নিচু মাত্রার যুদ্ধ হচ্ছে স্থানীয়ভাবে সংঘটিত প্রচলিত যুদ্ধের তীব্রতার চেয়ে কম সহিংস সংঘাত

নিচু মাত্রার যুদ্ধ বা নিচু মাত্রার সংঘাত (ইংরেজি: Low-intensity conflict; এলআইসি) হচ্ছে দুই বা ততোধিক রাষ্ট্র বা বেসরকারী গোষ্ঠীর মধ্যে, সাধারণত স্থানীয়ভাবে সংঘটিত, একটি সামরিক সংঘাত যা প্রচলিত যুদ্ধের তীব্রতার চেয়ে কম সহিংস। নিচু মাত্রার যুদ্ধ সেটার নিজস্ব নীতি বা উদ্দেশ্যগুলির সাথে রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে প্রযুক্ত করে শত্রুপক্ষকে হীনভাবে বশ্যতা স্বীকার এবং দমনে কাজে লাগায়।

এল আই সি রণনীতি ও রণকৌশল এটি একটি কম তীব্রতা বা কম সংঘর্ষের যুদ্ধ নীতি। গােটা দুনিয়ায় আধিপত্য স্থাপন ও রক্ষা করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তৈরি নিষ্ঠুরতম প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধ নীতি হলাে এলআইসি।

গেরিলা যুদ্ধ, বিপ্লবী যুদ্ধ, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, বিদ্রোহ মোকাবিলার যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ড্রাগ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মতো যাবতীয় অপ্রচলিত যুদ্ধকেই নিচু মাত্রার যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে।

অনেকে বিতর্ক করে থাকেন, প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধকে এলআইসি বলা উচিত নয়। যারা কোনো এলাকায় যুদ্ধ করতে ঢুকছে, তাদের কাছে এটা এলআইসি হলেও যারা প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ চালাচ্ছে, তাদের কাছে এটা পুরোদস্তুর যুদ্ধ। তাদের বক্তব্য, যখন দেশের যাবতীয় সম্পদ এই যুদ্ধের কাজে লাগানো হচ্ছে এবং ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে, তখন কীভাবে এই যুদ্ধ তাদের কাছে নিচু মাত্রার যুদ্ধ হতে পারে। একইভাবে যে যুদ্ধ নিচু মাত্রার যুদ্ধ হিসেবে শুরু হয়েছে, সেটা খুব দ্রুতই মাঝারি মাত্রার বা উঁচু মাত্রার যুদ্ধে পরিবর্তিত হতে পারে। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে এটা খুবই সম্ভব।

মার্কিন বিশেষজ্ঞরা মনে করে, যেহেতু উচ্চ প্রযুক্তির আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র এখন সহজলভ্য তাই এলআইসি চট করেই মাঝারি মাত্রার যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। কিন্তু সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এলআইসি-কে সকল মরশুমের যুদ্ধ বলে দাবি করা হলেও নির্যাসের দিক থেকে এটি একটি প্রতিবিপ্লবী তত্ত্ব।

নিচু মাত্রার যুদ্ধ নীতি বিকাশের ইতিহাস

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তৈরি নিষ্ঠুরতম প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতিকে এই স্তরে বিকশিত করার পেছনে রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কয়েক দশকের রক্তাক্ত ইতিহাস। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফিলিপিন্স থেকে ১৯৩০ সালে নিকারাগুয়া পর্যন্ত সে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধ চালিয়েছে। ১৯৪৬ সালে গ্রিসে ‘ট্রুম্যান থিয়ােরি’ নামে প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতি প্রয়ােগ করা হয়। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুর পশ্চাদভূমিতে ‘স্পেশাল অপারেশন’ নামে একটি অভিযান চালানাে হতাে। ১৯৪৭ সালে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে তাকে পুনর্গঠিত করে সিআইএ-র তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীকালে সিআইএ ইউরােপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার অনেকগুলি দেশে আধা-সেনার অভিযান চালিয়েছে। আইজেনহাওয়ার যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিল, তখন সে ইরান ও গুয়েতেমালার জাতীয় সরকারকে ফেলে দেয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ‘গণপ্রতিশােধ’-এর রণনীতি অনুসরণ করলেও ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে তারা ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, কিউবা এবং অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির বিপ্লবকে ঠেকাতে পারেনি। 

সােভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকানাের জন্য আমেরিকা প্রচলিত যুদ্ধের ওপর নির্ভর করছিল। কিন্তু রাজনৈতিক-সামরিক সংগ্রাম হিসেবে চলতে থাকা জাতিসত্তার আন্দোলনগুলিকে তারা প্রচলিত যুদ্ধের থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি ১২৪ নম্বর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাকশন মেমােরেন্ডাম-এ সিলমােহর দিল। এর ফলে সেনাবাহিনীতে বিশেষ বাহিনীর পরিমাণ ব্যাপকভাবে বাড়ানাে হলাে এবং তাদের প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধে প্রশিক্ষিত করা হলাে।

বিদেশ মন্ত্রক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, সিআইএ এবং ইউএসআইএ-র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক অভিযান সংক্রান্ত দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয় রক্ষার জন্য একটি কমিটি তৈরি করা হলাে। মার্কিন প্রতিপ্লিবী যুদ্ধের রণনীতির প্রথম পরীক্ষাগার ছিল ইন্দোচীন।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের নেতিবাচক ফলকে মাথায় রেখে জেনারেল ম্যাক্সওয়েল টেলর ১৯৬৪ সালে ম্যাকনামারাকে একটি গােপন রিপাের্ট লেখে, “ভিয়েতনামে আমাদের ভবিষ্যৎ এবং আমেরিকার জনযুদ্ধ মােকাবিলার ক্ষমতা বার্মা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান ও ফিলিপিন্সকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে”।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল। এক সময়, যে কোনও মূল্যে ফল পাওয়ার জন্য তারা প্রায় ৫ লক্ষ মার্কিন সৈন্যকে জড়াে করেছিল। কিন্তু প্রতিদিন ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনাদের কফিনবন্দি দেহ আসতে থাকায় আমেরিকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরােধী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত দস্তুর মতাে পরাজিত হয়ে ১৯৭৫ সালে মার্কিন সেনারা দেশে ফেরে। জনগণের ক্ষোভ এবং যুদ্ধবিরােধী আন্দোলনের জেরে আইনে কিছু পরিবর্তন করা হয়। ঠিক হয় এরপর থেকে কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট অন্য কোনও দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করতে পারবে না, এমনকি সিআইএ-কেও কংগ্রেসের তত্ত্বাবধানে কাজ করতে হবে। পেন্টাগনের বিশেষ অভিযান বাহিনীর বাজেট কমিয়ে দেওয়া হয়। সিআইএ-র আধা সামরিক কার্যকলাপগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতি নিয়ে আলােচনা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং মনােযােগ কেন্দ্রীভূত করা হয় ইউরােপে প্রচলিত যুদ্ধের রণনীতিতে।

১৯৮০-র দশকে ফের প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধ নিয়ে জোর কদমে আলােচনা ও চর্চা শুরু হয়। পরামর্শ আসতে থাকলাে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ জিততে হলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির বিপ্লবী যুদ্ধগুলিকে দমন করতে আমেরিকা যে রণনীতি ও রণকৌশল ব্যবহার করে থাকে, তা পুরােপুরি পাল্টে ফেলা দরকার।

১৯৮৩ সালে পাের্ট ম্যাক নায়ারে জাতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘মার্কিন রণনীতির বিশেষ কার্যকলাপ’ শীর্ষক এক সম্মেলন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, মার্কিন অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাধাগুলি দূর করার জন্য সম্পূর্ণ আলাদা নতুন পথ অনুসরণ করার প্রয়োজন ছিল।

মার্কিনীদের মনে তখনও ভিয়েতনাম যুদ্ধের আতঙ্ক তীব্রভাবে গেড়ে বসেছিল। পুরনাে পদ্ধতিতে কোনও দেশে ঢুকে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ব্যাপক বিরােধিতা ছিল। এই অবস্থায় মার্কিন জনতার হৃদয় ও মন জয় করার জন্য, জনগণের সবচেয়ে নিচের অংশে রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে, তার ভিত্তিতে এলআইসি-র নীতিগুলি প্রণয়ন করা হলাে। ওরা যে নীতি অনুসরণ করেছিল তা হলাে, তুমি যদি বিশ্বাসের লড়াইটা জিততে পারাে, তাহলে তুমি সব জায়গায় জিততে পারবে। রিগান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এলআইসি-র নীতিগুলি প্রণয়নের জন্য যথেষ্ট সহায়তা মিললাে এবং প্রক্রিয়াটির গতি বাড়তে থাকলাে। 

এলআইসি-র তাত্ত্বিক সি কারকেশিয়ান এইড ইউনিভাসিটি রিভিউতে বলেন, ‘আমেরিকার প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধের অভিমুখ, এই যুদ্ধের পরিস্থিতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলির চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। বিপ্লবকে পরাজিত করার জন্য যে নীতি নিয়ে চলতে হবে, তাহলাে, আন্দোলনের নেতৃত্বকে চিহ্নিত করে অপহরণ কর, তারপর তাকে তীব্র অত্যাচার করে মেরে ফেল। যদি তুমি মনে কর যে, প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধে মার্কিনী অংশগ্রহণ ঠিক এবং প্রয়োজনীয়, তাহলে এই পদ্ধতিটা রাজনৈতিক নেতারা এবং জনগণ ঠিকই বুঝতে পারবে। এলআইসি-র রণনীতি ও রণকৌশল গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের সীমানার মধ্যে আটকে থাকে না। বিপ্লবী যুদ্ধই হােক বা প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধ, যুদ্ধের নীতি এবং মূল্যবােধ দুটিই তৈরি হয় যুদ্ধে সাফল্য অর্জনের জন্য। অস্তিত্ব রক্ষা করাই হলাে সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি। এলআইসি কতদূর নিষ্ঠুর হতে পারে, এই কথা থেকেই আমরা তার পরিমাপ করতে পারি।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির বিপ্লবী যুদ্ধগুলিকে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকা তার জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার কাঠামাে পরিবর্তন, পুরাে ব্যবস্থাটাকে নতুন করে ভাবা এবং আরও বেশি করে সশস্ত্র হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাে। ১৯৮৬ সালে ওয়াশিংটনের পাের্ট লেসলি ডে ম্যাক নায়ারে নিচু মাত্রার যুদ্ধ বিষয়ক প্রথম সম্মেলনটি উদ্বোধন করেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওয়েনবার্গার। একই মাসে সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীতে নিচু মাত্রার সংঘর্ষ কেন্দ্র তৈরি হয়। এই সংক্রান্ত চূড়ান্ত রিপাের্ট তৈরির জন্য ১৯৮৬ সালে নিচু মাত্রার সংঘর্ষ বিষয়ক একটি যৌথ প্রকল্প তৈরি করা হয়। এই প্রকল্প সেই বছরেই, অর্থাৎ, ১৯৮৬ সালেই দুই খণ্ডে হাজার পাতার রিপাের্ট দাখিল করে। সেই রিপাের্টে এলআইসি তত্ত্বের ধারণা, রণনীতি, নির্দেশক নীতিমালা এবং প্রয়ােগের বিষয়গুলি বিস্তৃতভাবে বলা হয়।

এলআইসি-র রণনীতি রূপায়ন করার জন্য রিগান প্রশাসন দ্রুত তার বিশেষ অভিযান বাহিনীর সংখ্যা ১০০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় সেনাবাহিনীতে গ্রিন বেরেস, নৌ বাহিনীতে সিস এবং অন্যান্য কামান্ডাে বাহিনী। গােপন অভিযানের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের অধীনে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল নর্থের নেতৃত্বে ‘ডেল্টা ফোর্স’, ১৬০তম আর্মি এভিয়েশন টাস্ক ফোর্স (নাইট স্টেকার্স) এবং সিআইএ-র অধীনে আধা সামরিক বাহিনীর পরিমাণ বাড়ানাে হয়। অন্য দেশে ঢুকে যুদ্ধ করার প্রয়ােজন বেড়ে যাওয়ায় ১৯৮৪ সালে ৪টি বিশেষ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন গঠন করা হয়।

রিগানের শাসনের মধ্যেই এলআইসি-কে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে, নিচু মাত্রার যুদ্ধের জন্য বিশেষ অভিযানের সংযুক্ত কমান্ড এবং বোর্ড গঠিত হয়। একইভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট-কে এলআইসি সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়ার জন্য একজন বিশেষ আধিকারিক নিয়ােগ করা হয়। ওই বছরেই রিগান আরেকটি গােপন জাতীয় নিরাপত্তা সিদ্ধান্ত নির্দেশিকা (NSDD)-য় স্বাক্ষর করেন। এতে এলআইসি বিষয়ক সংযুক্ত জাতীয় রণনীতির পথ নির্দেশ দেওয়া ছিল। এই প্রক্রিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিকভাবে এলআইসি-র বিকাশ ঘটায়।

নিচু মাত্রার যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সারা পৃথিবীতে আধিপত্য চালানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই নিচু মাত্রার যুদ্ধের নীতি সূত্রায়িত করেছে। প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধ দিয়ে শুরু করে এটি নানা রকম রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যকলাপ চালিয়ে থাকে। এই কার্যকলাপগুলি প্রকাশ্য বা গোপন হতে পারে। মার্কিন শাসক এবং অন্যান্য পরিকল্পনাকারীর কাছে এলআইসি শুধুই একটা বিশেষ ধরনের যুদ্ধ নয়। এটা শুধুই আমেরিকার যাবতীয় সামরিক সম্পদ ব্যবহার করে তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবী যুদ্ধকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া নয়, বরং এই বিশাল মাপের যুদ্ধের জন্য অনেক বেশি দৃঢ়তার সংগে বাহিনীকে নিযুক্ত করার নীতি।

আরো পড়ুন:  যুদ্ধ ও বিপ্লব

এলআইসি-র ভিত্তি হলাে প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতি। কিউবার বিপ্লব এবং ১৯৬০ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার পর, দক্ষিণ আমেরিকার জন্য যে আর্থিক সাহায্য, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ এবং নিরাপত্তা অভিযানগুলি সূত্রায়িত হয়, সেগুলিই প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতিতে সংযােজিত করে এলআইসি-র সূত্রায়ন করা হয়। 

মার্কিন সামরিক বিষয়ক সচিব জন ইয়ার্ম বলেন, “বিপ্লবের উত্থানের কারণগুলি সামরিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়”। অতএব, এর অর্থ হলাে অপ্রচলিত, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং বলপ্রেয়োগের মাধ্যমে নিচু মাত্রার পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চালানাে। একে কোনও একটি দেশের সামরিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে চালানাে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হিসেবেই বুঝতে হবে। যদিও ওরা এলআইসির নীতিতে লিখেছে যে শুরুতে পুতুল সরকারের সেনাবাহিনীকেই কেবল নিয়ােগ করা হবে এবং তাকে যাবতীয় সামরিক, প্রযুক্তিগত সাহায্য, নতুন ধরনের যুদ্ধকলার প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেওয়া হবে এবং যুদ্ধ বিষয়ক পরামর্শদাতার দল গঠন করে দেওয়া হবে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতেই হবে যে প্রয়োজনে ওরা সরাসরি তীব্র আক্রমণ নামিয়ে আনবে। 

এলআইসি রণনীতির রূপায়ন হলাে চারটি বল নিয়ে খেলা দেখানাে একজন জাগলারের মতাে। প্রথমে সামরিক বলটিকে হাওয়ায় ছুঁড়ে দিতে হবে, তারপর একের পর এক সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বলগুলি ছুঁড়ে দেওয়া হবে। যখন সবকটি বল শূন্যে রয়েছে, তখন প্রত্যেকটির গুরুত্বই সমান। চারটি বলকে সমান মনােযােগ দিয়ে ছুঁড়তে পারলেই খেলাটি সফল হবে। এলআইসি-র ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই।

এলআইসি-র মাধ্যমে আধা উপনিবেশের জমি দখল করাটা সাম্রাজ্যবাদীদের লক্ষ নয়। তাদের লক্ষ হলাে, স্থানীয় দালাল শাসকদের পেছনে থেকে সেখানকার বিপ্লবী আন্দোলনগুলিকে দমন করা, সংস্কারমূলক কাজের সাহায্যে সেদেশের জনগণের হৃদয় ও মন জয় করা। সাম্রাজ্যবাদীদের যদি বিপদে না পড়তে হয়, তাহলে তাদের যাবতীয় শ্রেণি ও জাতীয়তাবাদী যুদ্ধকে দমন করতেই হবে। এর জন্য যতদূর যাওয়া সম্ভব, তারা যাবে।

সাম্রাজ্যবাদীদের পােষা কুত্তা, পিছিয়ে থাকা দেশগুলির বুর্জোয়া ও সামন্ত শ্রেণিগুলি এলআইসি রণনীতির প্রয়োজনীয়তা অনুসারে রাষ্ট্রযন্ত্রে কিছু পরিবর্তন সাধন করে। এলআইসি-র বৈশিষ্ট্যগুলি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য তৈরি হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা যেসব দেশে এলআইসি প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেইসব দেশের শাসকদের দ্বারা সেখানকার পরিস্থিতি অনুযায়ী রূপায়ন করা হয়ে থাকে । সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়ে থাকে। 

এলআইসি-র লক্ষ হলাে, গােটা দুনিয়ার যাবতীয় ন্যায় যুদ্ধ, যেমন — জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, বিপ্লবী সংগ্রাম, প্রতিরােধ সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করা। সুতরাং আমরা বলতে পারি, এলআইসি হলাে সাম্রাজ্যবাদীদের নিষ্ঠুরতম প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধ।

এল আই সি-র রণনীতি

এলআইসি হলাে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, বিপ্লবী যুদ্ধের মতাে দুনিয়ার যাবতীয় ন্যায় যুদ্ধকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সূত্রায়িত রাজনৈতিক-সামরিক যুদ্ধের রণনীতি। এটি অন্যায় যুদ্ধের রণনীতি। এটি নিষ্ঠুরতম প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতি।

যেহেতু দুনিয়া জুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের আধিপত্য চালানাের লক্ষেই এই রণনীতি তৈরি, তাই এটি তাদের স্বার্থই রক্ষা করে। যেহেতু শেষ বিচারে এটি সাম্রাজ্যবাদীদের শােষণ এবং অত্যাচার চালিয়ে যেতে সাহায্য করে, তাই অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশ এবং তৃতীয় বিশ্বের শাসক শ্রেণিগুলিও এর নীতিগুলি কাজে লাগিয়ে থাকে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সেনা, আধা সেনা, প্রশাসন এবং অন্যান্য দেশের শােষক শ্রেণিগুলির সেনা, আধা সেনা, শাসনের উপলব্ধির জন্য এবং এলআইসি-র নীতি অনুযায়ী যথাযথ ভাবে অভিযান চালানাের জন্য এলআইসি-র একটি নির্দেশিকা বা ম্যানুয়াল রচনা করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লব্ধ অভিজ্ঞতাকে তারা এই ম্যানুয়ালে সংযুক্ত করেছে। ১৯৮১ সালের ম্যানুয়াল এবং ১৯৯৬ সালের ম্যানুয়ালের মধ্যে অনেক তফাৎ। পার্থক্য যাই থাকুক, শুধুমাত্র নির্দেশিকা বা ম্যানুয়াল পড়ে আমরা কখনই এলআইসি-র রণনীতিকে পুরােপুরি বুঝতে পারবাে না। কারণ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের প্রকৃত লক্ষ এবং আসল রণনীতি সেগুলিতে লেখেনি। কিছু লেখা থাকলেও সেগুলি আংশিক বা লােক ঠকানাে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওরা লিখেছে কোনও দেশে বিপ্লব শুরু হওয়ার কারণটা বিশ্লেষণ করতে হবে, অর্থাৎ সেটা সাম্রাজ্যবাদ, আগ্রাসন, শােষণ নাকি অত্যাচার সেটা বুঝে নিয়ে তার সমাধান করতে হবে। শােষকরা কি শােষণের শেষ করবে? আগ্রাসনকারীরা কি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? অর্থাৎ এটা পরিষ্কার যে ওরা যা বিশ্লেষণই করুক, তার লক্ষ হলাে, সমস্যার গুরুত্ব বিচার করে কী ধরনের সংস্কারমূলক কাজ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা যাবে, তার হিসেব কষা।

এমনকি ওদের আন্তর্জাতিক আইনের নীতিগুলি অনুসরণ করতে বলাও একইরকম হাস্যকর। এটা শয়তানের বেদ পাঠের মতাে। সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্যই এই নীতিগুলি লেখা হয়েছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের মতাে অন্য কোনও দেশ এই নীতিগুলিকে অমান্য করেনি। আন্তর্জাতিক আইনের কোন নীতি অনুসারে আবু গারাইবের কারাগার তৈরি করা হয়েছে? আন্তর্জাতিক আইনের কোন নীতি অনুসরণ করে সিআইএ একগাদা গােপন কারাগার ও কনসেনট্রেশন ক্যাম্প চালায়? সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ বিরােধিতা করা সত্ত্বেও আমেরিকা কেন ইরাক আক্রমণ করলাে? এগুলি লিখতে থাকলে তালিকাটা দিয়ে গােটা একটি বই হয়ে যাবে।

অর্থাৎ, এলআইসি-র রণনীতি কেবল মাত্র এলআইসি-র ম্যানুয়াল দিয়ে বােঝা যাবে না। দুনিয়া জুড়ে সাম্রাজ্যবাদীরা যে শােষণ এবং অত্যাচার চালাচ্ছে, তার দিকে তাকালেই আমরা এটা বুঝতে পারবাে। আগ্রাসী যুদ্ধ, অনধিকার প্রবেশ এবং প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধের দিকে তাকালেই আমরা একে উপলব্ধি করতে পারবাে। উদারিকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়ন বা এলপিজি-র নীতিগুলি রূপায়ণ করার জন্য ওরা যেসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক অভিযান বা পদক্ষেপগুলি করছে, সেগুলির দিকে তাকালেই এলআইসি-কে বােঝা যাবে। এক কথায় বলতে গেলে, সাম্রাজ্যবাদকে বােঝার মধ্য দিয়েই এলআইসি-কে আমরা পরিষ্কার ভাবে উপলব্ধি করতে পারবাে।

পৃথিবীর যে কোনও দুটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক পরিস্থিতি এক নয়। প্রতিটি দেশেরই নিজস্বতা রয়েছে। একই ভাবে কোনো একটি দেশেরও বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি আলাদা আলাদা। তাই সেই সব দেশের শােষক শ্রেণিগুলি সাম্রাজ্যবাদীদের পথ নির্দেশের অধীনে তাদের দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি অনুযায়ী কীভাবে এলআইসি-র রণনীতি রূপায়ন করা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। তারা এলআইসি-র সাধারণ নীতিগুলিকে সেখানকার নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করে। অর্থাৎ, মার্কিন এলআইসি ম্যানুয়ালে যেভাবে লেখা আছে, সেই ভাবেই এলআইসি-র রণনীতি ও রণকৌশল সম্পর্কে আলােচনা করার আমাদের কোনও প্রয়োজন নেই। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদের এলআইসি-র সাধারণ নীতিগুলিকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। বিপরীতে আমাদের বিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল তৈরি করতে হবে।

এলআইসি-র লক্ষ্য:

ন্যায় যুদ্ধগুলিকে পরাজিত করা এবং সাম্রাজ্যবাদীদের অন্যায় যুদ্ধগুলিকে জয়ী করা, সাম্রাজ্যবাদীদের রাজনৈতিক শাসনকে স্থায়িত্ব দেয়াই হলাে এলআইসি-র লক্ষ। যেহেতু জনযুদ্ধের নীতিকে বিরােধিতা করার জন্যই এই যুদ্ধের রণনীতি তৈরি হয়েছে, তাই এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ :

১) সমন্বয়ের মাধ্যমে সামরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালানাে।
২) জনগণের হৃদয় ও মন জয় করা। 
৩) গােয়েন্দা বিভাগকে রণনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা।
৪) বিশেষ বাহিনী। 

কোনো যুদ্ধের জয় নির্ধারিত হয় সেই যুদ্ধের রণনীতির যথার্থতার দ্বারা। তাই জনযুদ্ধ শূন্য থেকে শুরু হয়ে একের পর এক সাফল্য অর্জন করে ও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জয়ী হয়। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদীরা যাবতীয় সাজসরঞ্জাম নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে, তারপর একে একে সব হারায় এবং শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়।

কখন এটা সম্ভব? আমাদের সম্পূর্ণভাবে সর্বহারার জনযুদ্ধের রণনীতিকে বুঝতে হবে এবং যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এর জন্য সমাজ ব্যবস্থার সঠিক বিশ্লেষণ করতে হবে। শত্রুর শ্রেণি চরিত্র বুঝতে হবে। সর্বহারার মতাদর্শগত, রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক লাইনের বিপরীতে শত্রু কী ধরনের রণনীতির বিকাশ ঘটাচ্ছে, তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। আমরা সর্বদাই এই নীতির অধ্যয়ন করবাে এবং সেই অনুযায়ী আমাদের শক্তিকে ব্যবহার করবাে। একমাত্র এই পদ্ধতিতেই আমরা জনযুদ্ধের নীতিকে ঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে পারবাে।

শুধুমাত্র সাধারণ নীতিগুলিকে জানলে আমরা শ্রেণি সংগ্রামকে এক পা-ও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবাে না। সেগুলিকে আমাদের বাস্তব পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করতে হবে। শুধু তাই নয়, এই পথপ্রদর্শক নীতিগুলিকে উপলব্ধির জন্য আমাদের শক্তপােক্ত প্রণালী ও প্রয়োজনীয় কাঠামাে গড়ে তুলতে হবে। আমরা যে রাজনীতির পক্ষে রয়েছি এবং যে লক্ষ আমাদের লেখা ও বক্তব্যে প্রচার করি সেগুলি যদি শক্তিশালী সংগঠন ও সর্বহারার ইস্পাত দৃঢ় মনােভাব নিয়ে প্রয়োগ করতে পারি তাহলে আমরা চমৎকার ফল পাবাে।

আরো পড়ুন:  আমাদের বিপ্লবের কথা

শত্রু কোন পরিবেশে এলআইসি-র কোন নীতি প্রয়োগ করছে, তা যদি আমরা ঠিক সময়ে নজরে রাখি এবং তার প্রভাব গভীরভাবে অধ্যয়ন করে আমরা যদি তার বিপরীত রণনীতি সূত্রায়িত করতে পারি, তাহলে আমরা এলআইসি-কে পরাজিত করতে পারবাে। যখন এই নজরদারিতে খামতি থাকে তখন বিপ্লবী আন্দোলন ক্ষতির মুখােমুখি হয়, কখনও তা সাময়িক পরাজয়েরও কারণ হয়।

উদাহরণ হিসেবে জনগণের “হৃদয় ও মন জয় করা”-র বিষয়ে আলােচনা করা যেতে পারে। এটা ঘটনা, শাসক শ্রেণি সমগ্র বা অধিকাংশ জনগণের হৃদয় ও মন জয় করতে পারে না। এটা সম্ভব হবে যখন তারা শােষণ ও দমন বন্ধ করবে। তাহলে তারা কাদের হৃদয় ও মন জয় করতে চায়? তারা জনগণের একটা অংশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থ রক্ষা করে এবং এই অংশকেই তারা তাদের শােষণ ও দমনের সামাজিক ভিত্তি হিসাবে ব্যবহার করে। ঠিক সময়ে এটাকে লক্ষ না করলে এবং মােকাবিলা করতে না পারলে, সাম্রাজ্যবাদীরা জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে তােলে এবং তাকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করতে পারে। আমরা যদি সতর্ক থাকি তাহলে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবাে। সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে ‘বাঘের চামড়া গায়ে গাধা’ গল্পের মতাে। জনগণ যদি বুঝতে পারে সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে গাধার মতাে তাহলে তাকে সহজেই পরাজিত করতে পারবে। কিন্তু যদি আমরা সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ উন্মােচন না করতে পারি তাহলে সাম্রাজ্যবাদ চিরদিন বাঘের ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকবে। এবং জনগণকে সন্ত্রস্ত করবে।

এলআইসি-র রণকৌশল

সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী মুৎসুদ্দি শাসকরা যখন যাবতীয় সাজসরঞ্জাম নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে তখন তারা রণকৌশলগতভাবে শক্তিশালী। এই কারণে কমরেড মাও আমাদের শিখিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদ রণনীতিগত ভাবে কাগুজে বাঘ, কিন্তু রণকৌশলগতভাবে তাকে দেখে মনে হয় সত্যিকারের বাঘ। যেহেতু নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্দিষ্ট রণকৌশল তৈরি করা হয়, তাই এখানে আমরা কয়েকটি মাত্র সাধারণ রণকৌশলের উল্লেখ করছি। যদি আমরা নিম্নলিখিত ভাবে রণকৌশলগুলিকে বিভক্ত করি, তাহলে বিষয়টা অধ্যয়ন করা সুবিধাজনক হবে:

১) রাজনৈতিক রণকৌশল
২) সাংগঠনিক রণকৌশল
৩) সামরিক রণকৌশল

১) রাজনৈতিক রণকৌশল:

বিরােধী রাজনৈতিক আন্দোলন ইত্যাদিকে উচ্ছেদ করার জন্য মতাদর্শগত আক্রমণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের রণকৌশল নেওয়া হয়ে থাকে।

ক) মতাদর্শগত আক্রমণ
খ) অপপ্রচার 
গ) জনগণের ঐক্য ধ্বংস করা 
ঘ) প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সংহত করা 
ঙ) কালা কানুন তৈরি ও বিচারব্যবস্থাকে প্রস্তুত করা 
চ) রাজনৈতিক দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করা (শাসক শ্রেণিগুলির ঐক্য)
ছ) সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরি করা।

ক) মতাদর্শগত আক্রমণ: মার্কসবাদ সেকেলে হয়ে গেছে এবং পুঁজিবাদ চিরস্থায়ী বলে প্রচার, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলির সঙ্গে ঐক্য করার জন্য এই আন্দোলনগুলিকে তােষামােদ করা, এই সবই মতাদর্শগত আক্রমণের মধ্যে পড়ে।

খ) অপপ্রচার: ওদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মুদ্রণ মাধ্যম ও বৈদ্যুতিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে বিপ্লবীদের দিকে কাদা ছোড়া। ওরা বিপ্লবীদের বিভিন্ন তকমা দিয়ে অপপ্রচার করে, যেমন উন্নয়ন বিরােধী, সন্ত্রাসবাদী, ধ্বংসাত্মক শক্তি, হিংস্র শক্তি, জঙ্গি, ডাকাত ইত্যাদি। এছাড়া নিজেদের কাজকর্ম ও উন্নয়ন পরিকল্পনার ঢালাও প্রচার করে। 

গ) জনগণের ঐক্য ধ্বংস করা: জনগণের ঐক্য ভাঙার জন্য তারা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে। জনগণকে গ্রামস্তর থেকে শুরু করে দেশীয় স্তর পর্যন্ত জাতীয়তা, বর্ণ, শ্রেণি ও ধর্ম দিয়ে বিভক্ত করে। ওদের সংস্কার থেকে উপকৃত ব্যক্তিদের সমগ্র জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। জনগণের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে বৈরীমূলক স্তরে নিয়ে যায়, যাতে জনগণ নিজেদের মধ্যে লড়াই করে একে অপরকে হত্যা করে।  

ঘ) প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সংহত করা: প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামােকে সুদৃঢ় করা হয়। কারণ দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামাের রাষ্ট্র এলআইসি প্রয়ােগ করতে পারে না। তাছাড়া সংস্কার চালু রাখা, জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা, বিপ্লবী প্রচার ও সংগঠনের মুখােমুখি হওয়ার জন্য শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামাের প্রয়ােজন। তাই এলআইসি-র রণনীতি রূপায়ণের জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের রাষ্ট্রীয় কাঠামােকে সুদৃঢ় করা জরুরি। 

ঙ) কালা কানুন তৈরি ও বিচারব্যবস্থাকে প্রস্তুত করা: দানবীয় কালা কানুন তৈরি করে বিপ্লবের প্রসার রােধ করার চেষ্টা করা হয়, তাছাড়া এই আইনগুলির দ্বারা বিপ্লবের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্নদের এবং গণসংগঠনের কর্মীদের আটক করা হয়। একই ভাবে, বিচারকরা এলআইসি-র পক্ষ নেয় এবং বিপ্লবীদের কঠোর সাজা দেয়, তারা এমন ভাবে রায় দেয় যাতে তা শাসক শ্রেণির পক্ষে যায় । ওরা প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সঙ্গেই ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট তৈরি করে এবং দ্রুত শাস্তিদানের ব্যবস্থা করে। প্রকাশ্য বিচার ব্যবস্থার সাথে গােপন বিচারের ব্যবস্থা করে ।

চ) শাসক শ্রেণিগুলির মধ্যে ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা: শাসক শ্রেণিগুলির মধ্যে অন্য বিষয়ে বিরােধিতা থাকলেও, তারা বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে কথা ও কাজে ঐক্যবদ্ধ । সাম্রাজ্যবাদীরা শাসক শ্রেণিগুলির মধ্যে বিপ্লবী আন্দোলনের বিরুদ্ধে যে কোন উপায়ে একতা আনার চেষ্টা করে। আমরা দেখি, কোনও বড় ঘটনা ঘটলে শাসক শ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলি সেই বিষয়ে এই ধরনের বক্তব্য রাখে, “আমাদের অবশ্যই এই বিষয়ে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে।”

ছ) সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে: বুর্জোয়া সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়া ও বিপ্লবী সংস্কৃতি ও মূল্যবােধ থেকে জনগণকে সরিয়ে আনার জন্য যাবতীয় উপায়গুলি ব্যবহার করা হয়।

এখানে উল্লিখিত কৌশলগুলি ছাড়াও এলআইসি-র অন্যান্য কৌশলও রয়েছে। এখানে যেগুলি উল্লেখ করা হলাে সেগুলি প্রায় সব দেশেই সাধারণ ভাবে প্রয়ােগ করা হয়।

২) সাংগঠনিক কৌশল:

কোন নীতি প্রয়ােগ করতে হলে সুদৃঢ় সংগঠন লাগে। সংগঠন ব্যতীত নীতি নেহাতই কাগুজে বিষয়। উঁচু স্তরের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটি থেকে নিচু স্তর পর্যন্ত নির্দিষ্ট কাঠামাে থাকলেই কেবল মাত্র নীতিগুলিকে প্রয়ােগে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সাধারণত নিম্নলিখিত সাংগঠনিক পরিবর্তনগুলি করা হয়ে থাকে।

ক) এলআইসি নীতি নির্ধারক সাংগঠনিক কাঠামাে
খ) এলআইসি-র রণকৌশল প্রয়ােগের কাঠামাে।
গ) সমন্বয়কারী কাঠামাে
ঘ) বিকাশসাধন ও সংগঠনের নামে বিশেষ বাজেট
ঙ) গােপন বাজেট

ক) এলআইসি নীতি নির্ধারক সাংগঠনিক কাঠামাে : রাষ্ট্রপতি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী (সচিব), বিদেশ মন্ত্রী (সচিব) এবং এলআইসি-র জন্য নিযুক্ত বিশেষ অধিকারিককে নিয়ে আমেরিকায় এটি গঠিত হয়েছে। এলআইসি-র নীতি নির্ধারক কমিটিগুলি রাষ্ট্রীয় আধিকারিকদের অধীনে থাকতে হবে, এটা এলআইসি-র রণনীতির অংশ। আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় স্তরে প্রধানমন্ত্রী এবং রাজ্য স্তরে মুখ্যমন্ত্রী এই কাঠামােগুলিকে নেতৃত্ব দেয়।

খ) এলআইসি-র রণকৌশল প্রয়ােগের কাঠামাে : এলআইসি-র রণকৌশল প্রয়ােগের প্রাথমিক দায়িত্ব থাকে গােয়েন্দা বিভাগগুলির উপর। মনে করা হয় যে, সাধারণ সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের তুলনায় পুলিশ বিভাগ থেকে বিশেষ গােয়েন্দা বাহিনী তৈরি করলে সেই বাহিনী বেশি কার্যকর হয়। এই নীতি সব দেশেই প্রয়ােগ করা হয়। এলআইসি নীতি প্রয়ােগের জন্য সামরিক ও কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থায় বিশেষ বিভাগ তৈরি করা হয়। | আমলারা এই সব বিভাগের মাথায় থাকে। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং তা প্রয়ােগের স্বাধীনতা দেওয়া হয়। সামরিক, আধাসামরিক এবং বিশেষ বাহিনী থেকে আধিকারিকরা এই কমিটির সদস্য হয়।

গ) সমন্বয়কারী কাঠামাে : বিভিন্ন ধরনের সমন্বয়কারী কমিটি গঠন করা হয়। যেমন- বিভিন্ন দফতরের মধ্যে, একটি দফতরের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে, দেশের বিভিন্ন সংগঠন ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়কারী কমিটি গঠিত হয় একটি দেশের বিভিন্ন গােয়েন্দা সংস্থার মধ্যে। এই রকম কমিটি গঠিত হয় একটি দেশের গােয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির গােয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ের জন্য। গােয়েন্দা বিভাগ ও বিশেষ বাহিনীর মধ্যে । বিভিন্ন দফতরের মধ্যেও এই ধরনের কমিটি তৈরি হয়। যেমন- প্রশাসন, বিচারবিভাগ, গােয়েন্দাবিভাগ এবং এলআইসি-তে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে।

যে সব দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে আছে সেখানে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে সমন্বয় একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন রাজ্যে শাসন চালায় তখন সমস্যা তৈরি হয়। তাই সমন্বয়কারী কমিটি গঠন করে এলআইসি-কে যথাযথ ভাবে প্রয়ােগ করা হয়।

ঘ) বিকাশসাধন ও সংগঠনের নামে বিশেষ বাজেট : বিকাশসাধন ও সংগঠনের জন্য বিশেষ ব্যয় বরাদ্দ করা হয়। সমাজ কল্যাণের জন্য যে ব্যয় বরাদ্দ করা হয় তা এই কাজে লাগানাে হয় । এলআইসি-র জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় পরিবহণ, যােগাযােগ এবং অন্যান্য পরিকাঠামাে তৈরি করা হয়।

ঙ) গােপন বাজেট : এলআইসি পরিচালনার জন্য বিভিন্ন গােপন কার্যকলাপ চালাতে খরচ করতে হয়। অস্ত্র কেনা ও যেসব অন্যান্য গােপন কাজের খরচের বাজেট আইনি অর্থে অনুমােদন দেওয়া যায় না, সেগুলিতে গােপন বাজেটের মাধ্যমে টাকা যােগান হয়। এই গােপন বাজেট প্রকাশ্য বাজেটের কয়েকগুণ বেশি হতে পারে। এর অন্যতম সুবিধা হল এই বাজেটে কোন সংসদীয় বা বিচারবিভাগীয় নজরদারি থাকে না।

৩) সামরিক কৌশল:

সামরিক কৌশল প্রধানত দুই ধরনের

১. প্রকাশ্য কার্যকলাপ
২. গােপন কার্যকলাপ

১) প্রকাশ্য কার্যকলাপ:

নিম্নলিখিত কার্যকলাপগুলি হলো প্রকাশ্য সামরিক কার্যকলাপ
ক) বিশেষ বাহিনী তৈরি ও তাদের প্রশিক্ষিত করা
খ) আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার
গ) সুরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা
ঘ) জনগণ থেকে গেরিলাদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা
ঙ) যৌথ অভিযান
চ) নিশ্চিহ্নকরণ অভিযান,
ছ) গেরিলাদের পুনঃপ্রবেশ বন্ধ করার অভিযান

আরো পড়ুন:  আমেরিকার গৃহযুদ্ধ দাস প্রথা উচ্ছেদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সশস্ত্র সংগ্রাম

ক) বিশেষ বাহিনী তৈরি এবং তাদের প্রশিক্ষিত করা: বিভিন্ন বিভাগ যেমন পুলিশ, আধাসামরিক এবং সামরিক বিভাগ থেকে বাছাই করা লােকেদের নিয়ে তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে বিশেষ বাহিনী তৈরি করা হয়। তারা যে রকম পরিবেশে লড়বে সেই অনুযায়ী এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যেমন- জঙ্গল এলাকা, পাহাড়ি এলাকা, বরফযুক্ত এলাকা ইত্যাদি। বিপ্লব বিরােধী মতাদর্শের শিক্ষা এই প্রশিক্ষণের অংশ। এই প্রশিক্ষণ প্রচলিত যুদ্ধ পদ্ধতির থেকে আলাদা। গেরিলা যুদ্ধ, গেরিলা রণকৌশল ও গেরিলা সংগঠন পদ্ধতি শেখানাে হয় এতে। “গেরিলাদের সঙ্গে গেরিলার মতই যুদ্ধ করার বিষয়ে তাদের শিক্ষিত করে তােলা হয়। 

খ) আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার: যে সমস্ত অস্ত্র প্রচলিত যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, সেগুলি এলআইসি-র জন্য কার্যকরী নয়। ট্যাঙ্ক, ভারি মেশিনগান, বড় কামান, যুদ্ধ বিমান এবং এই রকম অনেক অস্ত্রই গেরিলা যুদ্ধে অনুপযুক্ত। দ্রুত চলাফেরা, দ্রুত আক্রমণ, ওঁত পেতে আক্রমণ এবং আকস্মিক আক্রমণের জন্য হাল্কা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, গ্রেনেড লঞ্চার, রকেট লঞ্চারের মতাে অস্ত্র উপযুক্ত। সৈন্য পরিবহণের জন্য বুলেট প্রুফ ও মাইন প্রুফ যানবাহন ব্যবহার করা হয়, যেখানে এই ধরনের যানবাহন ব্যবহার সম্ভব নয় সেখানে বিমান পরিবহণের ব্যবস্থা করা হয়। গেরিলা যুদ্ধে সৈন্য ও প্রয়ােজনীয় রসদের সরববাহের জন্য বিমান পরিবহণ ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া গেরিলাদের বড় শিবির ও বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য বিমান হানার সাহায্য নেওয়া হয়। 

গ) সুরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা: এটা একটি নীতি যে, নিজস্ব ঘাঁটি তৈরি না করে গেরিলা ঘাঁটিকে আক্রমণ করবে না। তাই গেরিলা অঞ্চলে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সুদৃঢ় সুরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিবির তৈরি করা হয়। সেই সঙ্গে গেরিলাদের পাল্টা আক্রমণ রােখার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা তৈরি রাখা হয়। এই সুরক্ষা ব্যবস্থা গেরিলাদের অস্ত্রশস্ত্রের অবস্থা এবং যুদ্ধের মাত্রার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। গেরিলারা যখন হাল্কা অস্ত্র ব্যবহার করে তখন যে সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকে, কামানের আক্রমণ ঠেকাতে তা যথেষ্ট নয়। সেই রকমই ছােট গেরিলা দলকে আক্রমণের জন্য যে সুরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট, গেরিলারা এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য ব্যবহার করে চলমান যুদ্ধ চালালে তা পর্যাপ্ত নয়।

ঘ) জনগণ থেকে গেরিলাদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা: সাম্রাজ্যবাদীরা জানে যে গেরিলাদের শক্তি জনগণের সঙ্গে একাত্মতার উপর নির্ভর করে। তাই তারা জল বের করে মাছ ধরারও ব্যবস্থা করে। রণনৈতিক বসতি বা স্ট্রাটেজিক হ্যামলেটের নামে তারা গেরিলা প্রভাবাধীন গ্রাম ও পল্লিগুলি ফাকা করে দেয়। গ্রামবাসীদের বড় বড় বসতিতে রেখে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। গ্রামবাসীরা যাতে গেরিলাদের সাহায্য করতে না পারে, তারা সেই চেষ্টা করে। সেই কারণে গণহত্যা করে ও নিষ্ঠুর অত্যাচার ও শােষণ চালিয়ে গ্রামবাসীদের সন্ত্রস্ত করে তােলে। তারা বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চিরুনি তল্লাশি চালায়। এর মাধ্যমে তারা গেরিলাদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের জীবন্ত যােগাযােগ রক্ষা এবং কাজকর্ম চালানাের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে।

ঙ) যৌথ অভিযান: পুলিশ, বিশেষ বাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী এবং সামরিক বাহিনী মিলিত ভাবে যৌথ অভিযান চালায়। বিভিন্ন রাজ্যের একাধিক বাহিনী একসঙ্গে যৌথ অভিযান চালায়। আন্তর্জাতিক সীমান্তে বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনী যৌথভাবে অভিযান চালায়।

চ) নিশ্চিহ্নকরণ অভিযান: গােয়েন্দা তথ্যের সাহায্যে ওরা কোনও এলাকা থেকে গেরিলাদের একবারে নিশ্চিহ্ন করা অথবা সেই এলাকা থেকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করা হয় এবং স্থানীয় পার্টি সংগঠনকে একেবারে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়। গেরিলারা যদি সাময়িক পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয় অথবা ক্ষতির মুখে পড়ে, তবুও যদি স্থানীয় পার্টি সংগঠন, গণসংগঠন এবং জনগণের ক্ষমতার আধারগুলি অক্ষত থাকে, তাহলে খুব দ্রুত গেরিলা যুদ্ধ ফের তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। তাই এই অভিযানের লক্ষ্য হচ্ছে সমূলে বিপ্লবী শক্তিকে উচ্ছেদ করা।

ছ) গেরিলাদের পুনঃপ্রবেশ বন্ধ করার অভিযান : যখন একটি শক্তিশালী গেরিলা অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ সাময়িক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তখন এলকাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা করে দেওয়ার পরও অভিযান চলে। এই অভিযানের লক্ষ্য হলাে গেরিলারা যাতে কোন ভাবেই আবার সেই অঞ্চলে না ঢুকতে পারে। সংস্কারমূলক কাজ বাড়িয়ে জনগণের একটা অংশকে নিজেদের দিকে টেনে নেওয়ার পাশাপাশি জনগণের মধ্যে শক্তিশালী গােয়েন্দা কাঠামাে তৈরি করা এই ধরনের অভিযানের অংশ।

২) গােপন কার্যকলাপ:

এলআইসি-তে গােপন কার্যকলাপ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চলে। কিন্তু তাদের চরিত্র এবং তীব্রতা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হয়। সাধারণত গােপন কার্যকলাপগুলি নিম্নলিখিত ধরনের হয়ে থাকে।

ক) ঘাতক বাহিনী তৈরি করা
খ) দুর্বৃত্ত দল তৈরি করা
গ) অনুপ্রবেশ ঘটানাে
ঘ) প্রতিবিপ্লবী গেরিলা বাহিনী তৈরি করা।

ক) ঘাতক বাহিনী তৈরি করা: সাধারণত এই ধরনের বাহিনী বিশেষ গােয়েন্দা বিভাগের অধীনে থাকে। এই বাহিনীর মূল কাজ বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্বদের ধরা, তাদের উপর প্রচণ্ড অত্যাচার চালিয়ে গােপন কথা বের করা ও তারপরে তাদের হত্যা করা। এরা কর্মী ও নেতাদের ধরে গুম করে দেয় (তাদের নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত মামলায় পরিণত করে)। এই বাহিনী সাধারণ জনগণকে হত্যা করে ও বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালায় যাতে বিপ্লবীদের বদনাম করা যায়। এদের কার্যকলাপ নিঃশব্দ গােপনীয়তায় ঘেরা থাকে। এই বাহিনীর কার্যকলাপ কোনও ভৌগলিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়, এরা এদের খুনে কার্যকলাপ সর্বত্র চালাতে পারে। যেমন সিআইএ এবং মােসাদের খুনে বাহিনী অনেক দেশে রাজনৈতিক হত্যা ও গুপ্ত হত্যা করে থাকে।

খ) দুর্বৃত্ত দল তৈরি করা: এগুলি তৈরি হয় প্রাক্তন গেরিলা, গেরিলা বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর প্রাক্তন ঘাতক অথবা লুম্পেন এবং অপরাধীদের নিয়ে। এরা বিপ্লবের সমর্থকদের খুন করে, বিপ্লবের বাইরে থাকা যেসব ব্যক্তি বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করে তাদেরও হত্যা করে। এছাড়া সন্ত্রাস তৈরি করার জন্য সামাজিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগঠনের কর্মীদের, পার্টির সমর্থক-কর্মীদের এবং পার্টি নেতৃত্ব ও কর্মীদের হত্যা করে এবং প্রকাশ্য কার্যকলাপ বন্ধ করার চেষ্টা করে। এগুলােই এই বাহিনীর কাজ। গােয়েন্দা বিভাগের বিশেষ শাখার নিয়ন্ত্রণাধীনে এই বাহিনী কাজ করে । প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে এদের তত্ত্বাবধান ও রক্ষার জন্য বিশেষ গােয়েন্দা বিভাগের গােপন তহবিল থেকে খরচ করা হয়।

গ) অনুপ্রবেশ ঘটানাে: শত্রুর ভিতরের খবরের জন্য শত্রু বাহিনীর মধ্যে নিজেদের লােকের অনুপ্রবেশ ঘটানাের চেয়ে ভাল কোনও পন্থা নেই। তাই শত্রু বিপ্লবী পার্টি, গণসংগঠন এবং জনগণের ক্ষমতার কেন্দ্রগুলিতে নিজেদের লােক ঢােকানাের চেষ্টা করে। বাইরে থেকে লােক ঢােকানাে একটি পদ্ধতি, এছাড়া ভেতরের বিশ্বাসঘাতকদের ব্যবহার করা আরেকটি পদ্ধতি। এই অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে কিছু লােক খবর সরবরাহ করে। কিছু সংগঠনের মধ্য থেকে বিশ্বাসঘাতকদের জাল তৈরি করে এবং সংগঠনে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করে। কেউ কেউ আরও জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা করে পার্টি নেতৃত্বদের হত্যা করে। আমরা এই ধরনের কাজকে গােপন কাজ বলতে অভ্যস্ত। গােপন কার্যকলাপ অনেক ধরনের হতে পারে, হত্যা সেগুলির মধ্যে একটি।

ঘ) প্রতিবিপ্লবী গেরিলা বাহিনী তৈরি করা: মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা গুয়েতেমালায় সরকার ফেলার জন্য কন্ট্রাস’ নামে একটি গেরিলা বাহিনী তৈরি করে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এই ধরনের লজ্জাজনক কাজকে বিপ্লবের প্রতি সমর্থন বলে প্রচার করে। মালয় এবং ভিয়েতনামে আমেরিকা এই ধরনের কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিল। আলজেরিয়ায় ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ ‘এফ ফোর্স’ নামে একটি প্রতিবিপ্লবী বাহিনী তৈরি করে, এর দ্বারা বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। | ছত্তিশগড়ের সালওয়া জুড়ুম ছিল এ ধরনের বাহিনী। উপযুক্ত নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক সমর্থন পেলে এগুলি স্বাধীন গেরিলা বিরােধী বাহিনী হিসেবে কাজ করে। তা যদি না হয়, তাহলে এই সেনাদের পুলিশ ও বিশেষ বাহিনীতে নিয়ে নেওয়া হয়ে থাকে।

তথ্যসূত্র:

১. সুমন বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত, সাম্রাজ্যবাদের নিচু মাত্রার যুদ্ধ (এলআইসি), উৎস পাবলিশার্স ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা ৩৫-৪৬

1 thought on “নিচু মাত্রার যুদ্ধ হচ্ছে স্থানীয়ভাবে সংঘটিত প্রচলিত যুদ্ধের তীব্রতার চেয়ে কম সহিংস সংঘাত”

  1. Hi there mates, its fantastic piece of writing regarding culture and entirely defined,
    keep it up all the time.

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!