উদারতাবাদের ইতিহাস চার শতক মানুষের দাসত্বের ইতিহাস

উদারতাবাদের বা উদারনীতিবাদের ইতিহাস (ইংরেজি: History of liberalism) হচ্ছে গত চার শতকের প্রভাবশালী পুঁজিপতিদের অধীনতা পালনের, মজুরি দাসত্বের এবং শ্রমিক-কৃষকের পরাধীন থাকার একটি বুর্জোয়া মতবাদের ইতিহাস সংক্রান্ত আলোচনা। এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলন যা গত চারশ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়েছে, যদিও একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে উল্লেখ করার জন্য “উদারতাবাদ” শব্দটির ব্যবহার উনিশ শতকের আগে ঘটেনি। উদারনীতিবাদ ঐতিহাসিকভাবে জন লক এবং মন্টেস্কুর মতো চিন্তাবিদদের চিন্তাধারার সাথে যুক্ত।

উদারনৈতিক মতবাদ ইতিহাসের বিশেষ কোনও সময়ে অথবা একক কোনও চিন্তাশীল ব্যক্তি দ্বারা উদ্ভাবিত হয়নি। উদারনৈতিক ভাবধারা দীর্ঘদিন ধরে বিকাশ লাভ করে। কারও কারও মতে প্রাচীন গ্রিসেই উদারনীতির প্রধান দুটি অঙ্গ, অর্থাৎ চিন্তার স্বাধীনতা, ও রাজনৈতিক স্বাধিকার বিরাজ করত। অবশ্য গ্রিসে মুষ্টিমেয় অভিজাত ব্যক্তিই ওইসব সুযোগসুবিধার অধিকারী ছিলো।[১]

খ্রিস্টান ধর্ম প্রবর্তনের গোড়ার দিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উদারনীতিকে সমর্থন করা হতো; তার সুদূরপ্রসারী সুফল দেখা দেয় ক্রীতদাস প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলনে এবং রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় স্বাধীনতার সমর্থনে। ক্রমে রাষ্ট্রদার্শনিকদের চিন্তায় উদারনীতির প্রত্যয়গুলি স্পষ্ট হতে শুরু করে। স্পিনোজা রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি থেকে চার্চকে পৃথক করার প্রস্তাব করেন। জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে রোমান ক্যাথলিক নিয়ন্ত্রণ থেকে প্রোটেস্ট্যান্টদের মুক্তির আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে।

ইংল্যান্ডে টমাস হবস, জন লক ও ফ্রান্সে জ্যাঁ জাকস রুশো, গিজা প্রমুখ রাষ্ট্র দার্শনিকদের মধ্যে উদারনৈতিক ভাবধারা বিকশিত হতে শুরু করে। লকের অনেক উদারবাদী ধারণা আধুনিক সময়ে অবাধে প্রচারিত র‍্যাডিকাল ধারণাগুলিতে পূর্বাভাস হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। পুস্তিকাকার রিচার্ড ওভারটন (কর্মকাল: ১৬৪০-১৬৬৪) লিখেছেন: “প্রকৃতির প্রতিটি ব্যক্তিকে প্রকৃতির দ্বারা একটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেওয়া হয়,যা কারো দ্বারা আক্রমণ বা দখল করা যায় না…; আমার অধিকার এবং স্বাধীনতার উপর অন্য কোনো মানুষের ক্ষমতা নেই এবং অন্য কোনো মানুষের উপর আমার ক্ষমতা নেই”। সাধারণত আধুনিক উদারনীতিবাদের জনক হিসাবে বিবেচিত ইংরেজ দার্শনিক জন লক এই ধারণাগুলিকে প্রথমে একটি স্বতন্ত্র আদর্শ হিসাবে একীভূত করেছিলেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উদারনৈতিক চিন্তায় প্রকারভেদ ফুটে ওঠে।[২]

ইতিহাসের ধারায় উদারনীতির উদ্ভব ঘটে সামন্তবাদী ভূস্বামীদের দাপট, অভিজাত শ্রেণীর কুক্ষিগত রাষ্ট্র এবং খ্রিস্টান যাজকদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লোকের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে। লোকে চেয়েছিল ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেফারসন মনে করতেন যে মানুষের অধিকার হস্তান্তর করা যায় না এবং তা রক্ষা করাই হলো সরকারের বড় কাজ। জন লক তাঁর সমকালীন বৈপ্লবিক যুগের মুক্তির আকুতিকে সর্বপ্রথম সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করেন। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে ও ফরাসি বিপ্লবে মানবাধিকারের সনদ রচিত হয়।

রাজনীতি বিষয়ে অনুপ সাদির একটি সাক্ষাতকার দেখুন

উনিশ শতক থেকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদার্শনিকেরা এই উদারনৈতিক ভাবধারাকে তাত্ত্বিক সূত্রে বিবৃত করেন, সমন্বিত রূপে তত্ত্বগুলি ক্রমে একটি আন্দোলনের পথে বিকশিত হয়। উনিশ শতকের সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশ ইংল্যান্ডে উদারনীতি জাতীয় দর্শন ও রাষ্ট্রীয় কর্মপন্থার মাননির্ধারক হিসেবে প্রথম মর্যাদা লাভ করে, ইংল্যান্ডে হুইগ দল পরবর্তী কালে লিবারাল অর্থাৎ উদারনৈতিক দল নামে অভিহিত হয়।

জেরেমি বেনথাম, জেমস মিল ও জন স্টুয়ার্ট মিল উদারনীতির দার্শনিক বনিয়াদ প্রস্তুত করেন। শেষোক্ত জন ছিলেন উদারনীতির প্রাগাধুনিক ও আধুনিক পর্যায়ের মধ্যবর্তী।

প্রাগাধুনিক পর্যায়ে উদারনীতির সমাজ-দর্শন ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত সংস্কারের পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি বেনথামের হিতবাদী প্রত্যয় সর্বজনের সর্বাধিক সুখবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। উদারনীতির অর্থনৈতিক ভাবনা অ্যাডাম স্মিথ-এর ‘ওয়েলথ অফ নেশনস’ থেকে উৎসারিত। তাতে অবাধ ব্যবসাবাণিজ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিধিব্যবস্থাকে সমর্থন করা হয়। উদারনীতির রাষ্ট্রদর্শনও ছিল বেনথামের হিতবাদী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেই নিরিখে বেনথাম নানা রকম সংস্কারের সুপারিশ করেন, তার অন্যতম ছিল পালামেন্টের বার্ষিক অধিবেশন, সর্বজনীন ভোটাধিকার, আমলাতন্ত্র তথা সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থাকে আইনসভার অধীনস্থ করা।

ব্যক্তিস্বাধীনতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল ও আন্দোলন গড়ে ওঠে উদারনীতির পক্ষপুটে; তাতে সংবিধানসম্মত রাষ্ট্রব্যবস্থায় সর্বসাধারণের জীবন ও ধনসম্পত্তির নিরাপত্তা আইনের দ্বারা সুরক্ষিত। আদালতে আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ এবং মতামত প্রকাশ, সংঘবদ্ধ হওয়া এবং মুদ্রণের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতাও উদারনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

বিশ শতকে দুটি চিন্তাধারা মিশে গিয়ে উদারনীতির একটি আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করে। তার একটি হলো রাজনৈতিক গণতন্ত্র আর অপরটি হল শ্রমিক আন্দোলনে সংস্কারবাদী সমাজতন্ত্র। এটি কেবল আর মধ্যবিত্তের মতাদর্শ হয়ে রইল না, সর্বসাধারণের মতাদর্শে পরিণত হলো।

উদারনৈতিক ভাবুকদের মধ্যে লক্ষ্যে পৌঁছনোর উপযোগী মাধ্যম সম্পর্কে ঐকমত্যের অভাব দেখা যায়। সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদী নানান দলের উত্থান, গণতন্ত্রী দল সমুহের উদারনৈতিক আদর্শ গ্রহণ এবং সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী (ইংরেজি: Tolalitarianism) মতাদর্শের চাপে উদারনীতির পতন সূচিত হয়। এরকম পরিস্থিতিতে বিশ শতকের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উদারনীতি পিছু হটেছিল, যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশগুলোর পতন ঘটলে উদারতাবাদ এখন মানবজাতি ধ্বংসকারী প্রধান মতবাদ।

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র:

১. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা লি; কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫০-৫১।
২. Amy H. Sturgis, “The Rise, Decline, and Reemergence of Classical Liberalism“, সংগ্রহের তারিখ ২২ এপ্রিল ২০২৩, The LockeSmith Institute, 1994, বেলমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ইউআরএল: https://www.belmont.edu/lockesmith/liberalism_essay/the_rise1.html

Leave a Comment

error: Content is protected !!