ফ্যাসিবাদ (ইংরেজি: Fascism) হচ্ছে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট শক্তির একত্রীকৃত রূপ। ডিকশনারি ডটকম অভিধানটি “ফ্যাসিবাদকে একটি স্বৈরশাসক দ্বারা পরিচালিত একটি সরকারি ব্যবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যেখানে বিরোধীদল ও সমালোচনাকে দমন করা হয়; সমস্ত কারখানা, বাণিজ্য, ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ [regimenting] করা হয় এবং আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ ও প্রায়ই বর্ণবাদের উপর জোর দেয়া হয়।”[১]
এই সংজ্ঞার প্রথমদিকেই রাখা হয়েছে কারখানা ও বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কথা। মুসোলিনির বই The Doctrine of Fascism মূলত ফ্যাসিবাদের বিষয়বস্তু তুলে ধরে। সেই বইয়ে ২০ শতককে ফ্যাসিস্ট শতাব্দী হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং বলা হয় যে, ১৯ শতক যদি হয় মার্কসবাদ, উদারনীতি, গণতন্ত্রের তবে ২০ শতক হবে ফ্যাসিবাদের।[২]
ফ্যাসিবাদের ভিত্তি কর্পোরেট পুঁজি ও একচেটিয়া পুঁজি। ফ্যাসিবাদ কর্পোরেটদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়। সকল ফ্যাসিবাদী সরকার কর্পোরেটদের কাছ থেকে সহায়তা নেয় এবং পুঁজিবাদিদের ও ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। যেমন মুসোলিনি এই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছে যে সে গিল্ডকে ফেরত আনবে কর্পোরেট আকারে।[৩] মুসোলিনির সবচেয়ে আলোচিত উক্তিটি স্মরণযোগ্য যদিও উক্তিটি মুসোলিনির নয় এরকম একটি প্রচারণা আছে। মুসোলিনি বলতেন, “ফ্যাসিবাদকে আরো যথাযথভাবে কর্পোরেটবাদ বলা উচিত কারণ ফ্যাসিবাদ হচ্ছে রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট শক্তির একত্রীকরণ।”[৪] ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রকে একসাথে বলত কর্পোরেট রাষ্ট্র। মুসোলিনির উক্ত বই থেকে আরো একটি উদ্ধৃতি “The corporate State considers that private enterprise in the sphere of production is the most effective and useful instrument in the interest of the nation. In view of the fact that private organisation of production is a function of national concern, the organiser of the enterprise is responsible to the State for the direction given to production.”[৫]
ফ্যাসিবাদ ও তার রাষ্ট্র সংক্রান্ত মূলনীতিসমূহ উদারতাবাদ বিরোধী। যেমন উক্ত বইয়ে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে আরেকটি উক্তি হচ্ছে “Fascism is definitely and absolutely opposed to the doctrines of liberalism, both in the political and economic sphere.”(৬) এইখানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র কথাটি খেয়াল করার মতো। ফ্যাসিবাদ কেন যুদ্ধের উপর জোর দিয়েছিল? সেই তো নিপীড়িত দেশগুলোর বাজার দখল করার জন্য। মুসোলিনির যুদ্ধ সংক্রান্ত উক্তিটি দেখা যাক : “War alone keys up all human energies to their maximum tension and sets the seal of nobility on those peoples who have the courage to face it.”[৭] হিটলারকে কেন বলতে হয়েছিল, “যুদ্ধই জীবন, যুদ্ধই সর্বজনীন”,সে তো নিপীড়িত দেশসমূহের ভাগবাটোয়ারার জন্যই।
সিজার মারিও দ্য ভেচ্চির (14 November 1884 – 23 June 1959) স্বপ্ন ছিল একটি সাম্রাজ্যবাদী ইতালি তৈরি করা। এই সাম্রাজ্যবাদী ইতালির কল্পিত এলাকাসমূহ ছিলো শুধুমাত্র ইতালীয় দখলকারী (নাইস, সাওওয়ে, টিসিনো, ডালম্যাটিয়া, করফু, মাল্টা এবং কর্সিকা) ইউরোপীয় অঞ্চলের সমস্ত অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে ইতালীয় সম্প্রদায়গুলির দ্বারা বসবাসকৃত এলাকা ছিলো, তার সাথে ভেচ্চি যুক্ত করেছিল উত্তর আফ্রিকান অঞ্চলগুলিও (লিবিয়া এবং তিউনিসিয়া), যেখানে ইটালিয়ান অভিবাসী উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে “উপনিবেশ” তৈরি করেছিলেন। পরে ১৯৩৬ সালের পর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্রিক ডড্যাক্যানিজ দ্বীপপুঞ্জ প্রকল্পটিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল (এই দ্বীপের সঙ্গে জান্তে, ইথাকা ইত্যাদি) এবং প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়েছিল।
ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের শুরুতেই স্তালিন ফ্যাসিবাদের মূল ভিত্তি হিসেবে সামরিক ও প্রযুক্তির দিকটি উল্লেখ করছেন মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। স্তালিনের এই কথার কারণ হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কমিউনিস্টরা এই অভিজ্ঞতায় সিক্ত হয়েছেন, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ইউরোপীয় ‘শান্তি সর্বস্ববাদী’রা কীভাবে পিতৃভূমি রক্ষার নামে বুর্জোয়া সরকারগুলোর দালালি করে, এবং তৃতীয় আন্তর্জাতিকের বিরোধী সমাজ-গণতন্ত্রীরা কীভাবে সুবিধাবাদী হয়ে যায়। তিনি মূলত সমাজ গণতন্ত্রের বিরোধীতা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন,
“প্রথমত, এটি সত্য নয় যে ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র বুর্জোয়াদের লড়াই সংগঠন। ফ্যাসিবাদ কেবলমাত্র একটি সামরিক-প্রযুক্তিগত ধরন [category] নয়। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে বুর্জোয়াদের লড়াকু সংগঠন যা সমাজ-গণতন্ত্রের সক্রিয় সমর্থনের উপর নির্ভর করে। সমাজ-গণতন্ত্র নৈর্বক্তিকভাবে ফ্যাসিজমের মধ্যপন্থী মধ্যপন্থী পক্ষ [moderate wing]। … ফ্যাসিবাদ এই দুটি প্রধান সংগঠনের একটি অনানুষ্ঠানিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী; একটি গোষ্ঠী, যা সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ-পরবর্তী [post-war] সংকটের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েছিল এবং সর্বহারার বিপ্লবকে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছিল।[৮]
মার্কসীয় ইতিহাসবিদ ওয়াল্টার রডনির মতে, সাম্রাজ্যবাদ মানে পুঁজিবাদী বিস্তার। তিনি দাবি করেন যে তাদের প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থার আভ্যন্তরীণ যুক্তি অনুযায়ী, কাঁচামাল নিয়ন্ত্রণ, বাজার অনুসন্ধান এবং বিনিয়োগের লাভজনক ক্ষেত্রগুলি খুঁজে বের করার চেষ্টা করার জন্য পুঁজিপতিরা কম উন্নত দেশে সুযোগ সন্ধান করতে বাধ্য হয়েছিল। এই তত্ত্ব দাবি করে আধুনিক পুঁজিবাদী উদ্যোগ এবং তাদের বিদেশাগত/আউটসোর্সিং পদ্ধতিগুলি সমসংস্থাভুক্ত করতে।[৯] একচেটিয়া পুঁজির কাজের সাথে এটির পার্থক্য নেই, লেনিনের মতও তাই।
এখানে একটি বাড়তি তথ্য উল্লেখ করা খুবই উচিত হবে যে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধ বলেই উল্লেখ করতেন। অর্থাৎ দুই সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মহাযুদ্ধ। ফলে সাম্রাজ্যবাদ না হলে কোনো অর্থনীতি ফ্যাসিবাদের ভিত্তি হতে পারে না। যারা নিপীড়িত দেশের স্বৈরাচারী সরকারগুলোকে ফ্যাসিবাদী বলছেন, তারা সাম্রাজ্যবাদ ও নিপীড়িত দেশের আলাদা অর্থনীতিকে আমলে নিচ্ছেন না। সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত দেশের সরকারগুলোকে ফ্যাসিবাদ বলার অর্থ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও নিপীড়িত দেশের পার্থক্যরেখাগুলো মুছে ফেলা।
চিত্র: সিজার মারিয়া দ্য ভেচ্চি যে সাম্রাজ্যবাদী ইটালির প্রকল্প নিয়েছিলো, তাতে যে অংশটুকু অন্তর্ভুক্ত করেছিলো তা দেখান হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১. http://www.dictionary.com/browse/fascism
২. Jane Soames’s authorized 1933 translation of “The Political and Social Doctrine of Fascism” by Benito Mussolini. (Benito Mussolini, “The Political and Social Doctrine of Fascism,” first authorized translation into English by Jane Soames, published by Leonard and Virginia Woolf at the Hogarth Press, London W.C. in 1933, 26 page booklet, quote on p. 20 (Day to Day Pamphlets No. 18).
৩. পূর্বোক্ত, p. 24
৪. উক্তিটি মনে করা হয় জিওভান্নি জেনটিলের, ইংরেজি উক্তিটি এরকমের, “Fascism should more properly be called corporatism because it is the merger of state and corporate power.”
৫. পূর্বোক্ত, pp. 135-136
৬. পূর্বোক্ত, p. 32
৭. Benito Mussolini, Hemingway’s Italy: New Perspectives-তে উদ্ধৃত, Rena Sanderson (ed.), “John Robert Bittner, Anti-Fascists symbols and subtexts in A Farewell to arms” Luisiana state university press, Frist printing 2006, p 103
৮. J. V. STALIN, from , “Concerning the International Situation,” 1924.
৯. লেখকহীন ও তারিখহীন, ইউআরএল: www.differencebetween.info/difference-between-fascism-and-imperialism
রচনাকাল ৪ এপ্রিল, ২০১৮
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।
এখানে ফ্যাসিবাদ বলতে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় পরাশক্তিকে বোঝানো হয়েছে যা নিজ দেশের সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তিকে পোক্ত করে এবং এই শক্তিশালী রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর নিপীড়ন শোষণ আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।