারেনি, চিন দেশে ঘটা করে শুরু করা হয়েছিল সেই সাংস্কৃতিক বিপ্লব। মাও সেতুং ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করে চালিয়েছিলেন চীনের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব। চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছিল বুর্জোয়াদের ঔদ্ধত্যকে উপড়ে ফেলার জন্য এক দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম। এই বিপ্লবের ১৬ দফা কর্মসূচিতে যেসব বিষয় ফুটে ওঠে তা এমন এক সংগ্রাম ছিলো যা মানুষকে বদলে দেবার জন্য পরিচালিত। চিনের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব শ্রমিকশ্রেণির ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সাংস্কৃতিক বিপ্লব জনগণের চিন্তাকে এমনভাবে পাল্টে দিয়েছিল যা এর আগে কখনোই ঘটেনি। জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বকে আঁকড়ে ধরে চিনের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব বুর্জোয়াদের পথ-গ্রহণকারী কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরের প্রতিক্রিয়াশীলদের উৎখাতে চেষ্টা করেছিল। যেমন, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শুরুতেই সদর দপ্তরে কামান দাগো শিরোনামের প্রথম বড় হরফের পোস্টারে মাও সেতুং লিখেছিলেন,

“… কেন্দ্র থেকে শুরু করে নিচে স্থানীয় স্তর পর্যন্ত কিছু নেতৃস্থানীয় কমরেড পুরোপুরি উল্টোভাবে কাজ করেছে। বুর্জোয়াদের প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান গ্রহণ করে তারা এক বুর্জোয়া একনায়কত্ব চাপিয়ে দিয়েছে এবং সর্বহারার মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উত্তাল তরঙ্গময় আন্দোলনকে আঘাত করেছে।
তারা তথ্যগুলোকে উল্টে দিয়েছে এবং কালো ও সাদাকে গুলিয়ে ফেলেছে, বিপ্লবীদেরকে ঘেরাও করেছে ও দমন করেছে, তাদের নিজেদের থেকে ভিন্ন এমন মতামতগুলোকে রুদ্ধ করেছে, শ্বেত সন্ত্রাস চাপিয়ে দিয়েছে, এবং নিজেদের নিয়ে খুব সন্তুষ্টিতে ভুগেছে। তারা বুর্জোয়াদের ঔদ্ধত্যকে চাঙ্গা করেছে এবং সর্বহারা শ্রেণির মনোবলকে চুপসে দিয়েছে।[৪]”

ভ্লাদিমির লেনিন জীবিতাবস্থায় সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করতে না পারলেও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। আর মাও সেতুং-এর কমিউনিস্ট পার্টি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করে। চীনের সেই বিপ্লব পরিচালিত হয়েছিল অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের মতাদর্শগত এবং পরিকল্পনা ও প্রয়োগগত বিষয়ের দ্বন্দ্বসমূহকে কেন্দ্র করে। ‘এই সমস্ত দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এক জটিল অবস্থার সমাধানের জন্য নিয়োজিত হয়েছিল ব্যাপক জনগণের কর্মোদ্যোগ, সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ যা ‘চিনা জনগণের মধ্যে বাঁধভাঙা জলস্রোতের মতো আলোড়ন সৃষ্টি হলো। মানুষ নিজেকে বদলাবার সবচেয়ে দুঃসাহসিক বিপ্লব শুরু করল’।[৫]

তথ্যসূত্র:
১. সমীরণ মজুমদার, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, র‍্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১০, পৃষ্ঠা ১৫
২. আরো দেখুন, খারিস সাবিরভ, কমিউনিজম কী, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ২৫৩-৫৫
৩. ভি. আই. লেনিন, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭১; পৃষ্ঠা ৭৯-৮০
৪. সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কয়েকটি দলিল, শ্রাবণ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১২, পৃষ্ঠা ১৫, ISBN 9789848827925।
৫. এই বিপ্লব বিষয়ে পড়ুন ৩টি বই; যথা ০১. সমীরণ মজুমদার, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, র‍্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১০। ০২. এডগার স্নো, চীনের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব; দ্বিজেন গুপ্ত অনূদিত; র‍্যাডিক্যাল, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০০৯। ০৩. ডংপিং হান, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অজানা কথা, একটি গ্রামের বিপ্লবী রূপান্তরের কাহিনী; সুশোভন মুখোপাধ্যায় অনূদিত; কর্নারস্টোন পাবলিকেশনস; জানুয়ারি, ২০০৯। প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] লিখিত ২০১৫ সালে ভাষাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ৬১-৬৪ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশ করা হলো।

Leave a Comment

error: Content is protected !!