
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবির জাতীয়তাবাদ অভিমুখি বিচ্যুতিটি হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণির সংগে অবিরাম বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। সিপিবি হচ্ছে সাম্যবাদবিরোধী সেই সংগঠন যাদের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য রয়েছে। সিপিবি এখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদের সেই প্রতিক্রিয়াশীল ফেরিওয়ালা যখন বাঙালিরা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর উপর অনবরত নিপীড়ন চালাচ্ছে। ১ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে সিপিবি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবার দাবিতে যে মিছিল করে তার ব্যানারের প্রথম কথাটিই হচ্ছে তারা জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের মতে “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা মুক্তিযুদ্ধের মূলভিত্তি” এখন ভূলুণ্ঠিত।[১] এইভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনা তাদের সারা জীবনের মূল চেতনা যা তারা আজো ফেলতে পারে নাই।
ঢাকায় ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ শাহবাগে ১৯৭১ সালে সঙ্ঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে প্রধানত আওয়ামি লিগের সংগঠনসমূহ এবং কিছু সংশোধনবাদি বামপন্থী সংগঠন আবার জয়বাংলা স্লোগানকে গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তাদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই শ্লোগানটি দীর্ঘদিন চালু রেখেছে।[২] তারা তাদের জাতিয়তাবাদি বিচ্যুতিকে অতীতের মতো পরিত্যাগ করতে পারছে না। এই শ্লোগানটি সম্পর্কে মার্কসবাদীদের পক্ষ থেকে নানা সময়ে গত চার দশকে বহুত কথা বলা হয়েছে। তদুপরি কিছু সংশোধনবাদি ও কমিউনিস্ট ট্রেডমার্কধারী ব্যক্তি এই শ্লোগানটি ত্যাগ করতে কষ্ট পাচ্ছেন।
আমরা জাতিয়তাবাদি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সর্বহারা শ্রেণির মহান শিক্ষক স্তালিন কী বলেছেন সেটি একটু দেখি। তিনি সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্টদের মধ্যে জাতিয়তাবাদ অভিমুখি বিচ্যুতিটি সম্পর্কে বলেছেন,
“জাতিয়াতাবাদ অভিমুখি বিচ্যুতিটি হলো বুর্জোয়া শ্রেণির জাতিয়তাবাদি নীতির সাথে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবাদী নীতিকে মানানসই করা।”[৩]
জাতিয়তাবাদ সম্পর্কে সিপিবির অ-মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙির কারণেই তারা ১৯৭৪ সালে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। ‘নীতিই প্রধান, কৌশল নয়’ মার্কসবাদের এই নীতিকে অনুসরণ না করার কারণেই সংশোধনবাদিরা নীতিকে লঙ্ঘন করে কৌশলকে প্রধান করে; যার ফলে শাহবাগ আন্দোলনে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান সামনে চলে আসে। কিন্তু সিপিবি যে দ্বিদলীয় বৃত্ত ভাঙ্গার কথা বলে? বাস্তবতা হচ্ছে তারা এই শ্লোগানকে সামনে এনে দ্বিদলীয় বৃত্ত ভাঙ্গার নীতি থেকে সরে এসেছে। সুযোগ পেলেই প্রগতিশীলতার সংজ্ঞাকে বিকৃত করে সিপিবির সংশোধনবাদিরা আওয়ামি লিগকে প্রগতিশীল হিসেবে দেখাতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ তো গত চার দশকে প্রগতিশীলতার নাম নিয়েই চলছে ইতিহাসের উল্টোদিকে। ফলে যেসব সংশোধনবাদি এখনো আওয়ামি লিগের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে চায় তারা এটি করেন শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির লড়াইকে আড়ালে রেখে মার্কসবাদের মৌলিক নীতিগুলোকে বিকৃত করেই।
নীতি পরিত্যাগ করে কৌশলকে প্রধান করলে তা আর মার্কসবাদ থাকে না। জনগণের ঐক্য মার্কসবাদীরাও চায়, বুর্জোয়ারাও চায়। কিন্তু কথা হচ্ছে ঐক্য কার নেতৃত্বে হবে; মার্কসবাদীরা বলে ঐক্য হতে হবে তাদেরই নেতৃত্বে। অর্থাৎ লিগ-বিএনপিকে পরাজিত করেই কেবল জনগণের সার্বিক মুক্তি ও ঐক্য হতে পারে। দ্বিদলীয় বুর্জোয়া রাজনীতি উৎখাতের নীতি সিপিবি পরিত্যাগ করলেও বাংলাদেশের মার্কসবাদীরা এখনো পরিত্যাগ করেননি।
যারা শাহবাগ আন্দোলনকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলছেন তারা যুদ্ধ কী তা মার্কসবাদী দৃষ্টিতে বুঝছেন না। শ্রেণিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধ এক নয়; যেমন এক নয় ১৯৭১ আর ২০১৩; ফলে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াকে যারা ক্ষমতায় রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান তারা শ্রমিক-কৃষক জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। অর্থাৎ মূল শত্রুকে আড়াল করছেন।
সব লড়াইকেই শ্রেণিসংগ্রামের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করতে হবে; এমনকি ১৯৭১-কেও। কিছু কিছু বামপন্থি ওই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তারা সেটিকে শ্রেণিসংগ্রাম বলেন না। আসল ব্যাপার হচ্ছে ১৯৭১-এর শ্রেণিযুদ্ধটি মুক্তিযুদ্ধপন্থিদের গলার কাঁটা, না পারেন তারা সেটিকে ছেড়ে দিতে, না পারেন সেটিকে অতিক্রম করে যেতে। ওই যুদ্ধে শুধু পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র ও পাকি নয়া-উপনিবেশবাদই পরাজিত হয়নি, বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষকও পরাজিত হয়েছে, যদিও যুদ্ধে তারা উঠতি বুর্জোয়াদেরকে সহযোগিতা করেছিলেন। তত্ত্বগত সীমাবদ্ধতা, সমাজ-গণতন্ত্রী মনোভাব আর পেটি বুর্জোয়া অর্থনীতির কারণেই সিপিবি-বাসদ-বামমোর্চার কিছু মানুষের ভেতরে জাতিয়তাবাদ অভিমুখী বিচ্যুতিটি আজো বিরাজমান।
তথ্যসূত্রঃ
১. নিজস্ব প্রতিবেদক, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯ “মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বুর্জোয়ারা: সেলিম” দৈনিক কালের কণ্ঠ, ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেড, লিংক: https://www.kalerkantho.com/online/national/2019/12/01/845810
২. ২৩ মার্চ ২০১৩, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ময়মনসিংহ জেলার সম্মেলনে শাহবাগ আন্দোলনের অগ্নিকন্যাখ্যাত লাকি আক্তার বক্তৃতা শেষ করেন ‘জয় বাংলা’ বলে এবং একই দিন বিকেলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ-এ ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে জয় বাংলা শ্লোগান দেয়া হয়। এছাড়া ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ঢাকায় সিপিবি-বাসদ যৌথ সমাবেশে লাকি আক্তার এই স্লোগান ধরে এবং সমস্ত নেতাকর্মীরা তাতে গলা মেলায়।
৩. জে. ভি. স্তালিন, সিপিএসিউ-এর সপ্তদশ কংগ্রেসের কেন্দ্রিয় কমিটির রিপোর্ট, জানুয়ারি, ২৬, ১৯৩৪।
রচনাকাল: ২৪ মার্চ, ২০১৩, ময়মনসিংহ।