আইনসভা (Legislature) হচ্ছে সরকারের তিনটি অঙ্গের অন্যতম যেখানে রাষ্ট্রের আইন বিধিবদ্ধ হয়। আইনসভা কর্তৃক বিধিবদ্ধ আইনের ভিত্তিতে সরকারের অপর দুটি অঙ্গ, অর্থাৎ শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগ তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে কার্যনির্বাহ করে। আইনসভার প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন, সংশােধন ও পরিবর্তন করা।
রাষ্ট্রভেদে আইনসভার কার্যপদ্ধতি ভিন্ন। আইনসভা অনেক রাষ্ট্রে গণপরিষদের কাজ হিসেবে সংবিধান প্রণয়ন, সংশােধন প্রভৃতি কাজ করে। অনেক সময় আইনসভা নির্বাচক বর্গে (electoral college) পরিণত হয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। সরকারের আয়ব্যয় সম্পর্কিত যাবতীয় সিদ্ধান্ত, বাজেট অনুমােদন ও আর্থিক ক্রিয়াকর্মের সমালােচনা আইনসভার অন্যতম প্রধান কাজ।
আইনসভা সরকারের অন্যান্য যাবতীয় ক্রিয়াকর্মের পর্যালােচনা করে। মন্ত্রিচালিত সরকারের মন্ত্রিগণকে আইনসভার সদস্য হতে হয় এবং নিজেদের কাজের জন্যে আইনসভার কাছে দায়ী থাকতে হয়। সংসদীয় গঠনতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচনে আইনসভায় নির্বাচিত দলভিত্তিক প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মন্ত্রিসভা গঠন করে।
এক-কক্ষ ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: আঠারাে শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের গােড়ায় এক-কক্ষবিশিষ্ট (unicameral Legislature) আইনসভা বেশি জনপ্রিয় ছিল। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ও জেরেমি বেনথাম আইনসভায় এককক্ষের ব্যবস্থাকে সমর্থন করতেন। পরে হ্যারল্ড লাস্কিও অনুরূপ অভিমত পােষণ করতেন। দুজনের অভিমত ছিল যে আইনসভায় প্রতিনিধিত্বমূলক একটি কক্ষ থাকাই সংগত; তার উপরই রাষ্ট্রের অবিভাজ্য সার্বভৌমত্ব নির্ভর করলে লােকের আশা-আকাঙক্ষা সহজে বাস্তবায়িত হতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা আছে।
ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার রীতি রদ করা হয়েছে। কারণ একটি কক্ষ থাকলে আইন প্রণয়নের কাজ অনেক সরল ও দ্রুত হতে পারে, নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতিনিধিত্ব সরাসরি ও চুড়ান্ত হয়। দায়িত্ব ও কর্তব্যে বিভাজন ঘটে না। ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবে সিয়েস মনে করতেন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট ব্যবস্থায় উভয় কক্ষ কোনও বিষয়ে ঐকমত্য হলে এই ব্যবস্থা বাহুল্য বিশেষ, আবার দ্বিমত হলে ব্যবস্থাটি রদ করাই ভাল। কাজেই তাঁর মতে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা সুবিধাজনক। ব্যবস্থাটির বিরুদ্ধে আপত্তির সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো অহেতুক ব্যয়।
উল্লিখিত নানা প্রশ্ন সত্ত্বেও কালক্রমে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় উভয়ধরনের রাষ্ট্রেই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তিত হয়। যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন। অনেক দেশই ওই দুটি ব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করে।
তত্ত্বগতভাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় (bicameral Legislature) একটি কক্ষ অপরকে নিয়ন্ত্রণ করে; কোনও বিষয়ে দ্রুততা অপেক্ষা পর্যালােচনার উপর বেশি জোর দেওয়া হয়। কার্যত উচ্চকক্ষের ক্ষমতা বহু দেশে প্রায়শই সংকুচিত হয়ে পড়ে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষাপক্ষে অনেক যুক্তিতর্ক আছে। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আপত্তি হলো বিলম্ব এবং উচ্চকক্ষের সদস্যদের যােগ্যতা নির্ণয় সমস্যা। উচ্চকক্ষের সদস্যরা মনােনীত হয়ে থাকেন, তাতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ক্ষুন্ন হয়।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ব্যবস্থার সমর্থক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লেকি মনে করেন যে নিম্নকক্ষে দ্রুত গৃহীত আইনগুলি খুঁটিয়ে দেখে সেগুলির সংশােধন ও পরিবর্তন এবং নিম্নকক্ষের একাধিপত্য নিবারণ উচ্চকক্ষে সহজেই সম্ভব। বিলম্ব যা ঘটে তার মধ্যে কোনও বিল সম্পর্কে উচ্চকক্ষে সবিস্তারে পরীক্ষার পক্ষে সময়টা কাজে লেগে যায়। আইন প্রণয়নের কাজে যথােচিত সতর্কতার সুযােগ, জনমত নির্ণয়ের সুবিধা ও এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার অসতর্কতা ও স্বেচ্ছাচারিতা এড়ানাে দ্বিকক্ষের অনুকুলে প্রধান যুক্তি। জন স্টুয়ার্ট মিল, ব্রাইস, দ্যগুই প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দ্বিকক্ষের সমর্থনে অনুরূপ অনেক যুক্তি দেখিয়েছেন।
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ২৯-৩০।
বি. দ্র. সরকার ; প্রশাসনবিভাগ ; বিচারবিভাগ ; ক্ষমতার পৃথকীকরণ ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।