বামপন্থা পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা সংগঠন কেন মার্কসবাদী লেনিনবাদী নয়?

বামপন্থা বা বামপন্থী রাজনীতি বা বাম রাজনীতি বা বামবাদ (ইংরেজিতে: Left-wing politics) হচ্ছে সেই রাজনৈতিক অবস্থান বা কর্মকাণ্ড যা সামাজিক অসাম্য ও সামাজিক ক্রমাধিকারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামাজিক সাম্যকে গ্রহণ বা সমর্থন করে। এই রাজনীতি বিশেষভাবে জড়িত থাকে সমাজে যারা অন্যের তুলনায় কম পায় বা সুযোগহীন থাকে তাদের ব্যাপারে সদর্থক কথাবার্তা বলতে এবং এই বামপন্থী রাজনীতি পূর্বধারনা করে যে অসাম্যের অবিচার কমানো বা বিলুপ্ত করা উচিত।[১]

১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় ‘Left’ শব্দটির উৎপত্তি হয়। তখন পার্লামেন্টের ডানদিকে বসতেন শাসকদল এবং সভাপতির বাঁ পাশের আসনগুলোয় বসতেন বিরোধীদল। বাঁ দিকে বসার জন্য তাদের বলা হতো বামপন্থী বা Leftist. তখন শাসকরা ছিল রক্ষণশীল রাজন্যবর্গ। বামপন্থীরা তখন ছিলেন গরিবদের পক্ষে, শোষিতদের পক্ষে।

১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের প্রবল ধাক্কায় কেঁপে উঠলো শাসকেরা। এর পরিণতিতে প্রায় শত বছর পরে ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো ‘প্যারি কমিউন’—প্যারিসে সাম্যাকাঙ্খিদের রাজত্ব। কিন্তু এই ‘প্যারি কমিউন’ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। এই কমিউনের অনেক আগেই নেপোলিয়ন বোনাপার্তের ১৮১৫ সালে ওয়াটার লুর যুদ্ধে পরাজয় ও নির্বাসনের পরে ১৮১৬ সাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন, রাজতন্ত্রবিরোধী ও সরকারবিরোধী আন্দোলন আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘লেফটিস্ট মুভমেন্ট’ শব্দটিও জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীকালে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ‘লেফট’ শব্দটি গ্রহণ করেন। ১৮১৬ সালের পর থেকেই ‘বামপন্থা’ মূলত শাসক বিরোধিতার নীতি। এই নীতি কোনো মতাদর্শ বা দর্শন নয়।[২]

বামপন্থিরা ফরাসি বিপ্লব ও তার পরে বেশ কয়েক বছর প্রগতিশীল ও বিপ্লবী ছিলো। মূলত ১৮৪৮ সালের বিপ্লবে তাঁদের ভালো ভূমিকা ছিলো। এরপর প্যারিস কমিউন পর্যন্ত বামপন্থিরা বিপ্লবী এবং প্রগতিশীল ধরা যায়। ১৮৮৮ সালের কমিউনিস্ট ইশতেহারের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকায় ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস সমাজতন্ত্রী পরিচয়কে খারিজ করে নিজেদের কমিউনিস্ট নামটি বাছাই করেন। আরো পরে ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলোর উপরে ঘৃণা থেকে লেনিন পার্টির নামই বদলাইয়া ফেলেন। বিশ শতকে দুনিয়ার কোনো বামপন্থি পার্টি কোনো বিপ্লব বা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে পারেনি। ফলে বিশ শতকে যারাই নিজেদেরকে বামপন্থি পরিচয় দিয়েছেন তারা আসলে মার্কসবাদের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেছে, যদিও রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদের ব্যাপারে প্রগতিশীল থাকতে পেরেছেন। তবে জনগণকে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মাও সেতুং বামপন্থি মধ্যপন্থি এবং ডানপন্থি, এই তিনভাগেই ভাগ করেছেন এবং মধ্যপন্থিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ একথা বলেছেন।

ভি. আই. লেনিন বামপন্থিদের যথেষ্ট তুলোধুনা করেছেন। লেনিনের কাছে বামপন্থী শব্দটা একটি কৌতুককর গালি ছিলো; তাঁর ‘বামপন্থী কমিউনিজম শিশুসুলভ ব্যাধি’ মূলত এই ব্যাধিগ্রস্তদের বিশ্লেষণ। তিনি বামপন্থী কমিউনিস্ট বলতে বুঝিয়েছেন বিপ্লবী মার্কসবাদের নামে সুবিধাবাদী ও সংশোধনবাদী ধারার অনুসারী একদল ভুয়া সাম্যবাদীদের। এদের প্রসঙ্গে তিনি যথার্থই বলেছেন,

“‘বামপন্থী’ কমিউনিস্টরা, যারা আবার নিজেদের ‘প্রলেতারিয় কমিউনিস্ট’ বলতেও ভালোবাসে— প্রলেতারিয়ত্ব তাদের মধ্যে খুবই কম এবং পেটি বুর্জোয়াত্ব খুবই বেশি বলেই— শক্তি-অনুপাত নিয়ে, শক্তি-অনুপাতের খতিয়ান নিয়ে ভাবতে পারে না। মার্কসবাদ ও মার্কসবাদী রণকৌশলের এইটেই মূলকথা, কিন্তু সে ‘মূলকথাটা’ তারা পাশ কাটিয়ে যায় ‘সগর্ব’ সব বুলি দিয়ে।

… … … ‘বামপন্থীরা’ প্রলেতারিয় লৌহ শৃঙ্খলা ও তার প্রস্তুতির কথাটা একদম বোঝে না, শ্রেণিচ্যুত পেটিবুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীর মনোবৃত্তিতে তারা একেবারেই আচ্ছন্ন।”[৩]

বামপন্থিদের দলগুলো সারা দুনিয়াতে বিশ শতকে মূলত সুবিধাবাদী আর সংশোধনবাদীদের কাজকর্মের কেন্দ্রে পড়ে যায়। উনিশ শতকে বামপন্থিরা প্রগতিশীল হলেও বিশ শতকে তারা দেশে দেশে হয়ে পড়ে প্রতিক্রিয়াশীল। লেনিন দুটি লেখায়[৪] তাদের বুলিবাগিশী ও ছেলেমানুষির বিবরণ দিয়েছেন। বিশ ও একুশ শতকে গোটা দুনিয়ার বামপন্থীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের শত্রু হয়ে পড়ে।

বিংশ শতাব্দীতে বামপন্থা অনুসারী দলগুলো নিজেদেরকে শ্রমিক শ্রেণির পার্টি, সমাজতান্ত্রিক পার্টি, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি বলে জাহির করতে থাকে। যদিও কার্যক্ষেত্রে তারা প্রলেতারিয়েতদেরকে শ্রেণি হিসেবে শ্রেণিযুদ্ধে সংগঠিত করা থেকে সযতনে বিরত রাখে; প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েম এবং বুর্জোয়া আধিপত্যের উচ্ছেদ করা থেকে বিরত থাকে। তারা মতাদর্শিক পার্থক্যরেখাগুলো মুছে দেয়, সব কমিউনিস্টকে বামপন্থী বলতে চায় যা লেনিনবাদ ও মাওবাদ বিরোধী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বামপন্থী দলগুলো মূলত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, ছাত্র, শিক্ষিত পেশাজীবী, আমলা ও কৃষকদের মধ্যেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত রাখে। তারা মজুরি-দাসত্বের অবসান, অর্থের শাসন ও পুঁজির ক্ষমতা উৎখাত এবং পণ্যের অবসানের লক্ষ্যে কাজ করে না বরং বুর্জোয়া ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে এবং ইস্যুভিত্তিক সাময়িক সংস্কারবাদি আন্দোলনে নিজেদের আবদ্ধ রাখে। বামপন্থী দলের নেতৃত্ব যেমন প্রলেতারিয়েতের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে না তেমনি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে থাকে উদাসীন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দেশে দেশে আধুনিক সংশোধনবাদের উদ্ভব হলে বামপন্থীরা আধুনিক সংশোধনবাদের লাইনে চলে যায়। ইউরোপে আধুনিক সংশোধনবাদের ধারায় আসে ইউরোকমিউনিজম। দক্ষিণ এশিয়ায় বামপন্থীরা লেনিনবাদকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের দাস হয়ে যায় ১৯৪০-এর দশকেই যখন তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে গণযুদ্ধ ঘোষণা দেয়।

বাংলাদেশে বামপন্থা শব্দটাকে প্রচার দিয়েছে ৫ বাম দল ও বামফ্রন্ট। এরা সকলে মিলেই বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সুবিধাবাদী জায়গায় এনেছে এবং লিগেনপিকে শক্তিশালী করেছে। ভারতে এরকম এক সংশোধনবাদীর উদাহরণ হচ্ছে সিপিআই-এর এক নেতা সুধাকর রেড্ডি (জন্ম: ১৯৪২); এই গণশত্রুটি কংগ্রেসকে চুষে চুষে সারা জীবন পার করে ২০১২ সালে দলের সিপিআই-এর সাধারণ সম্পাদক হয়ে যায়। সিপিআই(এম)-এর বুড়ারাও কম কংগ্রেস-তোষণ করেনি। এই গণশত্রুরা ২০১৪ সালের ভুয়া ভোটে ধরাশায়ী হয়েছে যা জনগণের জন্য সত্যই আনন্দের। আরো আনন্দের ঘটনা ঘটবে যখন জনগণের বাহিনী দ্বারা দক্ষিণ এশিয়ার গ্রাম ও শহরগুলোতে অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে ফিনিক্স পাখির মতো গণকমিউন গড়ে উঠবে এবং কংগ্রেস, বিজেপি, বামপন্থী, ভুয়া সাম্যবাদীরা সেই পাখির ঝাপটায় ভেসে যাবে।

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ২১ মে ২০১৪, “বামপন্থী পরিচয়ধারীরা কেন মার্কসবাদী লেনিনবাদী নয়”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/politics/left-wing-politics/
২. প্রবীর ঘোষ; গোলটেবিলে সাফ জবাব; দেজ পাবলিশিং, কলকাতা; জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা- ১২০-১২১।
৩. ভি. আই. লেনিন; বামপন্থী ছেলেমানুষি ও পেটি বুর্জোয়াপনা; রচনা সংকলন, চার ভাগের ৩য় ভাগ; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; তারিখহীন; পৃষ্ঠা- ১২০-১২১।
৪. লেনিন “বামপন্থী ছেলেমানুষি ও পেটি বুর্জোয়াপনা” প্রবন্ধ এবং “কমিউনিজমে ‘বামপন্থা’র শিশু রোগ” নামক বইতে এ বিষয়ে আলোচনা করেন।

রচনাকাল ২১ মে ২০১৪, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!