একটা সুপরিচিত প্রবাদ আছে যে, জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধ সত্যগুলি যদি মানুষের স্বার্থকে আঘাত করতো, তাহলে সেগুলিকে খণ্ডন করার জন্যও নিশ্চিতই প্রচেষ্টা নেয়া হতো। প্রাকৃতিক-ঐতিহাসিক যেসব তত্ত্ব ধর্মশাস্ত্রের পুরানো কুসংস্কারগুলোর সাথে সংঘাত সৃষ্টি করে তা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত সংগ্রামের উদ্রেক করেছিল, এবং এখনও তা করছে। সুতরাং এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই যে, যে-মার্কসীয় তত্ত্বমত আধুনিক সমাজের সবচেয়ে অগ্রবর্তী শ্রেণিকে আলোকিত ও সংগঠিত করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে সেবা করছে, এই শ্রেণির সম্মুখে উপস্থিত কর্তব্যকর্ম নির্দেশ করছে এবং (অর্থনৈতিক বিকাশের দরুন) এক নয়া ব্যবস্থার দ্বারা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার অনিবার্য প্রতিস্থাপন প্রতিপাদ্য করছে, সেই তত্ত্বমতকে তার বিকাশের গতিপথে প্রতি পদক্ষেপেই লড়ে এগুতে হচ্ছে।
বুর্জোয়া বিজ্ঞান ও দর্শন সম্পর্কে বলার কোনো প্রয়োজন নেই, যা পদাধিকারী অধ্যাপকেরা বিত্তবান শ্রেণিগুলোর উঠতি বংশদরদের নেশাগ্রস্ত করে রাখার জন্য এবং বিদেশী ও অভ্যন্তরীণ শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের ‘প্রশিক্ষিত করে তোলার’ জন্য আনুষ্ঠানিক বিদ্যা দান করেন। এই বিজ্ঞান মার্কসবাদের এমন কি নামও শুনতে চাইবে না এবং ঘোষণা করবে যে, মার্কসবাদকে খণ্ডন করা হয়েছে এবং সম্পূর্ণ খতম করা হয়ে গেছে। সমাজতন্ত্রকে খণ্ডন করেই যে নবীন পণ্ডিতরা তাদের পদপ্রতিষ্ঠা গড়ে তুলছে, আর সকল ধরণের জীর্ণ ‘চিন্তা-পদ্ধতির’ ঐতিহ্যকে রক্ষা করেছে যে-জরাগ্রস্ত বৃদ্ধরা, তারা সকলেই সমান উৎসাহ নিয়ে মার্কসের উপর আক্রমণ চালান। মার্কসবাদের অগ্রগতি আর শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে তার ভাবধারার বিস্তার ও প্রতিষ্ঠা অর্জনের বাস্তব ঘটনা অবশ্যম্ভাবী রূপেই মার্কসবাদের উপর এই বুর্জোয়া আক্রমণের তৎপরতা ও তীব্রতাকে বাড়িয়ে তুলে, আর সরকারী বিজ্ঞানের দ্বারা যতবারই মার্কসবাদ ‘খতম হচ্ছে’, ততবারই তা আরো শক্তিশালী, আরো মজবুত ও আরো প্রাণশক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠছে।
কিন্তু এমনকি শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের সাথে সংশ্লিষ্ট তত্ত্বমতগুলোর মধ্যে, এবং প্রধানত সর্বহারা শ্রেণির মধ্যে বিরাজমান ধারাগুলোর মধ্যে, মার্কসবাদ কোনোক্রমেই হঠাৎ করে তার অবস্থান সংহত করতে পারেনি। নিজ অস্তিত্বের প্রথম অর্ধশতকে (১৮৪০-এর দশক থেকে শুরু করে) মার্কসবাদকে নিয়োজিত থাকতে হয় তার প্রতি মৌলিকভাবে বৈরীভাবাপন্ন তত্ত্বসমূহের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে মার্কস ও এঙ্গেলস চরমপন্থি নবীন তরুণ হেগেলবাদীদের সাথে তাদের হিসেবে-নিকেশ চুকিয়ে ফেলেন, যাদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল দার্শনিক ভাববাদ। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে অর্থনৈতিক তত্ত্বমতের পরিমণ্ডলে, প্রুধোঁপন্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকে এই সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটে, যে সংগ্রাম ছিল সেসব পার্টি ও তত্ত্বমতেরই সমালোচনা যেগুলো ১৮৪৮ সালের ঝঞ্ঝাক্ষুদ্ধ বছরে নিজেদের প্রকাশ ঘটিয়েছিলো। ষাটের দশকে সাধারণ তত্ত্বের রাজ্য থেকে সংগ্রাম স্থানান্তরিত হয় প্রত্যক্ষ-শ্রমিক আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ পরিমণ্ডলেঃ আন্তর্জাতিক থেকে বাকুনিনদের বিতাড়িতকরণে। সত্তরের দশকের শুরুতে জার্মানীর রঙ্গমঞ্চ অল্প সময়ের জন্য দখল করে প্রুধোঁবাদী মুলবার্গার এবং সত্তরের দশকের শেষদিকে প্রত্যক্ষবাদী দ্যুরিং। কিন্তু সর্বহারা শ্রেণির উপর উভয়টির প্রভাব ছিল ইতিমধ্যেই চূড়ান্তভাবে নগণ্য। ইতিমধ্যেই অন্য সকল আদর্শের চাইতে শ্রমিক আন্দোলনে মার্কসবাদ তর্কাতীত বিজয় অর্জন করছিল।
নব্বই-এর দশক নাগাদ এই বিজয় মোটের উপর সমাপ্ত হয়ে যায়। এমনকি যে লাতিন ভাষাভাষি দেশগুলিতে প্রুধোঁবাদের ঐতিহ্য সবচেয়ে বেশি দিন মাটি আঁকড়ে পড়েছিলো, সেখানেও শ্রমিক পার্টিগুলো প্রকৃতপক্ষে তাদের কর্মসূচী ও রণকৌশল মার্কসবাদী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল। নির্দিষ্ট সময় অন্তর আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের আকারে, শ্রমিক আন্দোলনের পুনরুজ্জীবিত আন্তর্জাতিক সংস্থা শুরু থেকেই, আর প্রায় কোনো রকম সংগ্রাম ছাড়াই, সমস্ত মূল বিষয়ে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। কিন্তু কম বেশি সুসংবদ্ধ অন্যসব বিরোধী তত্ত্বমত মার্কসবাদ কর্তৃক বিতাড়িত হওয়ার পর, এসব তত্ত্বমতে অভিব্যক্ত ঝোঁকগুলো অন্য ধারায় আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজতে শুরু করে। সংগ্রামের রূপ ও কারণগুলো বদলে যায়, কিন্তু সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। আর মার্কসবাদের অস্তিত্বের পরবর্তী অর্ধ-শতাব্দী শুরু হয় (নব্বই-এর দশকে) মার্কসবাদের খোদ ভেতরেই মার্কসবাদবিরোধী এক ঝোঁকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
এককালের গোঁড়া মার্কসবাদী বের্নস্তাইন সবচেয়ে বেশি হৈ-হল্লা সহকারে এবং মার্কসকে সংশাধনের সবচেয়ে পুর্ণাঙ্গ অভিব্যাক্তি সমেত অগ্রসর হয়ে এই ঝোঁকের নাম প্রদান করেন— মার্কসের সংশোধন, সংশোধনবাদ। এমনকি রাশিয়াতে— দেশের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা আর ভূমিদাস-প্রথার অবশেষের দ্বারা নিপীড়িত কৃষক জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে— অমার্কসবাদী সমাজতন্ত্র স্বভাবতই সবচেয়ে বেশি সময় মাটি আঁকড়ে পড়েছিলো, সেখানেও এই ঝোঁক আমাদের চোখের সামনেই সংশোধনবাদের দিকে স্পষ্টভাবে এগিয়ে চলেছে। জমি বিষয়ক প্রশ্নে (সমস্ত জমির পৌরায়ত্তকরণ) — এই উভয় প্রশ্নেই আমাদের সামাজিক-নারদপন্থীরা (সোশ্যাল নারদনিকস) তাদের পুরানো চিন্তাপদ্ধতির মুমূর্ষ ও সেকেলে অবশেষের জন্য অধিক থেকে অধিক মাত্রায় মার্কসের ‘সংশোধন’ প্রতিস্থাপন করছে, যে চিন্তাপদ্ধতি ছিল নিজস্ব দিক থেকে সুসংবদ্ধ ও মৌলিকভাবেই মার্কসবাদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন।
প্রাক-মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র পরাস্ত হয়েছে। এই সমাজতন্ত্র এখন তার নিজস্ব স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে সংগ্রাম অব্যাহত রাখছে না, বরং তা চালিয়ে যাচ্ছে মার্কসবাদের সাধারণ ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে- সংশোধনবাদ হিসেবে। এবার তাহলে, শোধনবাদের মতাদর্শগত সারবস্তুটাকে পরীক্ষা করে দেখা যাক।
দর্শনের ক্ষেত্রে শোধনবাদ অনুসরণ করেছিল বুর্জোয়া অধ্যাপকীয় ‘বিজ্ঞানের’ পিছু পিছু। অধ্যাপকরা ‘কান্টের মতামতে ফিরে’ যায়— আর সংশোধনবাদ নয়া কান্টবাদীদের পেছনে পেছনে চলে। দার্শনিক বস্তুবাদের বিরুদ্ধে পাদ্রীরা হাজারো বার যে নীরস মামুলী মন্তব্য করেছে, অধ্যাপকরা তারই পুনরাবৃত্তি করে— আর সংশোধনবাদীরা, প্রসন্ন চিত্তের হাসি হেসে, (সর্বশেষ হ্যান্ডবুক থেকে অক্ষরে অক্ষরে) আমতা আমতা করে বলে যে, বহু পূর্বেই বস্তুবাদকে ‘খণ্ডন’ করা হযেছে। অধ্যাপকরা হেগেলকে ‘মরা কুকুরের’ মতো উপেক্ষা করতেন আর নিজেরা প্রচার করতেন ভাববাদ, এমন ভাববাদ যা হেগেলের চেয়েও হাজার গুণ বেশি তুচ্ছ ও গতানুগতিক, তথাপি তারাই দ্বন্দ্বতত্ত্বের প্রতি ঘৃণায় ঘাড় নেড়েছিল- আর সংশোধনবাদীরা ‘সরল’ (আর প্রশান্ত) ‘বিবর্তনবাদের’ দ্বারা ‘কুশলী’ (আর বিপ্লবী) দ্বন্দ্বতত্ত্বকে প্রতিস্থাপিত করে বিজ্ঞানের দার্শনিক বিকৃতির জলাভূমিতে তাদেরকে অনুকরণের হাস্যকর চেষ্টা করেছিল। আধিপত্যশীল মধ্যযুগীয় দর্শনের (অর্থাৎ ধর্মতত্ত্বে) সাথে উভয়ত নিজেদের ভাববাদী ও ‘সমালোচনামূলক’ চিন্তাপদ্ধতিকে সমন্বিত করে অধ্যাপকরা তাদের সরাকারি বেতন ভাতা ভোগ করছিলো— আর আধুনিক রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়, বরং অগ্রগামী শ্রেণির পার্টির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, ধর্মকে এক ‘ব্যক্তিগত ব্যাপারে’ পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে সংশোধনবাদীরা তাদের খুব কাছে গিয়ে ভিড়েছিলো।
শ্রেণি দৃষ্টিকোণের দিক থেকে মার্কসের এরূপ ‘সংশোধনের’ অর্থ কী ছিল তা উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই; সেটা স্বতঃপ্রমাণিত। আমরা কেবলামাত্র এটুকুই উল্লেখ করবো যে, আন্তর্জাতিক সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক অন্দোলনের ক্ষেত্রে সংশোধনবাদীদের অবিশ্বাস্য গতানুগতিক বক্তব্যগুলিকে সঙ্গতিপূর্ণ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের অবস্থান থেকে একমাত্র যে-মার্কসবাদী সমালোচনা করেছিলেন তিনি হলেন প্লেখানভ। এটা আরো জোরের সাথে গুরুত্ব দিয়ে বলতে হবে এই কারণে যে, বর্তমান সময়ে প্লেখানভের কৌশলগত সুবিধাবাদের সমালোচনার ছদ্মাবরণে পুরানো ও প্রতিক্রিয়াশীল দার্শনিক জঞ্জালকে চালান করে দেয়ার সুগভীরভাবে ভ্রান্ত প্রয়াস নেয়া হচ্ছে।[১]
রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের দিকে চোখ ফেরালে সর্বপ্রথম এটাই নজরে পড়বে যে এই ক্ষেত্রে সংশোধনবাদীদের ‘সংশোধনগুলি’ ছিলো আরো অনেক বেশি সহজবোধ্য ও আনুষঙ্গিক; ‘অর্থনৈতিক বিকাশের নতুন উপাত্ত’ উল্লেখ করে জনসাধারণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। এটা বলা হয়েছিলো যে বৃহদায়তন উৎপাদন দ্বারা ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদনের কেন্দ্রীভবন ও উচ্ছেদ কৃষির ক্ষেত্রে মোটেই সংঘটিত হয় না, অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে তা অগ্রসর হয় অত্যন্ত ধীর গতিতে। এরূপ বলা হয়েছিল যে, সংকট এখন বিরল ও দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর কার্টেল ট্রাস্ট সম্ভবত সেগুলিকে সামগ্রিকভাবে দূরীভূত করায় পুঁজিকে সমর্থ করে তুলবে। এরকম বলা হয়েছিল যে, শ্রেণীবৈরিতা কমে যাওয়ার ও তীব্রতা হ্রাসের প্রবণতার কারণে, পুঁজিবাদ যে পতনের দিকে এগুচ্ছে সেই ‘পতনের তত্ত্ব’ ত্রুটিপূর্ণ। সর্বশেষে, এটা বলা হলো যে, বেম-বাভের্কের অভিমত অনুসরণ করে মূল্য সম্পর্কিত মার্কসের তত্ত্বকেও সংশোধন করা ভ্রান্ত হবে না।
বিশ বছর পূর্বে দ্যুরিং-এর সাথে এঙ্গেলসের বিতর্ক যেমনটা করেছিলো, তেমনি এসব প্রশ্নে শোধনবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে তত্ত্বগত চিন্তার ফলপ্রসু পুনরুজ্জীবনকে উপস্থিত করালো। তথ্য ও পরিসংখ্যানের সহায়তায় শোধনবাদীদের যুক্তিগুলোকে বিশ্লেষণ করা হলো। এটা প্রমাণ করা হলো যে, শোধনবাদীরা পদ্ধতিগতভাবেই আধুনিক ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদনের এক সুশোভিত চিত্র অঙ্কনেরই চেষ্টা করেছিল। কেবলমাত্র শিল্পেই নয়, বরং কৃষিতেও ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদনের চেয়ে বৃহদায়তন উৎপাদনের যে কারিগরী ও বাণিজ্যিক উৎকৃষ্টতা রয়েছে তা অখণ্ডনীয় তথ্যের দ্বারা সপ্রমাণ করা হলো। কিন্তু কৃষিতে পণ্য উৎপাদন ঢের বেশী কম বিকশিত, আর আধুনিক পরিসংখ্যানবিদ ও অর্থনীতিবিদরা, রীতিমাফিক, কৃষির ক্ষেত্রে বিশেষ শাখাগুলিকে (কোন কোন সময় এমনকি কৃষিকার্য প্রণালীকেও) বেছে নেয়ার দিক থেকে খুব একটা দক্ষ নয়, যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্ব অর্থনীতির বিনিময় প্রক্রিয়ার মধ্যে ক্রমেই কৃষিকে বেশি করে টানা হচ্ছে। ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদন নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে স্বাভাবিক অর্থনীতির ধ্বংসাবশেসের ওপর- টিকিয়ে রেখেছে পুষ্টির নিয়ত অবনতি, লাগাতার অনশন, শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করে, গবাদি পশুর গুণমান ও যত্নের অবনতি ঘটিয়ে, এক কথায়, যে যে পদ্ধতিতে হস্তশিল্প উৎপাদন পুঁজিবাদী কারখানা-উৎপাদনের বিরুদ্ধে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছিল সেই সেই পদ্ধতিতেই ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদন আজ নিজেকে টিকিয়ে রাখছে। পুঁজিবাদী সমাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতিটি অগ্রগতি অনিবার্যরূপে ও বিরামহীনভাবে ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদনের ভিত্তিমূলকে দুর্বল করে দেয়; আর সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির কর্তব্য হলো- সমস্ত রূপের দিক থেকেই এই প্রক্রিয়ার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানো, যে রূপগুলি প্রায়শঃ জটিল ও সূক্ষ্ম, আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থাধীনে নিজের টিকে থাকার অসম্ভাব্যতা, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাধীনে ক্ষুদে কৃষক চাষাবাদের নৈরাশ্যজনক অবস্থা ও কৃষকের পক্ষে সর্বহারাশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ক্ষুদে উৎপাদকদের সামনে তুলে ধরা। বৈজ্ঞানিক অর্থে, এই প্রশ্নে সংশোধনবাদীরা, একপেশেভাবে বাছাইকৃত তথ্যসমূহের ভিত্তিতে বাহ্যিক সাধারণীকরণ করে এবং, সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কোন উল্লেখ না করে অন্যায় করে; রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, তাদের অন্যায় হলো এ ঘটনার মধ্যে যে, তার চেয়েই থাকুক, আর নাই থাকুক, বিপ্লবী সর্বহারার দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করার আহ্বান না জানিয়ে তারা অনিবার্যরূপে কৃষকদেরকে আহ্বান বা উৎসাহ প্রদান করেছিল ক্ষুদে উৎপাদকের দৃষ্টিভঙ্গী (অর্থাৎ, বুর্জোয়া শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গী) গ্রহণ করতে।
সংকট (Crises) সম্পর্কিত তত্ত্ব ও পতন (collapse) সম্পর্কিত তত্ত্বের ব্যাপারে সংশোধনবাদের অবস্থান ছিল আরো নিকৃষ্ট। কয়েক বছরের শিল্প-উৎপাদনের হঠাৎ-বৃদ্ধি (ইন্ডাস্ট্রিয়াল বুম) ও সমৃদ্ধির প্রভাবে মার্কসীয় তত্ত্বমতের ভিত্তিমূলকে পুনর্গঠনের কথা নিছক স্বল্পতম সময়ের জন্য কিছু লোক চিন্তা করতে পারে- তাও যারা অত্যন্ত অদূরদর্শী। কিন্তু বাস্তবতা অতিদ্রুতই সংশোধনবাদীদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রকট করে দিল যে, সংকট অতীতের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়নি- সমৃদ্ধির পরেই এসেছিল এক সংকট। কোন বিশেষ সংকটের রূপ, পূর্বাপরক্রম বা চিত্র বদলাতে পারে, কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এক অপরিহার্য উপাদন হিসাবে সংকট বিদ্যামান থাকে। উৎপাদনকে একত্রসংবদ্ধ করার সাথে সাথে, কার্টেল, ট্রাস্টগুলি, একই সময়ে ও সবার কাছে স্পষ্ট পন্থায়, উৎপাদনের নৈরাজ্য, সর্বহারাশ্রেণীর অস্তিত্বের নিরাপত্তাহীনতা আর পুঁজির নিপীড়নকে গভীরতর করে তুলেছিল, আর এভাবে নজীরবিহীন মাত্রায় শ্রেণি-বৈরিতাকে তীব্রতর করে তুলেছিল। স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট আর গোটা পুঁজিবাদী ব্যস্থার পরিপূর্ণ পতন- এই উভয় অর্থে পুঁজিবাদ যে পতনের দিকে এগিয়ে চলেছে তা বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে, আর যথাযথভাবে নতুন দৈত্যাকারের ট্রাস্টগুলোর দ্বারা তা বিশেষভাবেই ব্যাপক আকারে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে আসন্ন শিল্প-সংকটের বহু লক্ষণই সুতীক্ষ্ণ হয়ে ওঠেছে তার কথা বাদ দিলেও আমেরিকার সাম্প্রতিক কারের আর্থিক সংকট এবং সমগ্র ইউরোপব্যাপী বেকারত্বের ভয়াবহ বৃদ্ধি- এইসব সমস্ত কিছুর ফলাফল হিসেবে সংশোধনবাদীদের সাম্প্রতিক ‘তত্ত্বগুলোকে’ সবাই ভুলে যাচ্ছে, এমনকি মনে হচ্ছে সংশোধনবাদীদের অনেকে নিজেরাও ভুলে যাচ্ছ। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের এই অস্থিরতা শ্রমিকশ্রেণীকে যে শিক্ষা দিয়েছে তা ভুলে গেলে চলবে না।
মূল্যতত্ত্ব (Theory of Value) সম্পর্কে বলতে গেলে, কেবল এইটুকুই বলা প্রয়োজন যে, বেম-বাভের্কের ভঙ্গীতে, অত্যন্ত ইঙ্গিত ও দীর্ঘশ্বাস ছাড়া, সংশোধনবাদীরা এ ব্যাপারে চূড়ান্তভাবেই কোন অবদান রাখতে পারেনি, আর সেকারণে বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশে কোনরূপ চিহ্নই তারা রাখতে পারেনি।
রাজনীতির ক্ষেত্রে, সংশোধনবাদ মার্কসবাদের ভিত্তিমূল, অর্থাৎ শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বমতকেই, সংশোধন করার প্রকৃত চেষ্টা চালিয়েছিল। আমাদের বলা হয়েছিল- রাজনৈতিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সর্বজনীন ভোটাধিকার অপসারিত করেছে শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তিকেই এবং শ্রমিকশ্রেণীর কোন দেশ নেই— কমিউনিস্ট ইশতেহারের এই পুরানো প্রস্তাবনাকে অসত্য প্রতিপন্ন করেছে। কারণ, তারা বলেছিলো, যেহেতু গণতন্ত্রে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা’ বিরাজমান থাকে, সেহেতু রাষ্ট্রাকে শ্রেণীশাসনের এক যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা যেমন চলবে না, তেমনি প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল, সামাজিক-সংস্কারবাদী বুর্জোয়াদের সাথে মৈত্রীকেও বর্জন করা চলবে না।
এটা তর্কাতীত যে, সংশোধনবাদীদের এই যুক্তিতর্কগুলো বেশ পরিমাণে সুসঙ্গত এক চিন্তা-পদ্ধতি, অর্থাৎ, পুরাতন ও সুবিদিত উদারনৈতিক বুর্জোয়া চিন্তাপদ্ধতি গঠন করেছিল। উদারনীতিকরা সব সময়ই বলে এসেছে যে বুর্জোয়া পার্লামেন্টবাদ শ্রেণি ও শ্রেণিপার্থক্যকে ধ্বংস করে দেয়, কারণ সকল নাগরিকই ভোটের অধিকার ও দেশর সরকারি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার পার্থক্যহীনভাবে ভোগ করে। এ ধরণের চিন্তাধারা কীরূপ উদ্ভট তা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ্বের ইউরোপের গোটা ইতিহাস, আর বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের রুশ বিপ্লবের গোটা ইতিহাস সুস্পষ্টভাবে প্রদর্শন করছে।
‘গণতান্ত্রিক’ পুঁজিবাদের স্বাধীনতার আমলে অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলোর হ্রাস না হয়ে সেগুলোর গভীরতা আর তীব্রতা বরং বাড়ে। পার্লামেন্টবাদ শ্রেণী-নিপীড়নের যন্ত্র হিসেবে এমনকি সবচেয়ে গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রের অন্তর্নিহিত চরিত্রকেও উদ্ঘাটন করে দেয়, তাকে দূরীভূত করে না। পূর্বে যত সংখ্যায় রাজনৈতিক ঘটনায় সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতো তার চেয়ে অপরিমেয়রূপে ব্যাপকতর সংখ্যক জনগণকে সংগঠিত ও সচেতন করায় সাহায্য করলেও, পার্লামেন্টবাদ সংকট ও রাজনৈতিক বিপ্লবের বিলোপ ঘটায় না, বরং এরূপ বিপ্লবের সময় গৃহযুদ্ধের সর্বোচ্চ তীব্রতা দান করে। ১৮৭১ সালের বসন্তকালে প্যারিসের ঘটনাবলী এবং ১৯০৫ সালের শীতকালে রাশিয়ার ঘটনাবলী এই তীব্রতা কীরূপ অনিবার্যরূপে ঘটে তা দেখিয়েছে। ফরাসী বুর্জোয়াশ্রেণী এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে সর্বহারা বিপ্লবকে পিষে মারার উদ্দেশ্যে গোটা জাতির শত্রুর সাথে, যে বিদেশী সেনাবাহিনী তাদের দেশকে ধ্বংস করেছে তাদের সাথে আপোষ রফা করে। পার্লামেন্টবাদ ও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অনিবার্য অভ্যন্তরীণ ‘ডায়ালেকটিস’ হলো তা পূর্বের তুলনায় ব্যাপক হিংসা প্রয়োগের দ্বারাই বিবাদ বিসম্বাদের অধিকতর তীক্ষ্ণ সাধানের দিকে চালিত করে, সেই ‘ডায়ালেকটিকস’ যিনি বুঝেন না তিনি এই পার্লামেন্টবাদের ভিত্তিতে এমন প্রচার-প্রোপাগাণ্ডা ও বিক্ষোভ পরিচালনা করতে সমর্থ হবেন না, যা নীতির দিক দিয়ে সঙ্গতিপূর্ণ এবং এরূপ ‘বিসম্বাদের’ ক্ষেত্রে বিজয়মণ্ডিত অংশগ্রহণের জন্য শ্রমিক শ্রেণিকে প্রকৃতই প্রস্তুত করে। পাশ্চাত্যে সমাজ-সংস্কারবাদী উদারনীতিকদের সাথে এবং রুশ-বিপ্লবে উদারনৈতিক সংস্কারবাদীদের (কাদেত) সাথে মৈত্রী, চুক্তি ও জোট (আলায়েন্সেস, অ্যাগ্রিমেন্টস অ্যান্ড ব্লক্স্) গঠনের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে প্রদর্শন করছে যে, এসব চুক্তি কেবলমাত্র ব্যাপক জনগণের চেতনাকে ভোঁতাই করে, আর সংগ্রাম করতে সর্বাধিক অসমর্থ এবং সবচেয়ে দোদুল্যমান ও বিশ্বাসঘাতক লোকজনদের সাথে সংগ্রামী যোদ্ধাদের সংযোগ ঘটায়, সেগুলো তাদের সংগ্রামের প্রকৃত তাৎপর্যকে জোরদার করে না, বরং দুর্বলই করে। ব্যাপক অর্থাৎ প্রকৃতই জাতীয় পরিধিতে সংশোধনবাদী রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো ফ্রান্সের মিলেরাঁবাদ, যা শোধনবাদের এমন এক বাস্তব মূল্যায়ন উপস্থিত করেছে যা বিশ্বব্যাপী সর্বহারা শ্রেণি কখনোই ভুলবে না।
শোধনবাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ধারার একটা স্বাভাবিক পরিপূরক হল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষের প্রতি তার মনোভাব। ‘আন্দোলনটাই সব, চূড়ান্ত লক্ষ্য কিছুই নয়’— বের্নস্তাইনের এই বাঁধা বুলিটিতে অনেক দীর্ঘ প্রবন্ধের চেয়েও ভাল ভাবেই শোধনবাদের মর্ম প্রকাশিত হয়েছে। উপলক্ষে উপলক্ষে নিজের আচরণ বদলানো, দৈনন্দিন ঘটনাবলির সংগে এবং সংকীর্ণ রাজনীতির ক্রমাগত পরিবর্তনশীলতার সংগে নিজেকে খাপ খাওয়ানো, প্রলেতারিয়েতের মুল স্বার্থগুলি এবং সমগ্র পুঁজিবাদি ব্যবস্থার, সমস্ত পুঁজিবাদি বিবর্তনের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি বিস্মৃত হওয়া, ক্ষণিকের বাস্তবিক কিংবা কল্পিত সুবিধার খাতিরে মুল স্বার্থ বলি দেওয়া—এইই হলো শোধনবাদের কর্মনীতি। এই নীতির চরিত্র থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে এটি অসংখ্য রূপধারণ করতে পারে এবং অল্প-বিস্তর ‘নতুন’ যে কোনো প্রশ্ন উঠলে, ঘটনার গতি অল্প-বিস্তর অপ্রত্যাশিত ও অদৃষ্টপূর্ব খাতে ঘুরলে—তাতে বিকাশের মূল ধারা শুধু অকিঞ্চিৎকর মাত্রায় এবং স্বল্পতম সময়ের জন্যে বদলালেও—তার থেকে কোনো না কোনো রকমের শোধনবাদের উদ্ভব অবশ্যম্ভাবি।
আধুনিক সমাজের শ্রেণিগত শিকড় থেকেই শোধনবাদের অবশ্যম্ভাবিতা নির্ধারিত হয়। শোধনবাদ একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপার। জার্মানিতে গোঁড়া আর বের্নস্তাইনপন্থিদের মধ্যে, ফ্রান্সে গেদপন্থি আর জোরেসপন্থিদের (আর এখন বিশেষভাবে ব্রুসপন্থিদের) মধ্যে, ইংল্যান্ডের সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক ফেডারেশন আর ইন্ডিপেনডেন্ট লেবার পার্টির, বেলজিয়ামে ব্রুকের আর ভান্দের্ভেলদে’র মধ্যে, ইতালিতে ইন্টেগ্রালিস্ট আর সংস্কারবাদীদের মধ্যে, রাশিয়া বলশেভিক আর মেনশেভিকদের মধ্যে সম্পর্কটা ঐসব দেশের বর্তমান অবস্থায় বিভিন্ন জাতীয় পরিস্থিতির আর ঐতিহাসিক উপাদানের বিপুল বৈচিত্র্য সর্বত্র যে মূলত একই রকমের তাতে যে কোনো চিন্তাশক্তিসম্পন্ন ওয়াকিবহাল সমাজতন্ত্রীর লেশমাত্র সন্দেহ থাকতে পারে না। বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ ‘বিভাগটা’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একই ধারাতে চলছে; ত্রিশ বা চল্লিশ বছর আগে একই আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের ভিতরে বিভিন্ন দেশে বিচিত্র ধারার যে লড়াই চলত তার তুলনায় এটি প্রচণ্ড অগ্রগতিরই সাক্ষ্য দেয়। তেমনি, লাতিন দেশগুলোতে যে, ‘বাম দিক থেকে শোধনবাদ’ ‘বৈপ্লবিক সিন্ডিক্যালিজম’ রূপে গড়ে উঠেছে তাও মার্কসবাদের সংগে নিজেকে খাপ খাওয়াচ্ছে তাকে ‘সংশোধন’ করে: ইতালিতে লাব্রিওলা এবং ফ্রান্সে লাগার্দেল ভুল ভাবে বোঝা মার্কসের থেকে ঘনঘন আর্জি জানাচ্ছেন ঠিকভাবে বোঝা মার্কসের কাছে।
এই শোধনবাদ, এখনও পর্যন্ত যা সুবিধাবাদী শোধনবাদের মতো বেড়ে ওঠেনি, তার মতাদর্শগত সারবস্তুর আলোচনায় এখানে কালক্ষেপ করা চলে না, এ শোধনবাদ এখনও আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে নি, এখনও কোনো দেশে সমাজতান্ত্রিক পার্টির সঙ্গে বাস্তব কোনো বড় রকমের লড়াইয়ের পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয় নি। কাজেই, উপরে-বিবৃত সেই “দক্ষিণ তরফের শোধনবাদের” কথায় আমরা সীমাবদ্ধ রাখছি নিজেদের।
পুঁজিবাদী সমাজে শোধনবাদের অবশ্যম্ভাবিতা কোথায় নিহিত? বিভিন্ন জাতীয় বৈশিস্ট্য এবং পুঁজিবাদী বিকাশের বিভিন্ন মাত্রার মধ্যে পার্থক্যের চেয়েও এটা বেশি গভীর কেন? তার কারণ, প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশে প্রলেতারিয়েতের পাশাপাশি সর্বদাই থাকে পেটি বুর্জোয়া, ক্ষুদ্র মালিকদের একটা বিস্তৃত স্তর। ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদন থেকেই পুঁজিবাদের উদ্ভব হয়েছিলো এবং নিরন্তর হচ্ছে। পুঁজিবাদ বারবার অনিবাৰ্য ভাবেই নতুন কতকগুলি ‘মধ্যবতী স্তরের’ উদ্ভব ঘটায় (কারখানার বিভিন্ন লেজুড়, বাড়িতে থেকে কাজ, বাইসাইকেল, মোটরগাড়ি ইত্যাদি বৃহদায়তন শিল্পের চাহিদা মেটানোর জন্য দেশের সর্বত্র ছড়ানো ছোটছোট কারখানাগুলি)। নতুন নতুন এই ক্ষুদ্র উৎপাদকেরা আবার সমান অনিবার্য ভাবেই প্রলেতারিয়েতের সারিতে গিয়ে পড়ে। ব্যাপক শ্রমিক পার্টিসমূহের সদস্যদের মধ্যে পেটি বুর্জোয়া বিশ্বদৃষ্টি যে বারবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, এটা খুবই স্বাভাবিক। প্রলেতারীয় বিপ্লবের পালাবদল অবধি এটা হবার কথা এবং সর্বদাই হবেও, খুবই স্বাভাবিক এটা। কারণ, তেমন বিপ্লব সাধনের আগে জনসংখ্যার অধিকাংশের সম্পূর্ণ প্রলেতারীয়করণ অত্যাবশ্যক মনে করলে প্রচন্ড ভুল হবে। বর্তমানে কেবল মতাদর্শের জগতে, যেমন মার্কসের উপরে বিভিন্ন তত্ত্বগত সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে, আমরা প্রায়শঃই যার সম্মুখীন হচ্ছি, শ্রমিক আন্দোলনের বিভিন্ন আংশিক প্রশ্নে শোধনবাদীদের সঙ্গে কম কৌশলগত পার্থক্য এবং তার ভিত্তিতে ভাঙন হিসাবেই শুধু এখন যা বাস্তবে মাথা চাড়া দিচ্ছে, তা শ্রমিক-শ্রেণিকে অনিবার্য ভাবেই উত্তীর্ণ হতে হবে, এমন বৃহত্তর পরিসরে মোকাবিলা করতে হবে যার কোন তুলনা চলে না; সেটা ঘটবে যখন প্রলেতারীয় বিপ্লব সমস্ত বিতর্কিত প্রশ্নকে আরো তীব্র করে তুলবে এবং জনগণের আচরণ নির্ধারণের পক্ষে অতি আশু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির ক্ষেত্রে সমস্ত পার্থক্যকে কেন্দ্রীভূত করে তুলবে, লড়াইয়ের উত্তাপের মধ্যে বন্ধুদের থেকে পৃথক করে তুলবে শত্রুকে এবং শত্রুর উপরে চুড়ান্ত আঘাত হানার জন্যে বাজে সহযোগীদের বর্জন করবে।
পেটি বুর্জোয়াদের সমস্ত দোদুল্যমানতা আর দূর্বলতা সত্ত্বেও লক্ষ্যসাধনের সম্পূর্ণ জয়ের দিকে প্রলেতারিয়েত এগিয়ে চলেছে; উনিশ শতকের শেষের দিকে শোধনবাদের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক মার্কসবাদের তত্ত্বগত সংগ্রাম প্রলেতারিয়েতের সেই বিপুল বিপ্লবী সংগ্রামেরই প্রস্তাবনা মাত্র।[২]
টীকাঃ
১. বগদানভ, বাজারভ ও অন্যদের লিখিত ‘মার্কসবাদী দর্শনের ওপর অধ্যয়ন’ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এই বই নিয়ে আলোচনার স্থান এটা নয়। এই মুহূর্তে একথা বলার মধ্য দিয়ে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই যে, অদূর ভবিষ্যতে একটা ধারাবাহিক প্রবন্ধ বা একটা পৃথক পুস্তিকায় আমি সপ্রমাণ করব যে, নয়া কান্টবাদী সংশোধনবাদীদের সম্পর্কে যা কিছুই আমি মূলগ্রন্থে বলেছি, তা অপরিহার্যরূপেই এসব ‘নতুন’ নয়া হিউমবাদী ও নয়া বার্কলেবাদীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দেখুন লেনিন রচনা সংকলন, খন্ড ১৪। এখানে দেয়া কথা অনুযায়ী লেনিন পরবর্তীতে লেখেন তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা’।
২. ভি আই লেনিন প্রবন্ধটি লেখেন ১৯০৮ সালের মার্চের দ্বিতীয় অর্ধে, বা ৩ (১৬) এপ্রিলের পরে নয়। এখানে প্রবন্ধটি সংকলিত এবং এটি নেয়া হয়েছে প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭১ থেকে প্রকাশিত মার্কস এঙ্গেলস মার্কসবাদ গ্রন্থের ৮৬-৯৫ পৃষ্ঠা থেকে।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।