জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম-এর কর্মপদ্ধতি প্রসঙ্গে

গণতান্ত্রিক চেতনা জনগণের সংগ্রামী চেতনার সাথে জড়িত। সংগ্রাম বলতে বোঝায় মানুষের জীবন, জীবনবোধ ও তার পরিবেশ উন্নত করার সংগ্রাম। সংগ্রাম বলতে বোঝায় অন্যায়, অত্যাচার, আগ্রাসন, শোষণ, লুটতরাজ, মুনাফা, যন্ত্রণা, দারিদ্র, হতাশা, অন্ধকার, পরাধীনতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও কর্মসূচি নিয়ে একটি ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই। এ লড়াই মুখের কথায় চলে না, সাদা পাতায় প্রবন্ধ লিখেও চলে না; এ লড়াই চালাতে হলে কর্মপদ্ধতি লাগে, শত্রুকে চিহ্নিত করা ও তাদেরকে উচ্ছেদ করার কাজে অংশগ্রহণ করা লাগে। কাজেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের শত্রু কারা সেটি চিহ্নিত করা জরুরি।

বাংলাদেশে জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো এখনও পূরণ হয়নি। জনগণের দুর্দশার জন্য দায়ি ব্যক্তিদের, জনগণের দুর্দশার জন্য দায়ি শ্রেণিটিকে উচ্ছেদ করার জন্য কর্মপদ্ধতি দরকার। জনপীড়নকারী ও নির্যাতক শ্রেণিটিকে উৎখাত করা জনগণের পরম গণতান্ত্রিক কর্তব্য। জনগণের গণসংগ্রাম ও শ্রেণিসংগ্রামের কর্মপদ্ধতি বলতে বোঝায় জনগণের কর্মসূচি, কর্মনীতি, উদ্দেশ্য সাধনের উপায় নির্ধারণ, নেতৃত্ব নির্বাচন ও নেতৃত্ব প্রদান, সমস্যা তুলে ধরা ও সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান বের করা, সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্ন করা ও তার উত্তর নির্ধারণ, সমস্যার তথ্য সংরক্ষণ ও তথ্যের আদান-প্রদান, অভিজ্ঞতার সার সংকলন, সফলতা ও ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ, সমস্যা সংক্রান্ত পঠন-পাঠন, বিভিন্ন কাজের সমন্বয় সাধন, প্রধান কাজ ও অপ্রধান কাজ নির্ধারণ, যৌথ কাজ ও ব্যক্তিগত কাজ নির্ধারণ এবং দুটিকেই গুরুত্ব প্রদান, কাজের উন্নতি সাধনের প্রক্রিয়া বের করা, দায়িত্ব নির্ধারণ ও দায়িত্বের যৌথ বণ্টন, ভিন্ন মতাবলম্বীদের সাথে আলোচনা সমালোচনা ও সমন্বয়সাধন, ভিন্নমতাবলম্বীদের সাথে কাজের ধারা নির্ধারণ, কাজের সহায়কশক্তি নির্ধারণ এবং তাদের সাহায্য গ্রহণ, সংগ্রামের ক্ষেত্রে মাত্রাজ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান কাজে লাগিয়ে জনজীবনের অবস্থার উন্নতি সাধন।

গণসংগ্রাম ও শ্রেণিসংগ্রামের কর্মপদ্ধতি খুঁজতে গেলেই আমরা প্রয়োজন বোধ করবো একটি সংগঠনের যা কমিউনিস্ট পার্টি ভিন্ন অন্য কোনো সংগঠন হতে পারে না। আর এই পার্টির কর্মনীতি ও কৌশলসমূহ হচ্ছে পার্টির বিস্তারিত কর্ম প্রক্রিয়া। এসব প্রক্রিয়াকে অবলম্বন করার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজকে বদলে দেয়া এবং অর্থনীতিকে উলটে ফেলা, শোষণমূলক অর্থনীতিকে সমতার অর্থনীতিতে রূপান্তর করা। এই বিশাল বৈপ্লবিক কর্মযজ্ঞটি বিজয় অর্জন পর্যন্ত চালাতে হলে জনগণের সংগে পার্টির নেতৃত্বে ঐক্য ছাড়া সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে মাও সেতুং লিখেছেন,

“আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্ব-অগ্রগতির অবস্থা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জনগণের মধ্যে সর্বদা প্রচার চালাতে হবে, যাতে বিজয়ের উপর জনগণ আস্থা স্থাপন করতে পারেন। একই সময়ে জনগণ এবং কমরেডদেরকে আমাদের বলে দিতে হবে যে, এই পথ হচ্ছে আঁকাবঁকা | বিপ্লবের পথে আরো অনেক বাধাবিঘ্ন ও দুঃখ-কষ্ট রয়েছে। … … আমাদের অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে, কারণ আমরা বাধা-বিপত্তিকে আরো বেশি করে ভাবতে পছন্দ করি | আমাদের কোনো কোনো কমরেড কষ্টকে বেশি করে ভাবতে চান না | কিন্তু কষ্টটা হচ্ছে বাস্তব, কষ্ট যতই থাক, ততই তা স্বীকার করতে হবে, ‘অস্বীকারের নীতি’ অবলম্বন করলে চলবে না। আমাদের কষ্টকে স্বীকার করতে হবে, তার বিশ্লেষণ করতে হবে এবং তার সংগে সংগ্রাম করতে হবে। পৃথিবীতে কোথাও সোজা পথ নেই, আঁকাবাঁকা পথে চলার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, কখনো সস্তায় কোনো কিছু লাভের চেষ্টা করা উচিত নয়। এটা মনে করা উচিত নয় যে, কোনো এক সুন্দর ভোরে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা স্বেচ্ছায় হাঁটু গেড়ে বসবে। এক কথায়, আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, কিন্তু পথটি আঁকাবঁকা| আমাদের সামনে বহু বাধা-বিপত্তি রয়েছে, যা আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়। আমরা সমগ্র জনগণের সংগে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমবেত প্রচেষ্টায় অবশ্যই সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করতে ও বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হবো।[১]

জনগণ গণতান্ত্রিক হলে তাদের আত্মনির্ভরতাবোধ, আত্মসম্মানবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধ বৃদ্ধি পায় এবং তারা স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি করতে পারে। গণতান্ত্রিক জনগণ তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়, দায়িত্ব পালনে ভীত থাকে না, সমস্বার্থের ভিত্তিতে দলবদ্ধ থাকে, যৌথ সামাজিক জীবনে সমমর্যাদায় সমঅধিকারে এবং স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়, সামর্থ্য অনুযায়ী সম্পদ উৎপাদন করে, সম্পদের যৌথ বণ্টন করে, জীবনব্যবস্থাকে সচল ও গতিশীল রাখে। গণতান্ত্রিক জনগণের একটি প্রধান কাজ হচ্ছে অন্ধ কুসংস্কারের ও সব রকম কানাগলির বিপক্ষে লড়াই করে, বিজ্ঞানের মাধ্যমে নিজেদের চিন্তাচেতনাকে উন্নত করে, দ্বান্দ্বিকঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে পরিবেশ তৈরি করে। এক কথায় গণতান্ত্রিক জনগণ হচ্ছে তারাই যারা সমস্ত সংগ্রামের রূপ, রূপভেদ ও পদ্ধতিসমূহকে সমৃদ্ধ ও পুঞ্জীভূত করে ‘সাহস, আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা জ্ঞান এবং স্বাতন্ত্র্যবোধ’সম্পন্ন হয়ে সকল শ্রেণির বিলুপ্তির জন্য অবিরত লড়াই করে। আর এই জনগণের অগ্রগামি বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই প্রলেতারিয়েত শ্রেণি যারা এক ব্যাপক ও প্রকাশ্য সংগ্রাম চালাতে পারে মুক্তির জন্য।[২]

আরো পড়ুন:  নয়া গণতন্ত্র মাও সেতুংয়ের চিন্তাভিত্তিক তত্ত্ব ও প্রয়োগের মতবাদ

তথ্যসূত্র ও টিকা

১. মাও সেতুং, ছুংছিং আলাপ-আলোচনা সম্পর্কে, ১৭ই অক্টোবর, ১৯৪৫, সভাপতি মাও সেতুঙের উদ্ধৃতি, আত্মনির্ভরতা ও কঠোর সংগ্রাম, বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পিকিং, প্রথম প্রকাশ,  ১৯৬৮ পৃষ্ঠা ২২৩।

২. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] সম্পাদিত ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা গ্রন্থে প্রথম প্রকাশিত হয়। রোদ্দুরে ডট কমে প্রকাশের সময় এবং পরবর্তীকালে পরিবর্ধন করা হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!