মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ মতবাদে অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতাকে (ইংরেজি: Irregular warfare) সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে “প্রাসঙ্গিক জনগোষ্ঠীর উপরে বৈধতা ও প্রভাব বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্র ও অ-রাষ্ট্রীয় কার্যকর্তাদের মধ্যে একটি সহিংস লড়াই।” অনিয়মিত যুদ্ধের সাথে জড়িত ধারণাগুলি এ শব্দটির চেয়ে পুরানো।
অনিয়মিত যুদ্ধ শব্দটির প্রথম দিকের ব্যবহারগুলির মধ্যে অন্যতম হলো প্রাক্তন নাৎসি অফিসার ফ্রিডরিখ অগস্ট ফ্রেইহার ভন ডের হাইডের রচিত “সামরিক ঘটনা হিসাবে প্রতিরক্ষা নীতিতে আধুনিক অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতা” গ্রন্থের ১৯৮৬ সালের ইংরেজি সংস্করণে। বইটির মূল ১৯৭২ সালের জার্মান সংস্করণটির শিরোনাম “Der Moderne Kleinkrieg als Wehrpolitisches und Militarisches Phänomen”। জার্মান শব্দ “Kleinkrieg”কে আক্ষরিক অর্থে “ছোট যুদ্ধ” হিসাবে অনুবাদ করা হয়েছে।[১] বইটির ইংরেজী অনুবাদের শিরোনামে ব্যবহৃত “অনিয়মিত” শব্দটি উপরোক্ত তৃতীয় জেনেভা কনভেনশন অনুসারে উল্লেখিত অ”নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী” বলে মনে হয়।
অনিয়মিত যুদ্ধ শব্দটির প্রথম দিকের ব্যবহারগুলির মধ্যে একটি হলো ১৯৯৬ সালের জেফ্রি বি. হোয়াইটের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (ইংরেজি: Central Intelligence Agency বা CIA)- এর নথিতে। ১১ই সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলার ফলে অনিয়মিত যুদ্ধ সম্পর্কিত প্রধান সামরিক মতবাদের বিকাশসমূহ ঘটেছিল ২০০৪ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের (ইংরেজি: US DoD) মধ্যে অনিয়মিত যুদ্ধের মূল প্রবক্তা হলেন সিআইএর প্রাক্তন আধাসামরিক কর্মকর্তা মাইকেল জি ভিকার্স। সিআইএর বিশেষ ক্রিয়াকলাপ বিভাগ (ইংরেজি: Special Activities Division) হলো অপ্রচলিত যুদ্ধ তৎপরতার প্রথম একক যেখানে অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতার একক (ইংরেজি: Unit) তৈরি ও বিবাদের জন্য কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, বিশেষ ক্রিয়াকলাপ বিভাগের আধাসামরিক কর্মকর্তারা ১৯৬০-এর দশকে লাওসে হামং গোত্রের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, ২০০১ সালে আফগানিস্তানের যুদ্ধের সময় তালেবানদের বিরুদ্ধে উত্তরাঞ্চলীয় জোটে, আনসার আল-ইসলামের বিরুদ্ধে কুর্দিশ পেসমারগায় এবং ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় সাদ্দাম হোসেনের বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল অনিয়মিত একক (ইংরেজি: irregular unit) তৈরি এবং নেতৃত্ব দিয়েছিল।
নিয়মিত এবং অনিয়মিত বাহিনীর মধ্যে পার্থক্যটি “অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতা” শব্দের সাথে সম্পর্কিত নয়। “অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতা” শব্দটি “ঐতিহ্যবাহী যুদ্ধ তৎপরতা” এবং “অপ্রচলিত যুদ্ধ তৎপরতা” শব্দ থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে এবং শব্দটিকে পৃথক করার জন্য পত্তন করা হয়েছিল।
অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতার উদাহরণ
প্রায় সমস্ত আধুনিক যুদ্ধের মধ্যে অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতার কিছু উপাদান অন্তর্ভুক্ত থাকে। নেপোলিয়নের সময় থেকে, প্রায় ৮০% সংঘর্ষ প্রকৃতিগতভাবে অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতার অন্তর্ভুক্ত ছিল। যাহোক, নিম্নলিখিত সংঘর্ষগুলি অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতা দ্বারা অনুকরণীয় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতার প্রধান দুটি ধরন হচ্ছে গৃহযুদ্ধ এবং গেরিলা যুদ্ধ তৎপরতা।
গৃহযুদ্ধ: গৃহযুদ্ধ (ইংরেজি: Civil War) হচ্ছে কোনো দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য সে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি, ধর্ম, জাতি অথবা রাজনৈতিক দল কিংবা গোষ্ঠীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ।[২] একটি গৃহযুদ্ধ, যা যুদ্ধবিদ্যায় একটি অন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ (ইংরেজি: intrastate war) হিসাবেও পরিচিত, হচ্ছে একই রাষ্ট্র বা দেশের মধ্যে সুশৃঙ্খলিত গোষ্ঠীগুলির মধ্যে একটি যুদ্ধ।
গেরিলা যুদ্ধ তৎপরতা: গেরিলা যুদ্ধ তৎপরতা (ইংরেজি: Guerrilla Warfare) হচ্ছে অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতার একটি ধরন যেখানে যুযুধান ছোট গোষ্ঠীগুলো যেমন আধাসামরিক কর্মী বাহিনী, সশস্ত্র বেসামরিক বাহিনী বা অনিয়মিত বাহিনীরা বিভিন্ন রণকৌশলসমূহ অবলম্বন করে। এসব সামরিক কৌশলের ভেতরে থাকে ঘাপটি মারা, নাশকতা, অতর্কিত হানা, ক্ষুদ্র যুদ্ধ তৎপরতা, আঘাত-ও-পলায়ন কৌশল এবং গতিশীলতার মাধ্যমে একটি বৃহত্তর এবং কম গতিশীল প্রথাগত সামরিক বাহিনির বিরুদ্ধে লড়াই। গেরিলা গোষ্ঠীগুলি হচ্ছে এক ধরণের হিংসাত্মক অ-রাষ্ট্রীয় কর্মী।
১. আফগান গৃহযুদ্ধ,
২. আলজেরিয়ান যুদ্ধ,
৩. আমেরিকান ভারতীয় যুদ্ধ,
৪. মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধ,
৫. আরব বিদ্রোহ,
৬. চীনা গৃহযুদ্ধ,
৭. কিউবার বিপ্লব,
৮. প্রথম চেচেন যুদ্ধ,
৯. প্রথম সুদানীস গৃহযুদ্ধ,
১০. ইরাক যুদ্ধ
১১. কসোভো যুদ্ধ,
১২. লেবাননের গৃহযুদ্ধ,
১৩. পর্তুগিজ উপনিবেশিক যুদ্ধ,
১৪. রুয়ান্ডা গৃহযুদ্ধ,
১৫. দ্বিতীয় বোয়ার যুদ্ধ,
১৬. দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ,
১৭. দ্বিতীয় সুদানিজ গৃহযুদ্ধ,
১৮. সোমালি গৃহযুদ্ধ,
১৯. ফিলিপাইন যুদ্ধ এবং
২০. ভিয়েতনাম যুদ্ধ
অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতার আরো কতিপয় সংজ্ঞা
১. অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতা হচ্ছে এমন এক প্রকার যুদ্ধ তৎপরতা যার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট কর্তৃত্বকে বিশ্বস্ত এবং বৈধ করবার লক্ষ্যে যুদ্ধের বিভিন্ন ধরন।
২. অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতা অপ্রত্যক্ষ এবং অসামঞ্জস্য যুদ্ধতৎপরতা পদ্ধতির পক্ষে, যদিও এটি শত্রুদের শক্তি, প্রভাব এবং ইচ্ছাকে ক্ষয় করার জন্য সামরিক এবং অন্যান্য ক্ষমতাগুলিকে পূর্ণ পরিসরে নিয়োগ করতে পারে। এটি সহজাতভাবে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম যা একটি রাষ্ট্র এবং এর কৌশলগত অংশীদারদের দৃঢ়তাকে পরীক্ষা করবে।
৩. অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতা সেইসব সংঘর্ষের সাথে জড়িত যার যোদ্ধারা জাতি-রাষ্ট্রের নিয়মিত সামরিক বাহিনী নয়।
৪. অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতা হচ্ছে “শিল্পজাত যুদ্ধ” অর্থাত্ নিয়মিত যুদ্ধের বিপরীত অর্থে “জনগণের মধ্যে যুদ্ধ”।
তথ্যসূত্র:
১. Moses, A. Dirk, “German intellectuals and the Nazi past,” Cambridge University Press, ISBN 978-0-521-86495-4, 2007, p. 206.
২. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ১০০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।