সমাজতান্ত্রিক মানুষের স্বরূপ হচ্ছে সাম্যবাদ আকাঙ্ক্ষী বিপ্লবী চেতনার লড়াকু মানুষ

সমাজতান্ত্রিক মানুষের স্বরূপ (ইংরেজি: The nature of the socialist) হচ্ছে সাম্যবাদ আকাঙ্ক্ষী বিপ্লবী চেতনার লড়াকু মানুষ। এই সমাজতান্ত্রিক মানুষ সম্পর্কে অনেক দার্শনিক, লেখক ও নেতা যথার্থ আলোচনা করেছেন।

এরিখ ফ্রম সমাজতান্ত্রিক ধারার দার্শনিক ও লেখক। ১৯৮০ সালে তিনি যখন মারা যান তখন সমস্ত প্রচারমাধ্যম তাকে মনঃসমীক্ষক হিসেবে গুণগান করেছিলো। তবে তিনি তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু ছিলেন। এই দার্শনিক মানুষটি আগাগোড়াই জানতেন পুঁজিবাদ জানে কেবল মানুষের সামনে মিথ্যার আকর্ষণীয় পসরা সাজিয়ে মুনাফা লুটতে। তিনি কার্ল মার্কসের ছাত্র হিসেবে পুঁজির অধীনতা থেকে মানুষের সর্বাঙ্গীন স্বাধীনতা ছেয়েছিলেন।

এই মহান মানুষটির একটি উক্তি আমরা সর্বদাই মনে রাখি। উক্তিটি হচ্ছে, “মানুষ পরিস্থিতির তৈরি, তবে সেই পরিস্থিতিও মানুষের তৈরি। এক অনন্য ক্ষমতা মানুষকে বাকি সব জীবন্ত জিনিস থেকে আলাদা করেছে; তা হলো নিজ আর নিজ পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া। তাই সেই সচেতনতা অনুযায়ী নিজেদের কাজ ঠিক না করলে মানুষ হওয়া যায় না”।[১]

কার্ল মার্কস মানুষকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “মানুষ মানুষের কাছে সবচেয়ে সমুন্নত জীব।… উতখাত করো বর্তমানের এমন সকল সম্পর্ক যেখানে মানুষ হয়ে রয়েছে হেয়, দাসে পরিণত, বিস্মৃত ও ঘৃনিত জীব।”

ভি আই লেনিন যে তিন রকমের মানুষের কথা বলেছেন সেখানে তিনি সংখ্যায় স্বল্প প্রতিবাদী ও বিদ্রোহীদেরই গুরুত্ব দিয়েছেন। ক্ষতিকর বলেছেন সেসব মানুষকে যারা শাসকদের কাছে গিয়ে সুবিধা নিয়ে একটু আরামে থাকার চেষ্টা করে। আর বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠরা জন্ম-মৃত্যুর ভেতরেই জীবন কাটিয়ে দেয়।

জার্মান ভাবাদর্শে কার্ল মার্কস বলছেন যে, ‘মানুষ বুঝতে বাস্তবের মানুষ থেকে আপনাকে শুরু করতে হবে।’ আগে মানুষ ধরেন, মানুষ ভজেন, তারপর হীরা বানান, সোনা আর নিকেল বানান সেটা সেই ভাবাদর্শের মানুষ হবে। মানুষই ইতিহাস পাল্টায়, কিন্তু তার নিজের ইচ্ছেমত বদলাতে পারে না, এইসব হাড্ডি খিজিরাই ইতিহাস পাল্টে দেয়।

মানুষ সম্পর্কে মাও সেতুং-এর ধারণা ছিলো চমৎকার। যেমন তিনি বলেছেন, “দুনিয়ার সব জিনিসের মধ্যে মানুষই সবচেয়ে মূল্যবান। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যতদিন জনগণ থাকবেন ততদিন যে কোনো বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটিয়ে দেয়া যাবে।… বিপ্লব সব কিছু পালটে দিতে পারে।”[২]

চে গ্যেভারা মানুষের স্বরূপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, “পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটির সমস্ত সম্পদের চেয়েও ১০ লক্ষ গুণ অধিক মূল্যবান একজন মানুষের জীবন।”

গল্পকার জ্যাক লন্ডনের নায়কেরা গতিশীল, বাঁচার জন্য একগুঁয়ে এবং সংগ্রামী, নিজের যন্ত্রণার ভেতরেও তারা প্রতিবাদী। গতিশীল চরিত্ররা আর দশটা আদিম জৈবিক প্রাণীর চেয়ে আলাদা হয়ে থাকে।

সমাজতান্ত্রিক মানুষের স্বরূপ পুঁজিবাদ অথবা সামন্তবাদের ভেতর থেকে উদ্ভুত হলেও তারা মানুষ হিসেবে অবশ্যই নতুন মানুষ। তারা এমন মানুষ যাদেরকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে অতীতে দেখা যায়নি। পুঁজিবাদ মানুষকে লোভি ও হিংস্র নেকড়েতে পরিণত করে। সমাজতান্ত্রিক মানুষের চিন্তা গড়ে উঠেছে ঠিক তার বিপরীত চিন্তাকে ধারণ করে। ফিদেল ক্যাস্ত্রো গিয়ান্নি মিনার সাথে সাক্ষাতকারে বলেছিলেন “সমাজতন্ত্রে মানুষ স্বদেশ এবং জাতীয় স্বাধীনতাকে তো ভালোবাসেই, সেই সাথে সমাজকেন্দ্রিক মূল্যবোধগুলোকে বিশেষ করে মানবিক সৌহার্দ্যকে উর্ধে তুলে ধরতে চায়।”[৩]

টমাস হবসের তৈরি করা সমাজ টিকে থাকলে মানুষ পাওয়া মুশকিল আছে, পুঁজির বাইরের যে সমাজ আসবে সেই সমাজেই শুরু হবে মানুষের ইতিহাস। ফলে আমরা সবাই কেউ আধ-মানুষ, কেউ সিকি-মানুষ।

তথ্যসুত্র

১. এরিখ ফ্রম; Our Way of Life Makes us Miserable, 1964.
২. মাও সেতুং; ‘ইতিহাসের ভাববাদি ধারণার দেউলিয়াপনা’ থেকে; ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯।
৩. ফিদেল ক্যস্ত্রো; ফিদেল ক্যস্ত্রোর মুখোমুখি, জাহানারা নূরী অনূদিত, শিখা প্রকাশনী, ঢাকা; পৃষ্ঠা, ১৩৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!