জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট হচ্ছে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ও রাজনৈতিক সংগঠনের একটি ফ্রন্ট সংগঠন যারা জলযান চলাচলের সমস্যায় নৌযান, কার্গো ও চিংড়িঘের মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করছে। সুন্দরবন না থাকলে কর্মহীন হবে কয়েক লাখ বনজীবী, মৎস্যজীবী, কৃষক। এরা শুধু কর্মহীন হবে না, এরা আসবে শহরে, থাকবে বস্তিতে, জীবনযাপন করবে কষ্টের, নাম লেখাবে প্রলেতারিয়েতের খাতায়। শোষণের ভিত্তিতে পুঁজির উদ্ভবের এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রচলিত নিয়ম।[১] কার্ল মার্কস লিখেছেন,
“আদি সঞ্চয়ের ইতিহাসে যে সব বিপ্লব পুঁজিবাদী শ্রেণি গঠনের ক্ষেত্রে হাতলের কাজ করে, সেগুলি সবই যুগান্তকারী; কিন্তু সর্বোপরি যুগান্তকারী হল সেই সব সন্ধিক্ষণ, যখন বিপুলসংখ্যক লোককে সহসা ও সবলে তাদের জীবনধারণের উপায় থেকে ছিন্ন ক’রে এনে শ্রমবাজারে নিক্ষেপ করা হয় মুক্ত ও ‘অনাবদ্ধ’ প্রলেতারীয় হিশেবে।”[২]
দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি হলেও ঘটবে একই ঘটনা। এই ধরনের ঘটনা অতীতে তিস্তা নদীসহ বিভিন্ন নদী ও বনাঞ্চল হত্যার মাধ্যমে ঘটেছে। মৎস্যজীবী ও কৃষিজীবী জনগণ নদী রক্ষা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে উৎখাত হয়ে এখন শহরে এসে বস্তিবাসির খাতায় নাম লিখিয়েছে।
ভূমি দস্যু বলতে আমরা আজকাল যা বুঝি তা মূলত নদী ও বনভূমিকেকে মেরে ফেলার পর সেই জমি দখল করার প্রক্রিয়া। সুন্দরবনের পাশে যে চিংড়ি ঘের ও চিংড়ি শিল্প গড়ে উঠেছে তা কৃষিজমি দখল করে করা হয়েছে। এই চিংড়িঘের সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ আমেরিকানদের খাবার সরবরাহ করে, এটির উদ্ভব হয়েছিল আমাদের স্থানীয় কৃষিকে ধ্বংস করে। চিংড়িঘের মালিকরা ঘষিয়াখালী নদীর নৌরুটটি দখল করে নিলে সরকার সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচলের অনুমতি দেয়। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সাথে দেশের অন্যান্য জায়গা এবং ভারতের সাথেও জাহাজ যোগাযোগের একমাত্র পথ এখন শ্যালা নদী।
মৎস্যজীবী ও লাখ লাখ মানুষের জীবন জড়িত সুন্দরবনের উপরে। সেই সুন্দরবন ধ্বংস হচ্ছে নৌযান মাকিলদের জন্য। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজডুবির পর থেকে ওই পথ দিয়ে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই শ্যালা নদীর রুটটি চালু করার জন্য গত ৩ জানুয়ারি আল্টিমেটাম দিয়েছে এবং ৬ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির হুমকি দিয়েছে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন[৩]। তাদের প্রধান দাবি, “সুন্দরবনের শ্যালা নদীর নৌপথ চালু” করতে হবে। তারা উল্লেখ করেছে ‘শ্যালার নৌপথ বন্ধ থাকায় নৌযানে কর্মরত প্রায় ছয় হাজার কর্মচারী অনাহারে-অর্ধাহারে জীবনযাপন করছে’[৪]।
সরকার চেষ্টা করলে এবং শ্রমিক কৃষকের শক্তিকে কাজে লাগালে বিকল্প রুটটি তিনমাসে খননসহ অন্যান্য কাজ শেষ হতে পারে। সুন্দরবনের তেল সংগ্রহ করে স্থানীয় জনগণ যে অমিত শক্তির পরিচয় দিয়েছে, তারা বিকল্প রুটটি চালু করার জন্যও অসীম শক্তি দেখাতে পারেন। কিন্তু সেসব বিষয় খতিয়ে না দেখে ‘বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন’ মূলত নৌযান মালিক ও চিংড়ি ঘের মালিকদের স্বার্থ দেখছে, দেখছে না সেই অঞ্চলের লাখ লাখ শ্রমিক-কৃষক-মৎস্যজীবীর স্বার্থ।
চিংড়ি ঘের মালিকরা বিকল্প রুটটি ধ্বংস করেছে, কৃষি ধ্বংস করেছে। নাকি দুদিন পরে চিংড়ি ঘেরের শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন বা তাদের প্রধান ফ্রন্ট সংগঠন এনডিএফ বলবে বিকল্প রুটটি চালু হলে চিংড়ি শিল্প ও চিংড়ি ঘেরের শ্রমিকরা কর্মহীন হবে, তাই বিকল্প রুটটি চালু করা যাবে না। এসব কারণেই বুর্জোয়ারা কর্মসংস্থানের গালভরা বুলি ছোঁড়ার শক্তি পায়। কিন্তু এসব কথা না বলে শ্যালা নদীর রুটটি চালুর আল্টিমেটাম দিয়ে বসল বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন।
ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের কাজ হচ্ছে শ্রমিককে রাজনীতি, শ্রেণিসংগ্রাম শেখানো। কিন্তু সেটি না করে নৌযান মালিকদের পক্ষে নামিয়ে দেয়াটি সুবিধাবাদের পর্যায়ে পড়ে। অথচ এই ধর্মঘটটি হতে পারতো যেসব দাবিতে সেগুলো হচ্ছে, ১. বিকল্প ঘষিয়াখালী, মংলা ও পশুর নদীর নাব্যতা নিশ্চিত এবং পুরনো নৌরুটগুলি চালু ও খনন করা, ২. আপাত কর্মহীন নৌযান শ্রমিকদের ন্যায্য ভাতা প্রদান, ৩. যতদিন বিকল্প রুটটি চালু না হয় ততদিন নৌযান শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা, ৪. সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যাবতীয় বাণিজ্যিক নৌ পরিবহন বন্ধ করা, ৫. অবৈধ চিংড়ি ঘের দ্রুত অপসারণ করে নৌ যোগাযোগ প্রতিবন্ধকতা দূর করা। এসব দাবি না করে ফেডারেশনের নেতারা বাওয়ালি, বনজীবী, জেলে, মৎস্যজীবী ও কৃষকবিরোধী দাবি নিয়ে ধর্মঘট ডেকে বসল।
নৌযান মালিক ও চিংড়িঘেরের মালিকরা বাণিজ্য করে, মুনাফা করে, শোষণ করে। আর নৌযান শ্রমিক ও চিংড়ি শ্রমিকরা হয় শোষিত। ব্যবসা বাড়লে শোষণ বাড়ে। চিংড়ি মালিকরা সাম্রাজ্যবাদীদের সেবা দেয়। আর মংলা বন্দরের নৌযান মালিকরাও সেবা করে সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের। তো মালিকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে এরকম আল্টিমেটাম দেয়া জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সামিল। এনডিএফ এরকম আরও অনেক দিক দিয়েই প্রকৃতি এবং মার্কসবাদবিরোধী অবস্থানে চলে গেছে। বেশি কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতিকে ছুঁড়ে ফেলার পরিণাম হচ্ছে এইরকম বুর্জোয়াদের, নৌযান মালিক, কার্গো ভেসেল মালিক ও চিংড়িঘের মালিকদের, সমর্থন করে আল্টিমেটাম দেয়ার সুবিধাবাদী লাইন।
তথ্যসূত্র ও টীকাঃ
১. এ-বিষয়ে বিস্তারিত পড়ুন কার্ল মার্কসের পুঁজির অষ্টম অধ্যায়।
২ কার্ল মার্কস, পুঁজির উদ্ভব, আদি সঞ্চয়ের রহস্য, শেষ অনুচ্ছেদ।
৩. বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন কী? নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রাফটা ফেডারেশন। ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ হচ্ছে এনডিএফ এর অন্তর্ভুক্ত একটি সংগঠন। এর অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য সংগঠনগুলো হলো জাতীয় ছাত্রদল, কৃষক সংগ্রাম সমিতি, ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি।
৪. মংলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি, দৈনিক প্রথম আলো, ০৩ জানুয়ারি ২০১৫, কর্মবিরতির হুমকি নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের, খবরের লিংক http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/414616/
রচনাকালঃ ৫ জানুয়ারি, ২০১৫, প্রথম প্রকাশ, প্রাণকাকলি সাইটে, ৫ জানুয়ারি, ২০১৫।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।