জনগণের গণতান্ত্রিক আচরণের অনুশীলন প্রসঙ্গে

জনগণ গণতন্ত্র চান এবং এই গণতন্ত্রের একটি পশ্চাৎপদ রূপ দাস সমাজেই দেখা গেছিল। পরবর্তীতে আধুনিক সমাজে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনেন মূলত উঠতি বুর্জোয়ারা এবং তাদের সমর্থক কতিপয় মহান দার্শনিক। বুর্জোয়ারা মূলত সামন্তবাদকে ভেঙে ফেলেন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মুনাফার মাধ্যমে ভুমিদাসকে নিক্ষেপ করেন শহরে মজুরি শ্রমিক হিসেবে। ফলে পুঁজিবাদী সমাজের গণতন্ত্র থেকে যায় পুঁজিবাদী শোষণ ও লুটের গণতন্ত্র।

সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত দেশসমূহে গণতন্ত্রকে জনগণের মাঝে প্রচার করা দরকার। গণতন্ত্রের ভালো-মন্দ জনগণের মাঝে উপস্থাপন করা দরকার। জোর করে বা হুকুমনামা জারি করে বা আমলাতান্ত্রিক নির্দেশে বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কাউকে গণতান্ত্রিক করা যায় না। জনগণের গণতান্ত্রিক আচার-আচরণকে যেমন জনগণের দিক থেকে শিখে নিতে হয় তেমনি সামাজিক-রাষ্ট্রিক সমস্ত কর্মকাণ্ডে ব্যক্তিকে গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ প্রয়োগ করতে হয়; নতুবা গণতন্ত্র কথার কথা অথবা পুস্তকের বাণী হিসেবে থেকে যাবে। বিশেষ করে প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রী সমাজে সামন্তবাদ, আধা-সামন্তবাদ, পণ্য অর্থনীতি, পুঁজিবাদ, ক্ষুদ্রায়তনের কৃষি যেভাবে জগদ্দল পাথরের ন্যায় জনগণের বুকের উপর চেপে আছে, সেখানে গণতন্ত্র তীব্র শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে এবং অনবরত প্রচারের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। তবে এটুকুই যথেষ্ট নয়; এই বিষয়ে লেনিন লিখেছেন,

“গণতন্ত্রের প্রচার করলেই হলো তা নয়, গণতন্ত্র ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি জারি করাটাই যথেষ্ট নয়, প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলিতে জন-প্রতিনিধিদের সেটা কার্যে পরিণত করার ভার দেওয়াই যথেষ্ট নয়। গণতন্ত্র সংগে সংগে গড়ে তোলা চাই নিচ থেকে, জনসাধারণের নিজেদেরই উদ্যম মারফত, রাজকার্যের সমস্ত ক্ষেত্রে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণের সাহায্যে, উপর থেকে ‘তদারক’ ছাড়াই, আমলাতন্ত্র ছাড়াই।”[১]

তবে সামাজিকভাবে ভাবে যারা গণতন্ত্রকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করে, যারা জনগণের মতের তোয়াক্কা করে না, যারা জনগণের ওপর নিপীড়ন করে তাদেরকে গণশত্রু হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্রের শত্রুদের স্বাধীনতা খর্ব করা গণতান্ত্রিকদের অধিকার।

সামজিক জীব হিসেবে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ গণতান্ত্রিক আচরণ করে থাকে। সমস্যা তৈরি হয়েছে মূলত বৈষম্য সৃষ্টির পরবর্তীকাল থেকে। সমাজ শ্রেণিবিভক্ত হবার পর থেকে দাসমালিক, সামন্তপ্রভু ও পুঁজিপতিরা দাস, ভূমিদাস ও মজুরি দাসকে নির্যাতন করে আসছে। বর্তমান যুগে সমাজ বিকাশের জন্য সমাজতন্ত্রসাম্যবাদবিরোধিরা হচ্ছে জনগণের বিপক্ষ শক্তি। তবে গণশত্রু হচ্ছে তারা যারা সাম্রাজ্যবাদকে সহযোগিতা করে, জনগণকে নিপীড়ন করে, জনগণের সম্পদ লুট করে উলটো জনগণের উপর যুদ্ধ ও নিপীড়ন চাপিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মাটি থেকে এদের অবশেষকে উচ্ছেদ করতে হবে।

আরো পড়ুন:  অনশন প্রসঙ্গে

জনগণ যেহেতু গণতন্ত্রের প্রত্যাশা করেন তাই তারা যাতে গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডের চর্চা করতে পারে সে পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রধান দায়িত্ব। জনগণের ভেতরে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব বিরাজ করে এবং এসব দ্বন্দ্বের সমাধান আমলাতান্ত্রিক জবরদস্তিমূলকভাবে করতে গেলে সমস্যা আরো বাড়বে এবং জনগণ, রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসমূহ অগণতান্ত্রিক হয়ে যাবে। রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা যেমন জোর করে কাউকে কোনো মতবাদ পরিত্যাগ করতে বলতে পারেন না, জোর করে ভাববাদী কুসংস্কার পালন বা পরিত্যাগ করতে বলতে পারেন না, তেমনি জোর করে কাউকে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত করতে পারেন না। জনগণের ভেতরের ভুলত্রুটিকে দূর করতে হলে, তাদের আদর্শগত ও চেতনাগত সীমাবদ্ধতাসমূহকে দূর করতে হলে, তাদেরকে বিকাশশীল গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে হলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, বুঝিয়ে বলার পদ্ধতি, পছন্দ করবার স্বাধীনতা অবলম্বন করতে হবে। এই প্রসঙ্গে মাও সেতুং লিখেছেন,

“যে কোনো মতাদর্শগত প্রকৃতির সমস্যার, এবং জনগণের ভেতরকার বিতর্কমূলক সমস্যার মীমাংসায় কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়, কেবলমাত্র আলোচনা, সমালোচনা, বুঝিয়ে বলার ও শিক্ষা দেবার পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়, বাধ্য করা ও চাপ দেবার পদ্ধতি নয়।”[২]  

গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলতে আমরা বুঝবো ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা, অন্যের কথা শোনা, মতপ্রকাশ, অন্যের প্রতি মনোযোগ, চিন্তার স্বাধীনতা, শুভবুদ্ধির প্রকাশ, তর্ক-বিতর্ক, মতাদর্শগত প্রচার, আদর্শিক বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা সম্বলিত পুস্তিকা লিফলেট প্রচার এবং এইসব কিছুর সম্মিলিত ব্যবহারিক প্রয়োগ। মাও সেতুং-এর ‘শত ফুল ফুটুক ও শত রকমের মতবাদ পরস্পরের সংগে প্রতিযোগিতা করুক’ নীতিতে যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাকেই জনগণের মাঝে গণতান্ত্রিক শিক্ষা প্রচারের পদ্ধতিরূপে গণ্য করা যায়।

গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতির ব্যাখ্যায় বলা যায়, গণতান্ত্রিক কর্ম জনগণের মাঝে হটাত আবির্ভূত হয় না। গণতান্ত্রিক আচরণ যেমন প্রয়োগের ব্যাপার তেমনি অর্জনেরও ব্যাপার। সকল ধরনের গণতান্ত্রিক কর্ম জনগণের মঙ্গলের জন্য নিবেদিত। জনগণের পক্ষে কাজ করার জন্যই গণতন্ত্রে জনগণের নেতৃত্ব ও জনগণের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন। একুশ শতকে জনগণ সংক্রান্ত আলোচনায় প্রথমেই আসবে মহান শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণির কথা। এই কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির শোষণকারি সকল শ্রেণিই জনগণের উপর নির্ভরশীল পরগাছাশ্রেণি। এই পরগাছাশ্রেণিকে উৎখাতের জন্য কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ ও সে অনুযায়ি কার্যক্রম পরিচালনাকে গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতি বলা যায়। গণতন্ত্রের কার্যকারিতা দেখা যাবে যখন গোটা দুনিয়ায় সাম্যবাদ আবির্ভূত হবে। শোষণ যতদিন আছে ততদিন সবার জন্য গণতন্ত্র সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে লেনিন লিখেছেন,

আরো পড়ুন:  রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি প্রসঙ্গে

“পুঁজিবাদের আমলে মজুরি দাসত্ব, জনগণের অভাব ও নিঃস্বতার সমস্ত পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র সীমাবদ্ধ, পিষ্ট, কর্তিত ও বিকৃত। … … সমাজতন্ত্রে ‘আদিম’ গণতন্ত্রের অনেক কিছুই অনিবার্যভাবেই পুনরুজ্জীবিত হবে, কেননা সভ্য সমাজের ইতিহাসে এই প্রথম জনগণ স্বাধীনভাবে উঠে দাঁড়াবে শুধু ভোটদান ও নির্বাচনে অংশ নিতে নয়, দৈনন্দিন প্রশাসনেও অংশ নিতে। সমাজতন্ত্রে সবাই প্রশাসন চালাবে পালা করে এবং দ্রুত এই জিনিসটায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে যে কেউ আর প্রশাসক থাকছে না।”[৩]

গণতান্ত্রিক সমাজে নতুন চিন্তাকে প্রকাশিত হতে দিতে হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সমাজে নতুন চিন্তা কারো দ্বারা উত্থাপিত হলে তা প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয়। যেমন, সৌরজগত সম্পর্কিত মতবাদ, বিবর্তনবাদ, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ ইত্যাদি ধারণা শুরুতেই জনগণের দ্বারা গৃহীত হয়নি; কিন্তু ধীরে ধীরে এসব মতবাদ ঠিকই জনগণের মাঝে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় নতুন চিন্তার ভালমন্দ বিচার-বিশ্লেষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে, বিশেষ করে বিদেশ হতে আমদানিকৃত প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাসমূহকে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তশ্রেণিটি অন্ধভাবে গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে প্রগতিশীল চিন্তাগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে আমাদের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যের সাথে আত্মীকৃত করে তার ভাল দিকগুলো গ্রহণ করা হয় না, বরং অনেক সময় অন্ধ অনুকরণের চেষ্টা করা হয়। এই অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে এদেশের জনগণের অতীত অভিজ্ঞতা ও তাদের শিক্ষাকে অবমূল্যায়ন করা হয়। তাই এদেশের জনগণের ভেতরে গণতন্ত্র তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। বিশেষ করে ঢাকা শহরের প্রতিক্রিয়াশীল মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের ঘাড়ে ইউরোপের মৃত ভূত যেমন ইউরোকেন্দ্রিকতাবাদ, আধুনিকবাদ, উত্তরাধুনিকবাদ, উপনিবেশবাদ, নয়া-উপনিবেশবাদ, দাদাবাদ, অস্তিত্ববাদ, পরাবাস্তববাদ ইত্যাদি প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা চেপে বসে আছে। অথচ এসব মতবাদের অনেকগুলোর গুরুত্ব পৃথিবীতেই নেই।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখনও প্রভাবশালী মতাদর্শ হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাস্তববাদ, পুঁজিবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। এসব প্রভাবশালী মতবাদ নিয়ে ঢাকা বা কলকাতায় আলোচনা খুবই সামান্য কিন্তু ছোটখাট হারিয়ে যাওয়া মতবাদ নিয়েও ঢাকা-কলকাতার তরুণ-তরুণীরা মাথা ঘামায়।[৪]

আরো পড়ুন:  বহুজাতিক আসামে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আস্ফালন প্রসঙ্গে

তথ্যসূত্রঃ

১. ভি আই লেনিন, কৃষক ডেপুটিদের কংগ্রেস, ১৬ এপ্রিল, ১৯১৭, জনসাধারণের মধ্যে পার্টির কাজ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ৮৬।

২. মাও সেতুং, জনগণের ভেতরকার দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসার সমস্যা সম্পর্কে; ২৭ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৭, সভাপতি মাও সেতুঙের উদ্ধৃতি, বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পিকিং, প্রথম প্রকাশ,  ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮।

৩. ভি আই লেনিন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব, আগস্ট-সেপ্টেম্বর, ১৯১৭, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৫।

৪. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] সম্পাদিত ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা গ্রন্থে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রাণকাকলিতে ১৩ জুলাই, ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত হয়। প্রাণকাকলি ও রোদ্দুরে ডট কমে প্রকাশের সময় পরিবর্ধন করা হয়েছে। রচনাকাল জুন-জুলাই, ২০১০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!